হোম জাতীয় নুর কি শেষ পর্যন্ত ইসরাইলের দ্বারস্থ?

জাতীয় ডেস্ক :

ইসরাইলের ক্ষমতাসীন দল লিকুদ পার্টির সদস্য মেন্দি সাফাদির সঙ্গে বৈঠক করার অভিযোগ উঠেছে গণঅধিকার পরিষদের সদস্যসচিব নুরুল হক নুরের বিরুদ্ধে। সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে এমন একটি ছবি পোস্ট করা হয়েছে। এছাড়া দেশের বাইরে গিয়ে উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়ায় নুরকে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনার দাবি করা হচ্ছে। তবে এ সবই ‘প্রপাগান্ডা’ দাবি করে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নুর।

সোমবার (২ জানুয়ারি) বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও আওয়ামী লীগের ওয়েব টিমের সমন্বয়ক তন্ময় আহমেদ নিজের ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘গত কিছুদিন যাবৎ নুরু কাতার ঘুরলো, এরপর দুবাই। হঠাৎ করেই কাতার বা দুবাই কেন? কারণ ফাঁস হয়েছে একটু আগে। এক ভাই ছবি পাঠিয়েছেন দুবাই থেকে, যা খুব সম্ভবত আজকে বা কালকে তোলা।’

সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) এই সমন্বয়ক বলেন, ‘বিএনপি নেতা আসলামের কথা মনে আছে, যে কি-না ইসরাইলের লিকুদ পার্টির নেতা মেন্দি সাফাদির সাথে ভারতে দেখা করেছিল এবং মোসাদ নাকি বিএনপিকে এদেশে ক্ষমতায় বসাবে!! তারপর অনেক ইতিহাস।’

তন্ময় লিখেছেন, ‘এখন আসি নুরু কেন খুব লাফাচ্ছে অনলাইনে লাইভে ও বক্তব্যে, কেনই-বা সে গণমিছিলের প্রোগ্রাম দিয়েও দেশে নাই? কারণ সিম্পল, ইসরাইলের মেন্দি এন সাফাদি তাকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। সামনে নেতানিয়াহুর সাথেও মিটিং ফিক্স হবে- এমনটাই বলেছে তার লোকজন।’

দেশে আলেম ওলামার জন্য কান্নাকাটি করে ক্ষমতায় আসতে ইসরাইলের শরণাপন্ন হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতা বলেন, ‘‘সে কোন লেভেলের টাউট তা নিজেরাই বিচার করে নিন। চরম সাম্প্রদায়িক বক্তৃতা দেয়া নুর স্রেফ পাবলিসিটির জন্য ‘ইসলাম ইসলাম’ করে। আসল বাস্তবতা সে ক্ষমতাসীন হতে চায়।’’

ডিসেম্বরের শেষভাগে কাতারে যান নুর। সেখান থেকে দুবাইয়ে গিয়ে কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে বৈঠক করেন। সম্প্রতি তিনি দুবাই থেকে সৌদি আরবে যান।

সময় সংবাদকে নুর বলেন, মেন্দি সাফাদির সঙ্গে তার যে ছবিটি ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছে, সেটি ফটোশপে এডিট করা। ইসরাইলের ওই নাগরিকের সঙ্গে তিনি এমন কোনো বৈঠক করেননি।

নুর দেশের বাইরে থাকায় হোয়াটসঅ্যাপে মঙ্গলবার (৩ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় কথা হয় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে।

এর আগে ভারত সফরে গিয়ে ইসরাইলের ক্ষমতাসীন লিকুদ পার্টির সদস্য মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বৈঠক করে গ্রেফতার হয়েছিলেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির তৎকালীন আহ্বায়ক আসলাম চৌধুরী। ইসরাইলের কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এজেন্ট মেন্দি সাফাদির সঙ্গে তার হাসিমুখে কয়েকটি ছবি গণমাধ্যমে ফাঁস হয়। সে সময় বিষয়টি তুমুল আলোচনার জন্ম দেয়।

মোসাদের সহায়তায় সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন আসলাম চৌধুরী। বিএনপি তখন তার পক্ষে দাঁড়ালেও পরে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আসলামের দায় বিএনপি নেবে না।’

নুরের ফেসবুক পোস্ট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দুবাই থেকে জেদ্দা যাওয়ার পথে তিনি গত ২৯ ডিসেম্বর বিমানবন্দরে নিজের ফেসবুক পেজ থেকে লাইভে এসে ভিডিও বার্তা দেন। ১৮ মিনিট ধরে চলা ওই ভিডিওতে সরকারের এমপি, মন্ত্রী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তোলেন নুর।

নিজের দুবাই ভ্রমণের কথা উল্লেখ করে নুর দাবি করেন, ‘এই সরকারের এমপি-মন্ত্রীরা দুবাইয়ে কালোটাকা ইনভেস্ট করে সেকেন্ড হোম তৈরি করেছে।’ একজন মন্ত্রীর নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তার কয়েক হাজার কোটি টাকা এখানে ইনভেস্ট রয়েছে।’

নুরের এসব অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপকমিটির সদস্য রাসেদুল ইসলাম রাসেল ফেসবুকে লিখেছেন, ‘দুবাইয়ে কোনো মানুষ বেড়াতে গিয়ে জায়গা-জমি কিনতে পারে না। যে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে নুর মিথ্যাচার ছড়াচ্ছেন, তিনি গত ১০ বছরে দুবাইয়ে অবস্থান করেননি। একবার মাত্র ৮ ঘণ্টা ট্রানজিট নিতে গিয়ে দুবাই এয়ারপোর্টে ছিলেন। অথচ নুর মিথ্যাচার ছড়াচ্ছেন, গুজব ছড়াচ্ছেন।’

তিনি বলেন, ‘কুলাঙ্গার নুরকে যেখানে পাওয়া যাবে, সেখানে তাকে প্রতিহত করা হবে। তার বিরুদ্ধে মামলা করে তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সময় সংবাদকে নুর বলেন, ‘দুবাইয়ে অনেক বাংলাদেশি ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। তবে বাংলাদেশ থেকে ওখানে যারা বিনিয়োগ করেন, তারা নিজের নামে সেটা করেন না। আমিরাতের স্থানীয় নাগরিকদের নামে কোম্পানি গড়ে তোলেন। বিনিময়ে তাদের প্রতিমাসে কিছু পয়সাপাতি দেয়া হয়।’

তার মতে, ‘কানাডায় বেগমপাড়ায় বাংলাদেশিদের বিনিয়োগের খবর ফলাও করে প্রচার হলেও দুবাইয়ের বিষয়টি এখনো প্রকাশ্যে আসেনি। দুবাই এখন অর্থপাচারের স্বর্গরাজ্য। আমি তথ্য দিলাম, সরকার এখন এ বিষয়ে তদন্ত করে দেখতে পারে। আমি সরকারকে সহায়তা করতে রাজি আছি।’

ডাকসু নির্বাচনের সময়ও তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়েছিল বলে অভিযোগ করেন গণঅধিকার পরিষদের এই সদস্যসচিব।

বাংলাদেশ থেকে ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করে দুবাইয়ে পালিয়ে থাকা এক বিতর্কিত ব্যবসায়ীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন বলেও অভিযোগ করা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে। সামাজিকমাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তি বলছেন, ওই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে এক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়েছেন তিনি।

তারা বলছেন, বিদেশ ঘুরে নুর ফান্ড সংগ্রহের নামে প্রবাসীদের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এ বিষয়েও ভিডিওতে নুরকে বলতে শোনা যায়, ‘আরে ভাই… এই দেশে এসেছি, ফান্ড অবশ্যই সংগ্রহ করব। লুকোচুরির কিছু নাই। স্পষ্ট বলছি, ফান্ড কালেক্ট করছি। কাকে হিসেব দেব, কাকে দেব না এটা আমাদের বিষয়।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নুর বলেন, কারও টাকা হাতিয়ে নিয়েছি, এমন দু-একজনের নাম অন্তত বলেন।

বিদেশে বসে পোস্ট করা ভিডিওতে নুরকে দেশে থাকা লোকজনকে সরকার পতনের জন্য আন্দোলনে নামার অনুরোধ করে বলতে শোনা যায়—‘আমি কাতার ছিলাম, এখন দুবাই। আরও কয়েকটি দেশে যাওয়ার চেষ্টা করব। আমার একার জন্য তো সবকিছু থেমে থাকে না। আমি যতদিন দেশে ছিলাম, আন্দোলন-সংগ্রামে কখনই পিছু হটিনি। হামলা মামলা উপেক্ষা করেও আন্দোলন চালিয়ে গেছি। এখন যারা দেশে আছে, তারা করবে। দেশের বাইরে থাকলেও মনটা পড়ে আছে দেশে।’

নুর এমন এক সময়ে এসব বক্তব্য দিচ্ছেন, যখন ফের সহিংস হয়ে উঠছে জামায়াতে ইসলামী। আর যুদ্ধাপরাধী দলটির সঙ্গে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে নেমেছে বিএনপিসহ সমমনারা।

নুরের বিরুদ্ধে প্রবাসীরাও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। রাঙ্গুনিয়া উপজেলা আওয়ামী যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইউনুচ বলেন, নুর আরব আমিরাত ও কাতারে গিয়ে চাঁদাবাজি করেছে। সে দুবাইয়ে গিয়ে যে মিথ্যাচার ছড়াচ্ছে, তার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। নুর চট্টগ্রামে পা রাখতে পারবে না বলেও তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।

নুরকে আইনের আওতায় এনে বিচারের দাবি জানিয়েছেন যুবলীগের এই নেতা।

ডাকসুর ভিপি থাকাকালে নুরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করা হয়েছিল। তখন তার পদত্যাগ চেয়েছিলেন ডাকসুর ২৩ সদস্য। ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর ডাকসুর সভাকক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে নুরের পদত্যাগের দাবি জানান তারা।

নুরুল হকের ‘টেন্ডারবাজি, তদবির-বাণিজ্য ও অনৈতিক অর্থ লেনদেনের’ প্রতিবাদে নিন্দাজ্ঞাপন, ভিপি পদ থেকে নুরুলকে পদত্যাগের আহ্বান ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বক্তব্য জানাতে ওই সংবাদ সম্মেলন করা হয়।

তখন ডাকসুর জিএস গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘ডাকসুর সর্বোচ্চ পদ যেটি, ভিপি পদ, নুরুল হক সেটিকে স্পষ্টভাবেই বিতর্কিত ও কলঙ্কিত করেছেন। আমরা তার প্রমাণও পেয়েছি—তার অডিও ফোনালাপ, ভাইরাল হওয়া ভিডিও। আমরা ডাকসু পরিবার এই অপকর্মের দায়ভার নিতে রাজি নই।’

এ সময় নুরের একটি ভিডিও সাংবাদিকদের দেখান গোলাম রাব্বানী। সেখানে ডাকসুর সদস্য তিলোত্তমা শিকদারকে নুরুল বলছেন, ‘ডাকসু ভিপির জন্য মাত্র ১৩ কোটি টাকা কোনো বিষয় নয়। কত ১৩ কোটি টাকা আসবে-যাবে!’

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন