হোম জাতীয় ‘তামাকের প্রচণ্ড ধোঁয়া আর গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে’

জাতীয় ডেস্ক :

‘তামাক পোড়ানোর ঘরে যখন আগুন দেয় তখন আমরা কেউ ঘরে থাকতে পারি না। প্রচণ্ড ধোঁয়া আর তামাকের গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে। দিনের বেলায় বাড়িতে থাকা কঠিন আবার রাতের বেলায় ঘুমাতে পারি না। ওদের বললেও ওরা কোনো কথা শোনে না। একেবারে আবাসিক এলাকার মধ্যে তামাক পোড়ানোর ঘর। এর মধ্যে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। নিরুপায় হয়ে পরিবেশ অধিদফতরসহ বিভিন্ন দফতরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।’

শুক্রবার (২২ এপ্রিল) সময় নিউজকে এ কথাগুলো বলছিলেন ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার পরমেশ্বরদী গ্রামের ফকিরপাড়ার মো. সুরুজ আকন।

সুরুজের স্ত্রী বলেন, ‘ধোঁয়ায় বাড়িঘর অন্ধকার হয়ে যায়। বাড়িতে থাকতে না পেরে আমার শাশুড়ি কুলসুম বেগম (৮০) অন্য বাড়িতে গিয়ে থাকেন। আমার মেয়েটার বাচ্চা হবে, তাকে এখানে এনে রেখেছিলাম, কিন্তু সে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে আবারও শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি।’

ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে হঠাৎ করে বেড়ে গেছে তামাকের চাষ। উপজেলার চতুল, পরমেশ্বরদী এবং রূপাপাত ইউনিয়নে সর্বাধিক তামাকের চাষ হয়ে থাকে। একইভাবে অন্যান্য ইউনিয়নেও রয়েছে তামাকের চাষ।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, উপজেলার প্রায় ৪০ পাকি জমিতে তামাক চাষ হয়। তবে বাস্তবে এর পরিমাণ আরও বেশি হবে বলে ধারণা স্থানীয়দের।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিলেন যে ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করা হবে। সেখানে দিনে দিনে তামাকের চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর লক্ষ্যমাত্রা হুমকির মুখে।

তামাক কোম্পানিগুলো নানা প্রলোভনে সাধারণ মানুষকে তামাক চাষে প্রলুব্ধ করছে। আর কোনো ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়াই মানুষ কাজ করছে তামাক চাষ থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াকরণ পর্যন্ত। কোনো কাগজপত্র ছাড়াই আবাসিক এলাকায় চলছে তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণ। তামাক প্রক্রিয়াকরণের ফলে অসুস্থ হচ্ছে মানুষজন। দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে সাধারণ মানুষ।

এ জন্য আবাসিক এলাকায় বিষাক্ত তামাক প্রক্রিয়াকরণ বন্ধ করার জন্য গত ৩০ মার্চ পরিবেশ অধিদফতরসহ বিভিন্ন জায়গায় লিখিত আবেদন করেছেন পরমেশ্বরদী গ্রামের ফকিরপাড়ার মো. সুরুজ আকন।

সরেজমিন পরমেশ্বরদীর ফকিরপাড়ায় দেখা যায়, সুরুজ আকনের ঘরের পাশেই কাঁচা তামাক পাতা প্রক্রিয়াকরণের (পোড়ানোর) একটি ঘর বানিয়েছে আশরাফ ফকিরের ছেলে শাহানুর ফকির। এ ঘরকে টোব্যাকো বার্ন হাউজ বা রকেট বার্ন বলা হয়। বাইরে থেকে সেখানে আগুন দিচ্ছেন শাহানুর ফকিরের মেয়ে আছমা বেগম। ঘর সমান উঁচু একটি পাইপ দিয়ে ধোঁয়া উঠে ছড়িয়ে পড়ছে আবাসিক এলাকায়। শাহানুরের বাড়ির পাশে রয়েছে আরও একটি তামাক পোড়ানোর ঘর।

শাহানুর ফকির বলেন, ‘আরও আগে থেকে চতুল ইউনিয়নের হাসামদিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় তামাক চাষ হয়ে আসছে। সেখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে না, সব সমস্যা আমাদের এখানে?’

তিনি আরও জানান, দুই বছর ধরে তারা তামাক চাষ শুরু করেছেন। তার মেয়ে আছমার বিয়ে দিয়েছেন কুষ্টিয়ায়। সেই জামাই তাদের তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করেছেন। শাহানুর ফকির এবার চার একরের বেশি জমিতে তামাক চাষ করেছেন।

শাহানুরের জামাই কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার রিফায়েতপুর গ্রামের গিয়াসউদ্দীনের ছেলে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা এলাকায় তামাক চাষ করেই চলি। বেশি অর্থের আশায় এখানেও তামাক চাষ শুরু করেছি। পরমেশ্বরদী মাঠে ৭ পাকি জমিতে তামাক চাষ করছি। একটি টোব্যাকো কোম্পানির ফিল্ডম্যান জুয়েল রানার মাধ্যমে চুক্তি করে তামাক চাষ করা হয়। কোম্পানি অগ্রিম টাকা দেয়, সার দেয়, তামাক পোড়ানোর ঘর করার জন্য টাকা দেয়। তামাক শুকিয়ে প্রক্রিয়া করার পর তারা বাড়িতে এসে তামাক কিনে নিয়ে যায়। প্রতি কেজি তামাকের মূল্য ধরা হয় ১৬৭ টাকা। তামাক কেনার সময় আগের দেওয়া সব অর্থ অ্যাডজাস্ট করা হয়।’

তামাক পোড়ানোর জন্য পরিবেশ অধিদফতর বা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কোনো অনুমোদন আছে কি না–জানতে চাইলে বলেন, কোনো অনুমোদন নেই। কোনো ট্রেড লাইসেন্সও নেই।

গ্রামের বাসিন্দা কালাম আকন বলেন, ‘একটু সমস্যা আছে, কিন্তু টাকা পাওয়া যায় বেশি। আমি শুধু তামাক চাষের জন্য ৭ পাকি জমি বর্গা দিয়েছি। প্রতি পাকি দশ হাজার টাকা করে। তামাক উঠে গেলে আবার অন্য ফসল বুনব।’

শাহানুরের স্ত্রী রিনা বেগম বলেন, ‘ধোঁয়া, গন্ধে আমাদের কিছুই হয় না। অন্য এলাকায় তামাক চাষ আছে, সেখানে কেউ তো অসুস্থ হয়নি।’

এ ব্যাপারে ব্রিটিশ আমেরিকা টোব্যাকো কোম্পানির ফিল্ড টেকনিশিয়ান মো. জুয়েল রানা বলেন, তামাক চাষের জন্য চাষিদের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। তাদের ক্যাশ সাপোর্টসহ সার ও কীটনাশক দেওয়া হয়। বার্ন হাউজ বানানোর জন্য নগদ ৮ হাজার টাকা দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, ধোঁয়া ওঠার চিমনি উঁচু হলে কোনো সমস্যা হয় না। তবে শাহানুরের ঘরের চিমনিটা একটু ছোট হয়েছে।

বোয়ালমারী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ প্রীতম কুমার হোড় বলেন, ‘তামাক চাষে সরকারের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তারপরও আমরা তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করে থাকি। সম্প্রতি বোয়ালমারীতে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে তামাক চাষ। আমাদের হিসাবমতে, বর্তমানে উপজেলায় প্রায় ৪০ পাকি জমিতে তামাক চাষ হয়। তামাক চাষের ফলে রবিশস্য যেমন: রাই, সরিষা, মসুর, ছোলা ইত্যাদি চাষ কমে যাচ্ছে। এ রকম হলে মানুষের পুষ্টির সমস্যা দেখা দেবে।’

বোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. খালেদুর রহমান বলেন, তামাক একটি বিষাক্ত জিনিস, যা মাদক হিসেবে চিহ্নিত। তামাক চাষ থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াকরণ এবং প্রক্রিয়াকরণ এলাকার আশপাশের লোকজন শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে পারে। সিগারেটের যে ক্ষতি, তামাকেও সেই একই ক্ষতি। এর থেকে দীর্ঘমেয়াদি অ্যাজমা, ক্যানসারসহ অনেক রোগ হতে পারে। ফুসফুস নষ্ট হতে পারে। অতি দ্রুত আবাসিক এলাকায় তামাক প্রক্রিয়াকরণ কাজ বন্ধ করা এবং তামাক চাষ বন্ধ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম বলেন, আবাসিক এলাকায় এভাবে তামাক পোড়ালে তো পরিবেশের সমস্যা। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি পরিবেশ অধিদফতরকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান।

 

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন