অনলাইন ডেস্ক:
২০২৪ সালের দাখিল (এসএসসি) পরীক্ষার্থী সামিয়া আক্তার তুলি। রোববার (১১ ফেব্রুয়ারি) মাদ্রাসা থেকে দেওয়া হবে রেজিস্ট্রেশন কার্ড। আর সেই কার্ড এনে দিতে চেয়েছিলেন একমাত্র বড় ভাই সাব্বির মোড়ল। তবে সড়ক দুর্ঘটনায় শনিবার প্রাণ হারিয়েছেন তিনি। ভাইকে হারিয়ে দিশেহারা তুলি। বললেন, ভাইয়া বলেছিল রেজিস্ট্রেশন কার্ড এনে দিবে। কিন্তু ভাইয়া আজ আর নেই!
সাব্বিরের বাবা হান্নান মোড়ল। তিনিও সন্তানকে হারিয়ে পাগল প্রায়। বলেন, আমার সন্তান আমাদের সবকিছুই ছিল। পরিবারের জন্য তার অনেক চিন্তা ছিল। কখনও নামাজ কাজা করতো না। দাড়ি রাখতো। আমি দাড়ি না রাখায় আমাকে বকাবকি করতো। নামাজ পড়ার জন্য বলতো। বলতো কী নামে যাবা পরকালে। এখন আমি কীভাবে বাঁচব? এই ছেলেকে ছাড়া আমি কী করবে বাঁচবো। ওর বোনের পরীক্ষার জন্য আজ (১১ ফেব্রুয়ারি) রেজিষ্ট্রেশন কার্ড দেয়ার কথা। ও বলছিল আমি এনে দিব। পাঁচশো টাকাও দিতে চেয়েছিল। কিন্তু কী হয়ে গেল?
পরিবারের বড় সন্তান, একমাত্র পুত্র। তাকে ঘিরেই বড় স্বপ্ন ছিল বাবা-মা আর ছোট্ট বোনের। বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণে পরিবারের হাল ধরতে শুরু করেছিলেন মাত্র। ডিপ্লোমা প্রকৌশলী পাশ করে অনলাইন আউটসোর্সিং করে গ্রামে বসেই আয় শুরু করেছিলেন। কিন্তু এক দুর্ঘটনায় সাব্বিরের পরিবারের সব স্বপ্ন ধুলোয় মিশে গেল। অথচ দুর্ঘটনার শিকার ওই ইজিবাইকে ওঠারই কথা ছিল না তার। বাহনটিতে যাত্রী পূর্ণ থাকলেও পরিচিত চালক হওয়ায় তার পাশে বসেছিলেন সাব্বির। শনিবার দুপুরে ডুমুরিয়া উপজেলায় ট্রাকের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে অন্য চারজনের সঙ্গে মারা যান সাব্বির মোড়ল (২৬)।
খুলনার ডুমুরিয়ার আঙ্গারদোহা গ্রামের হান্নান মোড়লের ছেলে সাব্বির মোড়ল। বাবা হান্নান মোড়ল স্থানীয় একটি মাদ্রাসার শিক্ষক। সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়তে কখনো পিছপা হননি তিনি। তাই সন্তানের এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না।
শনিবার বিকেলে বাড়ির পাশে চাচা বাড়িতে চলছিল স্থানীয় নারীদের ইসলামিক আলোচনা (তালিম)। সেজন্য মুড়ি আর জিলাপি (তবারক) কিনতে স্থানীয় খর্নিয়া বাজারে গিয়েছিলেন সাব্বির মোড়ল। কেনাকাটা শেষে বাড়ির ফিরতে ওঠেন ইজিবাইকে। পথিমধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার কবলে সড়কেই প্রাণ হারান তিনি। সন্তানের এমন প্রাণহানি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না পরিবার। রোববার সকালে বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাবা-মা আর স্বজনদের আহাজারিতে এলাকা জুড়ে চলছে শোকের আবহ।
শনিবার দুপুরে বাসায় ভাত খাচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ এক প্রতিবেশী এসে দরজায় কড়া নাড়েন। শার্ট পরে দ্রুত বাইরে আসতে বলেন। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ি থেকে বের হয়ে সড়কের দিকে ছুটে যান। সেখানে গিয়ে দেখতে পান সন্তানের নিথর দেহ পড়ে আছে খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কে। অপ্রত্যাশিত এমন ঘটনায় বাকরুদ্ধ হান্নান মোড়ল একদিন পার হলেও স্বাভাবিক হতে পারেননি। সন্তানের কথা মনে করলেই কেঁদে ওঠেন।
বাবা মাঝে মধ্যেই চিৎকার করে কেঁদে উঠলেও মা হারিয়েছেন কান্না শক্তিও। বার মুর্ছা যাচ্ছিলেন। আর নির্বাক হয়ে বাড়িতে আসা স্বজনদের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছিলেন না। সাব্বিরের ফুফাতো ভাই সেলিম খানও শোকে কথা বলতে পারছে না। স্থানীয় প্রতিবেশীরা আসছেন সান্ত্বনা দিতে।
দুর্ঘটনার পর সাব্বিরের বাড়িতে যান খুলনা বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ। পরিবারকে সান্ত্বনা দেয়ার পাশাপাশি সরকারের দেয়া আর্থিক অনুদান পৌঁছে দেয়ার জন্য ফর্ম দিয়ে আসেন তারা।
এ সময় বিআরটিএ খুলনা বিভাগীয় পরিচালক মো. মাসুদ আলম বলেন, ‘কারও মৃত্যুই আমাদের কাম্য নয়। তবে কেউ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে সরকারের পক্ষ থেকে পাঁচ লাখ টাকা দেয়ার বিধান আছে। সেটা দেয়ার জন্যই আমরা এসেছিলাম। এটা আসলে ক্ষতিপূরণ হতে পারে না। তবু যদি কোনো কাজে আসে।’
ডুমুরিয়া সড়কটিতে প্রায়ই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। সড়কটিতে থ্রি-হুইলারসহ নিষিদ্ধ যান চলাচল দুর্ঘটনার কারণ বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা।
মাসুদ আলম বলেন, এসব সড়কে অবৈধ যান চলাচল বন্ধে আমাদের নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হয়। আমরা এ অভিযান আরও জোরদার করব। মহাসড়কে অবৈধ যান চলাচল বন্ধে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন করেন স্থানীয়রা।
খর্নিয়া হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ হামিদ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘আমরা এ সড়কে অবৈধ যান চলাচল বন্ধে অভিযান চালাই। তবে আমাদের জনবল সংকট রয়েছে। এ কারণে এত বড় এলাকায় আমাদের অভিযান চালাতে সমস্যা হয়। আমাদের যদি আরও লোকবল থাকতো অভিযান আরও বাড়ানো যেতো।’
খুলনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ইলেকট্রিক্যাল ডিপার্টমেন্ট থেকে ২০১৮ সালে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। এরপর পড়াশোনার পাশাপাশি অনলাইনে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের ফ্রিল্যান্সিং কাজ করতেন।