বাণিজ্য ডেস্ক:
বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া পাটপণ্যে ভারত অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপের পর থেকে দেশটিতে বাংলাদেশের পাটপণ্যের রফতানি ব্যাপক হারে কমে গেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের পাটকলসহ পুরো খাত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিগগিরই ভারত অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক তুলে না নিলে চরম ক্ষতির মুখে পড়বে দেশের পাট রফতানি।
উৎপাদন মূল্যের তুলনায় কম দামে বাংলাদেশের পাটপণ্য ভারতে রফতানি হচ্ছে- ভারতীয় উৎপাদনকারীদের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি পাঁচ বছরের জন্য অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করে ভারত সরকার। এরপর ২০২৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের পাটজাত পণ্যে আরোপিত অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কের মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বাড়ানোর ঘোষণা দেয়।
এক বিজ্ঞপ্তিতে দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয় জানায়, নতুন নীতিমালা অনুযায়ী বাংলাদেশের উৎপাদকদের পাটপণ্য রফতানিতে ভিন্ন ভিন্ন হারে শুল্ক প্রযোজ্য হবে। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের তারিখ থেকে পাঁচ বছর মেয়াদে (যদি না এ সময়ের আগে তা প্রত্যাহার, বাতিল বা সংশোধন করা হয়) কার্যকর হবে এ শুল্ক, যা ভারতীয় মুদ্রায় পরিশোধ করতে হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে প্রতি টন পাটপণ্য আমদানিতে ভারতের ব্যবসায়ীদের শুল্ক দিতে হয়ে ১৯ থেকে ৩৫২ ডলার পর্যন্ত। এতে কমছে বাংলাদেশ থেকে পাট আমদানি। বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএ) তথ্য বলছে, বাংলাদেশের পাটপণ্যের মোট রফতানির ৬০ শতাংশ যায় ভারতে। তবে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপের পর থেকে দেশটিতে বাংলাদেশের পাটপণ্যের রফতানি ব্যাপকহারে কমতে থাকে। অ্যান্টি-ডাম্পিং কার্যকর হওয়ার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালে মোট ১ লাখ ৪২ হাজার টন পাটপণ্য রফতানি হয় ভারতে। পরের বছর তা ৮০ হাজার টনে নেমে আসে। এরপর তা আরও কমে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে পাটখাত থেকে ১১২ কোটি ৭৬ লাখ ডলার রফতানি আয়ের পর ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসেছে ৯১ কোটি ২২ লাখ ডলার। অর্থাৎ এক বছরে আয় কমেছে ২১ কোটি ডলার।
রফতানিতে নেতিবাচক ধারা অব্যাহত আছে চলতি অর্থবছরেও। জুলাই থেকে এপ্রিল– এ দশ মাসে ৮৩ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের পাট ও পাটপণ্য রফতানি লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয়েছে ৭১ কোটি ৬৪ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ কম।
এদিকে, গত দশ মাসে ১৯ কোটি ৭৩ লাখ ডলার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে কাঁচাপাট রফতানি আয় হয়েছে ১২ কোটি ৭০ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ কম। পাটের সুতায় ৪ দশমিক ২০ শতাংশ, আর ব্যাগ ও বস্তা থেকে আয় কমেছে ১৬ দশমিক ১৭ শতাংশ।
নাজুক এ পরিস্থিতিতে পাট রফতানি বাড়াতে বার বার অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক তুলে নেয়ার দাবি জানানো বাংলাদেশ আরও একবার ভারতের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে এ শুল্ক তুলে নেয়ার। মঙ্গলবার (১৪ মে) সচিবালয়ে নিজ দফতরে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে পাটপণ্যে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক তুলে নিতে দেশটির প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক।
সাক্ষাৎ শেষে তিনি বলেন, ‘ভারতের নির্বাচনের পরে দুদেশের সরকারের মধ্যে আলোচনা হবে। আমরা আশা করছি, ভালো ফল আসবে।’
মন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ পাটবীজ ভারত থেকে আমদানি করি। এ জন্য আমরা বলেছি, আমাদের মানসম্পন্ন পাটবীজ দিতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই পাটবীজ দিতে হবে। কোনোক্রমেই যেন বিলম্বিত না হয়। সে বিষয়ে নজর রাখার জন্য ভারতকে অনুরোধ করেছি। এ বিষয়ে তাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা চেয়েছি।’
এ বিষয়ে পাট খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, গত কয়েকবছর ধরেই সরকার পাটপণ্যে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক তুলে নিতে ভারতের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে আসছে। কিন্তু মিলছে না কোনো সমাধান। তাই যত দ্রুত সম্ভব এ বিষয়ে আরও বেশি উদ্যোগী হতে হবে। নইলে ধীরে ধীরে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের পাট খাত।
বাংলাদেশ বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদক ও রফতানিকারক সমিতির সভাপতি মো. রাশেদুল করিম মুন্না বলেন,
ভারত অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপের পর থেকেই দেশটিতে কমছে পাটপণ্যের রফতানি। এতে একদিকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পাটকলগুলো, অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পাটসংশ্লিষ্ট হস্তশিল্পগুলো। এর কারণে দেশের ৪০-৫০ শতাংশ পাটের ব্যাগ তৈরির কাজ কমে গেছে। যা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে পুরো খাতকে।
অ্যান্টি-ডাম্পিংয়ের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পণ্য সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অ্যান্টি-ডাম্পিংয়ের কারণে ভারতে দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানই পাটপণ্য রফতানি করতে পারছে না। শুল্ক আরোপের ফলে বেশি দাম দিয়ে পণ্য আমদানি করলে ক্ষতির মুখে পড়বে প্রতিষ্ঠানগুলো। তাই ভারতের প্রতিষ্ঠানগুলো নিজের দেশের পণ্যের প্রতিই বেশি ঝুঁকছে। তবে বাংলাদেশ থেকে তাদের এই মুখ ফিরিয়ে নেয়া বিদেশি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাছে নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। তারা মনে করছে, বাংলাদেশের পাটকলগুলো পণ্যের দাম নিয়ে নয়-ছয় করছে। ফলে বিশ্ববাজারেও কমছে দেশের পাট রফতানি।
দেশের পাট খাতকে টিকিয়ে রাখতে যত দ্রুত সম্ভব অ্যান্টি-ডাম্পিং বন্ধ করতে হবে বলেও মনে করেন রাশেদুল করিম। তিনি বলেন, ‘দেশে আধুনিক পাটকল স্থাপন করতে হবে; না হলে বিশ্ববাজারে দেশীয় পাটপণ্যের প্রসার ঘটানো যাবে না। পাশাপাশি ভারত সরকারকে অনুরোধ জানানোর সঙ্গে সঙ্গে আইনি প্রক্রিয়ায়ও যেতে পারে বাংলাদেশ। তবে সেটি অনেক লম্বা প্রসেস। তাই আলোচনার মাধ্যমেই দ্রুত এটি সমাধান করতে হবে।’
বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল করিম বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই অ্যান্টি-ডাম্পিং নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু এর কোনো কার্যকরী সমাধান হচ্ছে না। আসলে ভারত নিজের দেশের পাটপণ্যকে গুরুত্ব দিয়ে এটি করেছে। একটি দেশ নিজের দেশের পণ্যকে বেশি গুরুত্ব দেবে এটিই স্বাভাবিক।
তবে এতে বাংলাদেশের পাট খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, অ্যান্টি-ডাম্পিংয়ের কারণে বাংলাদেশ থেকে পাট বা পাটপণ্য আমদানি করলে বাড়তি শুল্ক দিতে হয় ভারতের ব্যবসায়ীদের। বাড়তি শুল্ক থেকে বাঁচতেই তারা নিজেদের দেশের পণ্যের প্রতি ঝুঁকছেন।
পাটপণ্যের রফতানি বাড়াতে নতুন বাজার ধরার আহ্বান জানিয়ে রেজাউল করিম বলেন, ভারতের বাজারে বাংলাদেশের পাটের চাহিদা খুব একটা বেশিও নয়। এছাড়া অ্যান্টি-ডাম্পিং কবে বন্ধ হবে তার ঠিক নেই। তাই পাট শিল্পের সমৃদ্ধির স্বার্থে বিকল্প বাজার ধরতে হবে। কারণ ইউরোপ ও আমেরিকায় বাড়ছে পাটের ব্যাগ, জুট ডেনিম, জুয়েলারি, ম্যাটসসহ বহুমুখী পাটপণ্যের চাহিদা।
তিনি আরও বলেন, ভারত আইন মেনেই অ্যান্টি-ডাম্পিং চালু করেছে। গায়ের জোরে করেনি। তাই এটি বন্ধ করতে ভারতকে অনুরোধ জানানোর বিকল্প নেই। পাশাপাশি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় এটি বন্ধে আইন মেনেই আবেদন জানানো যেতে পারে।
অ্যান্টি-ডাম্পিং কী?
দেশীয় কোনো পণ্য দেশে যে দামে বিক্রি হয়, তার চেয়ে কম দামে যদি তা বিদেশ থেকে আমদানি হয়, তাহলে দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য যে শুল্ক আরোপ করা হয়, তার নাম অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক।
পাটপণ্য রফতানিতে বাংলাদেশের শীর্ষ গন্তব্য ছিল ভারত। দীর্ঘদিন ধরে দেশটিতে পাট রফতানি করে আসছিলেন এখানকার রফতানিকারকরা। আর ভোক্তা চাহিদা থাকায় দেশটিও বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণে পাট আমদানি করত। তবে প্রতিযোগিতা সক্ষমতার দোহাই দিয়ে ভারতের পক্ষ থেকে পাটপণ্যে এ ধরনের কোনো আইনি পদক্ষেপের ঘোষণা ২০১৭ সালেই প্রথম।
সরকার পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানিতে ব্যবসায়ীদের নগদ অর্থ সহায়তা দেয়। এতেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাটপণ্যে ভর্তুকির মাধ্যমে ডাম্পিংয়ের অভিযোগ তোলেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। পরে ২০১৪ সালে ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে মামলা করেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। এ প্রসঙ্গে সে সময় ভারতের পাট ব্যবসায়ীদের সংগঠন ইন্ডিয়ান জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (আইজেএমএ) পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশের রফতানিকারকরা ভর্তুকি মূল্যে ভারতে পাট রফতানি করছেন। ফলে বাংলাদেশ থেকে আমদানিও অনেক বেড়েছে। এর প্রভাবে স্থানীয় শিল্পসংশ্লিষ্টরা ব্যবসার ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ পাচ্ছেন না। তাই স্থানীয় শিল্প সুরক্ষা নিশ্চিত করতেই অ্যান্টি-ডাম্পিং মামলা করা হয়।