হোম ফিচার প্রতিবন্ধী শিশুর ৩ কেজি বাদাম বিক্রিতে চলে অভাবী মায়ের ৫ জনের সংসার!

রিপন হোসেন সাজু, মণিরামপুর (যশোর) :

বাদাম নেবেন , ভাই বাদাম নেবেন’- এভাবেই প্রতিদিনের সকালের শুরুটা হয় প্রতিবন্ধী শিশু জুবায়ার আল -মাহমুদের। বয়সটা চলে ১২ বছর। নিজ বাড়ি না থাকলেও বর্তমান বসবাস যশোরের মণিরামপুর উপজেলার সিমান্ত, সিরাজসিংহা গ্রামের নানীবাড়ির জরার্জীণ কুঠিরে। এক বছরের ছোট্ট একটা বোন সহ দুই বোন, দুই ভাই আর মা রহিমা বেগমকে নিয়ে তার বসবাস।নিজে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হলেও শিক্ষিত সমাজে নিরক্ষর হওয়াটা তার মোটেও ইচ্ছা নয়।তাই ক্লাস থ্রী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে ডহরসিংহা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কিছুটা বুঝতে শেখার পর মায়ের অভাবী সংসারের দুঃখ লাঘব করার জন্য সে স্কুল ব্যাগ ছেড়ে হাতে তুলে নিয়েছে বাদামের গামলা। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আর বাবার পাষবিক আচরণের কারণে উড়ন্ত বয়সে দুরন্তের সময় শিশু জুবায়ার কে হতে হয়েছে ভ্রাম্যমান বাদাম বিক্রেতা হিসাবে।

সময়ের ঘড়িতে সকাল সাড়ে ১০টা। মণিরামপুরের কুয়াদা স্কুল এন্ড কলেজের ছেলেমেয়েরা সবে ক্লাসে বসে স্যারদের ক্লাস মনোযোগ সহকারে শুনছে। ঠিক সেই সময়ে বাতাসের সাথে ভেসে আসছে শিশু জুবায়ারের চিৎকার, বাদাম লাগবে ভাই বাদাম,নেবেন স্যার বাদাম, নেন না স্যার! তবে সবাই যেন শুনেও শুনছেননা তার কথা। দীর্ঘক্ষন কথা হলো শিশু জুবায়ারের সাথে। দু’চোখ বেয়ে কান্নারত কন্ঠে শিশু জুবায়ার তার ছোট্ট এই জীবনের একটা করুন গল্প শোনালো। তার মা কাজ করতে পারেন না অসুস্থ প্রতিবন্ধী। ২/৩ কেজি বাদাম বাড়ি থেকে তার মা ভেজে দিলে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সেটা বেচে যা লাভ হয় তা দিয়ে মাছ জোটে না, কোনো মতে তরকারী আর ডাল হয়। আরো বললো আমি রাতে কোনোদিন খাইনে রাতি খালি আমাগের সবার খাওয়া হয় না।তাই মাঝে মাঝে যে অল্পদুটো ভাত থাকে সকালে পান্তাভাত আর ঝাল পিঁয়াজ দিয়ে মাখে খাইয়ে বাদাম নিয়ে বেরোই পড়ি। গেলো কুরবানি ঈদের দিনও শাক দিয়ে ভাত খাইছি।তবে আশপাশের বাড়ি থেকে অল্প এট্টু গোস্ত কুড়িয়ে এনে রাত্রি মা রান্না করিলো তাই খাইলাম। শুনে খুব কষ্ট পেলাম। সমাজের আর দশটা বাসা বাড়ীর মতো কোরমা, পোলাও, ফিরনি বা পায়েস খেয়ে আর নতুন জামা পরে ঈদ করতে পারেনি তার পরিবার। ঈদ কেটেছে নানী বাড়ীর রান্না করা সবজির তরকারী দিয়ে খেয়ে।

সে বললো আমার বাবা থেকেও যেনো নেই। আমার ছোটো ১বছরের বোন যখন মার পেটে তখন আমার বাবা চলে গিছিলো আজও ফেরেনি।শুনিছি আবার বিয়ে করে নড়াইলের ছাতিমতলার চাতালে কাজ করে।সেখানেও একটা মেয়ে হয়েছে। জুবায়ের জানায় , বাবা কখনো আমাদের খোঁজ খবর নেয়না। বেঁচে আছি না, মরে গেছি। এমনকি আমার এক বছরের ছোট্ট বোনটিরও খরব নেয়না বাবা। কোথাও থেকে সরকারী সাহায্য সহযোগিতা ও পাইনা। কোথাও হতে ত্রাণও পায়নি।বর্তমানে আমার বাদাম বেচা টাকাই একবেলা আধ বেলা খেয়ে না খেয়ে আমাদের দিন কাটছে। ২০০থেকে ২৫০ টাকা বাদাম বেচে লাভ হয়।

তাই দিয়ে ডাল তরকারি কিনে মায়ের হাতে গিয়ে তুলে দেই। মা রান্নাবান্না করে।আমার বড় বোন সুরাইয়া(১৫) মাদ্রাসায় পড়ে।বেতন নেয় না স্যারেরা।জুবায়ের কান্না জড়িত কন্ঠে বলে স্যার শুনিছি সরকার বাড়ি করে দেচ্ছে।আমাদের ৫ জনের অভাবী সংসার নেই কোনো জমি। আমাদের একটা সরকারী বাড়ির ব্যবস্থা করে দেবেন স্যার?

সরেজমিনে জুবায়ারের বাড়িতে গেলে দেখা যায় জীর্ন শীর্ন একটা টিনের বেড়ার ঘরের চাল। যেনো একটু জোরে ঝড় হলেই উল্টে যাবে।এই ঘরেই ৪ ছেলে মেয়ে নিয়ে বসবাস মা রহিমা বেগমের।কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন স্যার আমরা খুবই অসহায় আমাদের সরকারী ভাবে কোনো সাহায্য সহযোগিতা দেয় না। আমার এবং আমার প্রতিবন্ধী ছেলের কোনো কার্ড নেই। খুবই অসহায়, আমাদের জন্য কিছু করেন স্যার।আগে আমার ছেলে প্রতিবন্ধী জুবায়ের মানুষের দোকানে থাকতো তাতে প্রতিদিন ৩০/৪০টাকা করে দিত।কিন্তু বাদসাধে ওর অজ্ঞান হয়ে যাওয়া মানে ওর ফিটের রোগ ও আছে।হঠাৎ হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে যায়।ছেলের বয়স যখন ৩ মাস তখন থেকে ঐ রোগ, টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারিনি।তাই দোকানে কাজে পাঠাইনা। কিছুদিন যাবৎ বাদাম বেচে।কান্না জড়িত কন্ঠে তিনি আরো বলেন ওর বাদাম বেচা টাকা দিয়েই এক আধবেলা খেয়ে না খেয়ে আমাদের সংসার চলে।

জানতে চাইলে কুয়াদা স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো: ওয়াজেদ আলী বলেন, এই প্রতিবন্ধী দুস্ত শিশুদের জন্য অবশ্যই কিছু করা উচিত। প্রতিবন্ধী জুবায়ের আমার প্রতিষ্ঠানে ঘুরে ঘুরে বাদাম বেচে।খুশি হবো তার পরিবারের জন্য কিছু করতে পারলে।আমি জোর দাবী করছি তার মা এবং শিশুটি যেনো প্রতিবন্ধী ভাতা পাই।

জানতে চাইলে ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি মেম্বর জাহিদুল ইসলাম বলেন আমি ব্যাক্তি ভাবে জুবায়ারকে মাঝে মধ্যে সাহায্য সহযোগিতা করি। আর শিশু জুবায়ারকে প্রতিবন্ধী কার্ড করা সহ ওদের পরিবারের সার্বিক সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো।

এ ব্যাপারে যশোর জেলা সমাজ সেবার সহকারি পরিচালক ইতি সেন বলেন, যেহেতু শিশুটি প্রতিবন্ধী এখন অনলাইন জরিপ চলছে। সমাজ সেবা অফিসে পাঠালে তাকে একটা প্রতিবন্ধী কার্ড করে দেয়া যেতে পারে। আর শিশুটির মা যেহেতু স্বামী পরিতাক্তা। আর বয়স যেহেতু ৬০ হয়নি এবং নিজস্ব কোনো জায়গা জমি নেই।চেষ্ট করবো, দেখি ঐ দরিদ্র পরিবারের জন্য কিছু করতে পারি কিনা।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন