আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
কট্টরপন্থা ছেঁটে ফেলতে ফ্রান্সে ইসলামকে ঢেলে সাজাতে চাচ্ছে দেশটির সরকার। শনিবার (৫ ফেব্রুয়ারি) ইমাম, সাধারণ নাগরিক ও নারীদের নিয়ে একটি সংস্থা গঠন করা হয়েছে। পশ্চিম ইউরোপের বৃহৎ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করতেই এ পদক্ষেপ বলে দাবি করা হচ্ছে।
আগে উগ্রবাদীদের হামলায় ফ্রান্সে রক্ত ঝরেছে। শত শত ফরাসি নাগরিক জিহাদিদের হয়ে লড়াই করতে সিরিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন। আফ্রিকায় উগ্রবাদের বিরুদ্ধে লড়ছে কয়েক হাজার ফরাসি সেনা। দেশটিতে উগ্রপন্থার ঝুঁকি নিয়ে প্রায় সবাই একমত। খবর এপির।
তবে ফরাসি সরকারের নতুন পদক্ষেপকে ভিন্ন চোখে দেখছেন সমালোচকেরা। তারা বলছেন, এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর মধ্যপন্থি দলটি ডানপন্থি ভোটারদের টানতে রাজনৈতিক খেলায় মেতে উঠেছে।
নতুন সংস্থাটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘ফোরাম অব ইসলাম ইন ফ্রান্স’। শনিবার ফরাসি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার কথা জানিয়েছে। সমর্থকেরা বলছেন, এতে ফ্রান্স ও দেশের ৫০ লাখ মুসলমান নিরাপদে থাকতে পারবেন। বিদেশি প্রভাব থাকবে না। ফরাসিদের জনজীবনে লালিত ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের সঙ্গে তাল রেখে মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় চর্চা করতে পারবেন।
বহু মুসলমান ফরাসি পরিচয়ের সঙ্গে ধর্মকে একাকার করে দেখছেন। তাদের কথা বিবেচনায় নিয়ে সমালোচকেরা জানান, বৈষম্য প্রক্রিয়াকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করতে সরকার আরেকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। এতে কয়েক জনের হামলার দায় গিয়ে পড়বে গোটা সম্প্রদায়ের ওপর।
সরকারের পদক্ষেপের কারণে মুসলমানদের জনজীবনে আরেকটি বড় বাধা তৈরি হতে পারে বলেও অভিযোগ করা হচ্ছে।
সংস্থাটির সদস্যদের মধ্যে ইমাম, সুশীল সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী ও ব্যবসায়ী নেতারাও থাকছেন। যারা এ সংগঠনের সদস্য হবেন, তাদের সবাইকে বাছাই করেছে সরকার নিজেই।
ফরাসি সংবাদমাধ্যম বলছে, সদস্যদের একটি অংশ থাকবেন নারীরা। এর আগে ২০০৩ সালে তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি ফ্রেন্স কাউন্সিল অব মুসলিম ফেইথ প্রতিষ্ঠান করেছিলেন। সেটির স্থলাভিষিক্ত হবে ফোরাম অব ইসলাম ইন ফ্রান্স।
ধর্মীয় নেতা ও সরকারের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা রাখত কাউন্সিল অব মুসলিম ফেইথ। কিন্তু চলতি মাসে এটিকে ভেঙে দেয় ম্যাক্রোঁ সরকার। ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গেরাল্ড ডারমানিন বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় হামলায় যখন কয়েক শ মানুষ নিহত হয়েছেন, তখন কাউন্সিলটি ফরাসি সমাজ ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি।
লা পারিসিয়ানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘ইসলামের ওপর বিদেশি প্রভাবের ইতি ঘটিয়ে আমরা একটি বিপ্লব শুরু করতে চাই। ফ্রান্সে ইসলাম বিদেশিদের কোনো ধর্ম নয়। ফরাসি ধর্মের বিদেশি তহবিল কিংবা কর্তৃপক্ষের ওপর ভরসা করা উচিত নয়।’
প্রকল্পটির মাধ্যমে ফরাসি ইমামদের প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা রয়েছে ম্যাক্রোঁর। তুরস্ক, মরক্কো ও আলজেরিয়া থেকে ইমামদের আনা হবে না। পরিকল্পনাটি মুসলমানদের অধিকাংশেরই সায় বলে দাবি করা হচ্ছে।
যদিও সরকারের উদ্যোগ নিয়ে দেশটির মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তিও দেখা যাচ্ছে। প্যারিসের গ্র্যান্ড মসজিদের মুসল্লিদের অনেকেই সতর্কতার সঙ্গে ম্যাক্রোঁর পরিকল্পনাকে স্বাগত জানানোর কথা বলছেন।
অনেকের শঙ্কা, তাদের ধর্মীয় জীবনকে নিয়ন্ত্রণ-চেষ্টার অংশ হিসেবেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে। সরকার ইসলামি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আলাদা চোখে দেখছে। কিন্তু খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় জীবনে কোনো পরিবর্তন আনার আভাস নেই।
ম্যাক্রোঁর পরিকল্পনা নিয়ে আশার কথা জানিয়েছেন ৫১ বছর বয়সী প্যারিসের বাসিন্দা হামুদ বিন বাউজিদ। তিনি বলেন, একটি বড় সামাজিক পরিসরের বৈচিত্র্য দেখাতে সংগঠনটিতে মুসলমানদের মধ্যে ভিন্নমতাবলম্বীদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
তিনি বলেন, ‘আমরা একটি ধর্মনিরপেক্ষ সমাজে বসবাস করছি। কাজেই সেখানে কেন এমন কোনো ফোরাম থাকবে না। এতে ফ্রান্সের বহু মুসলমানের কথা বলার সুযোগ তৈরি করে দেবে। আমি চাই, মুসলমানদের শুধু ধর্মীয় পরিচয়েই নয়—এই দেশের একজন নাগরিক হিসেবেই দেখা হোক। তারা যাতে পরিপূর্ণ নাগরিকের মর্যাদা পান।’
ফ্রান্সে মুসলমানদের প্রাত্যহিক জীবনকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করার অভিযোগ রয়েছে। তাদের সঙ্গে বৈরী আচরণ করছে পুলিশ। রাস্তাঘাটে হাঁটতে গেলে তাদের পরিচয়পত্র পরীক্ষা করা হচ্ছে। আর চাকরির ক্ষেত্রেও তাদের সঙ্গে বৈষম্যের অভিযোগ রয়েছে।
ফ্রান্সে ইসলাম দ্বিতীয় ধর্ম হলেও সেখানে মুসলমানদের একক কোনো নেতা নেই।