আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
আগামী বছরের শুরুতেই বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচন সামনে রেখে আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। রাজধানী ঢাকার রাস্তায় ফিরে এসেছে সহিংসতা।
আন্দোলন-বিক্ষোভের নামে জ্বালাও-পোড়াও চালাচ্ছে বিরোধী দল বিএনপি-জামায়াত। বাসে আগুন দেয়া হচ্ছে। এখানে-ওখানে ককটেল বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হচ্ছে। সংঘর্ষ হচ্ছে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে।
এসব সহিংসতার ছবি দেখে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আরও অনেকের মতো ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছেন পূর্ণিমা রানী শীল (৩৪)। যাকে ২০০১ সালে শুধুমাত্র সংখ্যালঘু বা হিন্দু হওয়ার ‘অপরাধে’ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে দলবেঁধে ধর্ষণ করেছিল বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডাররা।
নির্বাচন সামনে রেখে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করতে ‘এক দফা-এক দাবি’ নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি।
গত ২৯ জুলাই ঢাকায় প্রথম বড় বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেয় দলটি। কিন্তু সেই বিক্ষোভও যথারীতি সহিংস হয়ে ওঠে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, ওইদিন বিএনপির নেতাকর্মীরা রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক বন্ধ করে দেয়।
পুলিশ সেগুলো যান চলাচলের জন্য মুক্ত করার চেষ্টা করতে গেলে তাদের ওপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে শুরু করে তারা। তাদের গাড়ি ভাংচুর করে। তারা বেশ কয়েকটি বাসে আগুন দেয়। এমনকি ককটেল বোমার বিস্ফোরণও ঘটায়।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে দ্য প্রিন্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে পূর্ণিমা রানী শীল বলেন, নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, তার ভয় ততই বাড়ছে। তিনি বলেন, সরকার পরিবর্তন হলেই অতীতের সেই বিভীষিকা ফিরে আসতে পারে।
তিনি বলেন, যে বিভীষিকা তিনি নিজের চোখে দেখেছিলেন, আজ ২২ বছর পরও তা থেকে পুরোপুরি বের হয়ে আসতে পারেননি তিনি। বিএনপি-জামায়াতের চলমান সহিংসতার ছবি তাকে তার সেই পুরানো স্মৃতিই মনে করিয়ে দিচ্ছে।
পূর্ণিমা রানী শীল বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত আবারও যদি বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসে, ২০০১ সালের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি হতে পারে। আমাদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকবে না।’
গত ২৯ জুলাই সহিংসতার কিছু আগেই বিএনপির পলাতক নেতা তারেক রহমান তার দলের উদ্দেশে বলেন, ‘দেশের ভাগ্য রাজপথেই ঠিক হবে।’ তারেক রহমানের এই বক্তব্যের ব্যাপারে পূর্ণিমা রাণী শীল বলেন, ‘গণতন্ত্রের চর্চা রাজপথে হয় না। সেটা হয় অরাজকতা। তারেক রহমান সেটা জানেন না।’
পূর্ণিমা রানী শীলের সঙ্গে যা ঘটেছিল
২০০১ সালের ঘটনা, অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সবে শেষ হয়েছে। ভোটে জিতে ক্ষমতায় এসেছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। গদিতে বসতে দেরী, আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ওপর অত্যাচারের স্টীম রোলার চালাতে দেরী হয়নি দলটির ক্যাডারদের।
আর সেই নৃশংস অত্যাচারের শিকার সবচেয়ে বেশী হয়েছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা। ধরে নেয়া হয় যে হিন্দু বা সংখ্যালঘু ভোটাররা আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক। এ কারণেই তাদের ওপর ক্ষোভটা বেশী ঝেড়েছিল দলটির নেতাকর্মীদের অনেকে।
সেই সময় মাত্র ১২ বছর বয়সি কিশোরী পূর্ণিমা রানী শীলকে গণধর্ষণ করা হয়। দ্য প্রিন্টকে সেদিনের সেই দুর্বিসহ ঘটনা ও পরবর্তী তিক্ত অভিজ্ঞতা জানিয়ে পূর্ণিমা বলেন, ‘আমি ছিলাম নিতান্তই এক নিরীহ কিশোরী। তারা আমাকে গণধর্ষণ করে আমার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছে। আমার এ ঘটনা তখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও শিরোনাম হয়েছিল। কিন্তু এমন বিভীষিকার মধ্যদিয়ে গেলেও কেউই তখন আমার পাশে এসে দাঁড়ায়নি।’
গণধর্ষণের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘আমার বয়স মাত্র ১২ বছর। ওই বয়সেই আমি নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ জেলার পূর্ব দেলুয়ায় আওয়ামী লীগের পোলিং এজেন্ট হয়েছিলাম। নির্বাচনকালে বিএনপি কর্মীদের কারচুপির প্রতিবাদ করেছিলাম। নির্বাচনের ফলাফল বের হওয়ার পর ২০০১ সালের ৮ অক্টোবর ৩০-৪০ জনের একটি দল আমাদের বাড়িতে হামলা চালায়।’
‘তারা আমার কাপড় ছিড়ে ফেলে এবং গামছা দিয়ে আমার মুখ বেঁধে ফেলে। আমি তাদের কণ্ঠ চিনতে পারছিলাম। টর্চের আলোয় তাদের মুখও দেখতে পাচ্ছিলাম। তারা আমাকে বাড়ির কাছেই একটি মাঠে নিয়ে যায় এবং একে একে ধর্ষণ করে। অজ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত এটা চলতেই থাকে।’
পূর্ণিমা আরও জানান, সেদিনের হামলায় তার এক বোন দৃষ্টি হারান। তার বাবার সেলুনের দোকান লুট করা হয়। তার পরিবার গ্রাম ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। ওই ঘটনার পর পূর্ণিমা ঢাকায় চলে আসেন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এরপর তিনি আর কখনই তার গ্রামে ফিরে যেতে পারেননি।
গণধর্ষণের বিচার পেতেও পূর্ণিমাকে অনেক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরই সেই বিচার শুরু হয়। এরপর ২০১১ সালের ৪ মে সতেরো আসামির মধ্যে এগারো জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। সেই সঙ্গে প্রত্যেককে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। আসামিদের ছয়জন কারা ভোগ করছে। বাকি পাঁচজন এখনও পলাতক।
পূর্ণিমা বলেন, ‘ওই পাঁচজনকে আর কখনই গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। আমাকে ধর্ষণের পরই তারা গাঁ ঢাকা দিয়েছিল। কারাদণ্ড পাওয়া আসামিরা আদালতে ক্ষমাপ্রার্থনা করে আবেদন করেছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘তাদের বন্ধু ও আত্মীয়-স্বজন অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন করে এখনও হুমকি-ধমকি দেয়। তারা বলে, সরকারের পরিবর্তন হলে আমাকে আবারও ধর্ষণ করবে।’ পূর্ণিমা আরও বলেন, ‘আমার নাম ব্যবহার করে সেক্স ভিডিও ছড়িয়ে দেয়া হয়। এখন আবার নির্বাচন সামনে করে আবারও রাজনৈতিক সহিংসতা শুরু হয়েছে। এসব দেখে আমার ভয়ও ক্রমেই বাড়ছে।’
২০০১ সালের সহিংসতা
শুধু পূর্ণিমা রানী শীল নন, ২০০১ সালের নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতায় আক্রান্ত হয়েছিলেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকেই। যেমনটা বলছিলেন বাংলাদেশের বৃহত্তম সংখ্যালঘু বিষয়ক সংগঠন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত।
দ্য প্রিন্টকে তিনি বলেন, সেই সময় লুট, ধর্ষণ, ধর্মীয় উপাসনালয়ে জ্বালিয়ে দেয়া ও সংখ্যালঘু নেতা হত্যার প্রায় ২৮ হাজার ঘটনা রিপোর্ট হয়েছিল। বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা এসব সহিংসতায় জড়িত ছিল। যাদের অনেকেই পরবর্তীতে মন্ত্রীও হয়েছিল।’