জাতীয় ডেস্ক :
বছর পাঁচেক আগে বাবা মারা গেলে চার ভাই-বোনসহ পরিবারের দায়িত্ব পড়ে আবুল কালামের ওপর। হতাশায় যেন অথই সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন যশোরের অভয়নগরের এ যুবক। চাকরির খোঁজে ঢাকায় আসেন। কিন্তু সামান্য বেতন দায়িত্বের বোঝা হালকা করতে পারেনি।
আবুল কালামের চোখে ছিল অদম্য স্বপ্ন। ভাগ্য হারিয়ে দিলেও তিনি পরাজয় মানতে নারাজ। ঢাকা ছেড়ে বাড়িতে গিয়ে কৃষি উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টায় নামেন। ২০১৭ সালে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তিনি কাজে নেমে যান। কিন্তু ব্যর্থতা তার পিছু ছাড়েনি। যশোর থেকে ঢাকার আড়তে সবজি বিক্রি করতে এসে বড় অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি হয় তার।
এবার নিজের স্বপ্নকে আরও নতুন ও বড় করে দেখছেন তিনি। আবারও ঘুরে দাঁড়িয়ে পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে চান। দিগন্তবিস্তৃত পদ্মার বুকে তৈরি হওয়া দেশের দীর্ঘতম সেতুই তার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
পদ্মাকে ‘প্রলয়ংকরী সুন্দরী, বিদ্রোহী নদী’ আখ্যা দেন বাংলা সাহিত্যের ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। এর বুক দিয়ে যেমন বয়ে যায় বাণিজ্যতরি, আবার তা শত শত গ্রামকেই গ্রাস করে ফেলছে। কিন্তু ২৫ জুন উদ্বোধন হতে যাওয়া পদ্মা সেতু আবুল কালামের মতো লাখো যুবককে আশার আলো দেখাচ্ছে।
একসময় পদ্মা সেতু ছিল এক অকল্পনীয় স্বপ্ন। এবার বাস্তবে রূপ নিয়েছে, চোখের সামনে ভেসে উঠেছে বাস্তব এক চোখধাঁধানো অবকাঠামো। এটি নির্মাণের আগের হিসাব বলছে, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ১ দশমিক ২৩ শতাংশ অবদান রাখবে এ সেতু। আর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বাড়বে শিল্প-বিনিয়োগ। নগরায়ন যেমন গতি পাবে, তেমনি কৃষিতে আসবে বিপ্লব।
পর্যটনের পাশাপাশি বাড়বে কর্মসংস্থান। অর্থাৎ, পদ্মা সেতুর প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী হবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের তিন কোটির বেশি মানুষ। এ সেতুর মাধ্যমে সড়ক ও রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ পরিষেবার লাইন সংযোগ গড়ে তোলা হয়েছে।
যা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্পকারখানার বিকাশে বড় ভূমিকা রাখবে। অন্যদিকে সহজ ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থায় আরও গতিশীল হয়ে উঠবে মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর। সেতুটি চালু হলে স্বল্প সময়ে এ দুই বন্দর থেকে পণ্য খালাস হয়ে ঢাকাসহ দেশের অন্য বড় শহরে সহজেই পৌঁছে যাবে।
পদ্মা নদী পার হয়েই রাজধানীতে আসতে হয় দক্ষিণাঞ্চলের বাসিন্দাদের। এতদিন সেতু না থাকায় ফেরি পারাপারে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা, ভোগান্তি মাড়িয়ে আসতে হয়েছে ঢাকায়। এ ছাড়া পণ্য পরিবহনে ভোগান্তির সীমা নেই এ অঞ্চলের মানুষের। এবার পদ্মা সেতু তৈরি হওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দুঃখ ঘুচবে; সেই সঙ্গে পাল্টে যাবে জীবনযাত্রার মান।
আবুল কালাম বলেন, ‘নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় আমাদের অর্থনৈতিক চাপে থাকতে হয়। বাবা না থাকায় পরিবারের সব দায়িত্ব নিজেকে নিতে হয়। চার ভাই-বোনের মধ্যে বড় আমি। ২০১৫ সালে যশোর কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করি। বাবা ছোট একটা দোকান করে পরিবার চালাচ্ছিলেন। ২০১৬ সালে এক রাতে হঠাৎ বুকে ব্যথা ওঠে তার। কিছুক্ষণ পরই বাবার মৃত্যু হয়। বাবা সবসময়ই পরিবার নিয়ে মানসিক চাপের মধ্যে থাকতেন।’
তিনি বলেন, ‘একদিকে বোন বড় হচ্ছিল। তার বিয়ে দেয়া, ছোট দুই ভাইয়ের লেখাপড়ার খরচ, আর আমার চাকরির ব্যবস্থা করা নিয়ে বাবা সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকতেন। আর এসব চিন্তায় বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা যান।
বাবার মৃত্যুতে পুরোপুরি ভেঙে পড়ি। মাথায় পাহাড়সম দুশ্চিন্তা এসে ভর করে। কারণ, পুরো পরিবারের চাপ এবার আমাকে নিতে হবে।’
বাবার মৃত্যুর পর ঢাকায় এসে ১২ হাজার টাকা বেতনে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি পাওয়ার কথা জানিয়ে আবুল কালাম বলেন, ‘এতে আমার থাকা-খাওয়ার খরচ ও পরিবার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। তিন মাস চাকরি করে আবার বাড়ি ফিরে যাই। এরপর কৃষি কাজের উদ্যোগ নিই।’
তিনি জানান, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ঢাকাকেন্দ্রিক সবজি ব্যবসার উদ্যোগ নিয়ে শুরু করেন কৃষিকাজ। চাষ করেন বিভিন্ন ধরনের মৌসুমি সবজি। তবে এবারও ভাগ্য সহায় হয়নি তার।
কালাম বলেন, ‘২০১৬ সালের মে মাসে ব্যাংক থেকে তিন লাখ টাকা ঋণ নিয়ে পাঁচ একর জমি বর্গা নিই। আগস্টে টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি ও বেগুন চাষ করি। প্রথমবারই ভালো ফলন পাই।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঢাকার কারওয়ান বাজারে সবজি নেয়ার জন্য ১২ হাজার টাকায় একটা ট্রাক ভাড়া করি। ওইদিন বিকেলে ক্ষেত থেকে ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো এবং বেগুন তুলে ট্রাকে বোঝাই করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিই। রাতে শিমুলিয়া ফেরিঘাটে দীর্ঘ যানজটে আটকা পড়ি। কুয়াশার কারণে ফেরি চলাচলে বেঘাত হয়েছিল। এতে সবজি নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় পড়ি। তীব্র যানজটের কারণে ঘাট পার হতে ১৫-১৬ ঘণ্টা লেগে যায়। ঢাকায় পৌঁছে পরদিন সকাল পর্যন্ত আড়তে সবজি বিক্রির জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। ট্রাকে দীর্ঘ সময় আবদ্ধ থাকায় ফুলকপি, বাঁধাকপি ও টমেটো অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়।
যেখানে প্রতিটি ফুলকপি, বাঁধাকপির দাম ২০-২৫ টাকা, সেখানে ৪-৫ টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে। আর টমেটো বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি ৬-৭ টাকায়, যদিও তখন সবজিটির বাজারদর ছিল ১৫-২০ টাকা।’
আবুল কালাম আরও বলেন, ‘বেগুনগুলো মোটামুটি ভালো দামে বিক্রি করা যায়। কিন্তু তা-ও আশানুরূপ হয়নি। এক দিন সময় বেশি লাগায় দুটি ট্রাকের ভাড়াও বেশি দিতে হয়েছে। সব মিলিয়ে ওই চালানে ৯০ হাজার টাকার মতো ক্ষতি হয়। এতে হতাশা নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে।’
এরপর আর কোনো সবজি ঢাকায় না নিয়ে যশোরের আড়তে বিক্রি করেন তিনি। কিন্তু সেখানকার আড়ত ছোট হওয়ায়, চাহিদা কম থাকায় আশানুরূপ দাম পাওয়া যায়নি। ওই বছর লাভের মুখ না দেখে সব মিলিয়ে এক থেকে দেড় লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে তার।
এ সময় পরিবারের খরচ চালাতে আরও দুই লাখ টাকা খরচ হয়ে যায়। অর্থনৈতিক চাপের করাল গ্রাস থেকে তার মুক্তি যখন মিলছিল না, তখন ২০১৭ সালে আবারও ব্যাংক ঋণ নিয়ে দুবাই যান ভাগ্যোন্নয়নে। মোটামুটি আয় করে দেশের ধারদেনা পরিশোধ করলেও ২০২০ সালে করোনা এসে তাকে ফের হতাশার সাগরে ফেলে দেয়। কাজ হারিয়ে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশে ফিরে আসেন তিনি।
এরই মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষ হওয়ায় সেই পুরোনো ইচ্ছা আবার জেগে উঠেছে তার মনে। আবারও কৃষি উদ্যোক্তা হয়ে নিজের ভাগ্য ফেরাতে চান কালাম।
তিনি বলেন, ‘আবারও বিদেশ যাওয়ার চিন্তা করছিলাম। সৌদি আরব যাওয়ার জন্যও এক জায়গায় কথা বলেছিলাম। সব মিলিয়ে সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ হবে। কিন্তু আমার মন টানছে না, বিদেশে যেতে ইচ্ছে করছে না। প্রবাস জীবনটা অনেক কষ্টের। পরিবার-পরিজন সবাইকে ছেড়ে থাকতে হয়। বিদেশ যেতে যে টাকা খরচ হবে, সেই টাকা দিয়ে দেশেই নতুন করে জীবন সাজানোর পরিকল্পনা করছি।’
পদ্মা সেতু হওয়ায় ৪ থেকে ৫ ঘণ্টায় ঢাকায় পৌঁছানো যাবে। আগে যেখানে ১৫ থেকে ২০ ঘণ্টা লাগত। এখন টাটকা সবজি দিনে দিনেই ঢাকার আড়তে বিক্রি করা যাবে। এরই মধ্যে ১০ একর জমিতে মৌসুমি শাকসবজি চাষের উদ্যোগ নেন আবুল কালাম। পাশাপাশি মাছ চাষেরও উদ্যোগ নেন। পদ্মা সেতুতে ভর করে ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে চান তিনি।
বহুল আকাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতু উদ্বোধন শনিবার (২৫ জুন)। এরপর যান চলাচলের জন্য রোববার (২৬ জুন) সকাল থেকে উন্মুক্ত করা হবে স্বপ্নের এ সেতুটি। এটি দেশের পদ্মা নদীর ওপর নির্মাণাধীন একটি বহুমুখী সড়ক ও রেলসেতু। এর মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের সঙ্গে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর যুক্ত হবে। ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাংশের সংযোগ ঘটবে।
দুই স্তরবিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাস ব্রিজটির ওপরের স্তরে থাকবে চার লেনের সড়কপথ এবং নিচের স্তরটিতে একটি একক রেলপথ। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যান বসানো হয়েছে। ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৮.১০ মিটার প্রস্থ পরিকল্পনায় নির্মিত দেশটির সবচেয়ে বড় এ সেতু।
পদ্মা সেতু নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। খরস্রোতা পদ্মা নদীর ওপর ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ হয়েছে স্বপ্নের এ সেতু। ২০১৪ সালে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়।