আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
চলতি জুনের তীব্র দাবদাহে হাঁসফাঁস করছে স্পেন, ফ্রান্সসহ অন্য ইউরোপীয় দেশগুলোর মানুষ। এতে হরহামেশা দাবানলের ঘটনা ঘটছে। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির খবর বলছে, এমন আগাম গ্রীষ্মের তপ্ত আবহাওয়ার ধাক্কা এখন যেন এক স্বাভাবিক রীতিতে পরিণত হয়েছে।
এ মাসে দাবদাহের সর্বোচ্চ মাত্রা পেয়েছে শনিবার। বিজ্ঞানীরা আগে এমন আভাসই দিয়ে রেখেছিলেন। তারা বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতার কল্যাণে চলতি বছর আগেভাগেই গ্রীষ্মের দেখা মিলবে। আর শেষ পর্যন্ত তা-ই ঘটেছে।
সাগরপাড়ের রিসোর্টের জন্য বিখ্যাত ফ্রান্সের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর বিয়ারিটজে শনিবার সর্বকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা সইতে হয়েছে স্থানীয়দের। দেশটির রাষ্ট্রীয় আবহাওয়া সংস্থা মেটিও ফ্রান্স বলছে, এদিন শহরটির তাপমাত্রা ছিল ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ফ্রান্সের জলজ অবকাশ পার্কগুলোর বাইরে সারি সারি যান ও জনজট। তাপের দুর্যোগ থেকে বাঁচতে লোকজন দিশা না পেয়ে পানির কাছে চলে আসছে। দেশটির সেন নদীতে গোসলের অনুমতি না-থাকায় শহরের ঝরনাগুলোতে আশ্রয় খুঁজছেন প্যারিসবাসী।
শনিবার ফ্রান্সের বিভিন্ন অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায়। মেটিও ফ্রান্স বলছে, শুক্রবার অন্তত ১১টি এলাকায় জুনের আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ম্যাথিও সোরেল বলেন, ১৯৪৭ সালের পর থেকে এভাবে কখনো আগাম দাবদাহের ঘটনা ঘটেনি।
এই আবহাওয়াকে ‘জলবায়ু পরিবর্তনের নির্দেশক’ আখ্যায়িত করে তিনি জানান, কয়েকটি অঞ্চলে অনেক মাসিক, এমনকি সর্বকালের তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙে যাবে।
দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দাবানল
দক্ষিণাঞ্চলীয় ফ্রান্সের ভ্যার অঞ্চলে সামরিক প্রশিক্ষণের সময় কামানোর গোলায় অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ২০০ হেক্টরের গাছপালা পুড়ে গেছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বলছে, সেখান থেকে আড়াই হাজার ভেড়া নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তারা এখন আর কোনো ঝুঁকিতে নেই।
ক্যানজিওরস সামরিক ফাঁড়ির গোলায় পশ্চিম ইউরোপের এমন প্রশিক্ষণ স্থানগুলোতে এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় আগুনের ঘটনা ঘটেছে। অগ্নিনির্বাপণকর্মীরা বলছেন, মরু অঞ্চলে অবিস্ফোরিত গোলাবারুদ থাকায় তাদের আগুন নেভানোর কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যদিও চারটি কানাডিয়ার বিমান থেকে জলবোমা নিক্ষেপ করে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে হচ্ছে ইউরোপীয় দেশটির কৃষকদের। দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর পেরপিগনানের কৃষক ড্যানিয়াল তোফালনি বলেন, ভোর থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত তারা ক্ষেতে কাজ করেন। এরপর তাপ বেড়ে গেলে বাড়িতে ফিরে যান। এরপর সন্ধ্যায় যখন আলো কমে আসে, তখন আবার কাজ শুরু করেন।
কখনো কখনো তার টমেটো গ্রিনহাউসের তাপমাত্রা বেড়ে ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াতে পৌঁছায়।
শনিবার স্পেনের বনাঞ্চলে আগুনে প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমি পুড়ে গেছে। দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় সিয়েরা ডি লা কুলেবরা অঞ্চলে এই দাবানলের ঘটনা ঘটে। আগুনের কারণে বহু মানুষকে ঘরবাড়ি থেকে ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। জনশূন্য করে দেয়া হয়েছে ১৪টি গ্রাম।
তবে কোনো কোনো বাসিন্দা শনিবার সকালে বাড়িতে ফিরতে পেরেছেন। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বলছে, আগুন আরও অনেক দিন সক্রিয় থাকতে পারে। সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। কাতালোনিয়ার বনাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় আগুন নেভাতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন অগ্নিনির্বাপণকর্মীরা।
শনিবার দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর চলে যাবে বলে আভাস দেয়া হয়েছিল। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর জারাগোজায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
জার্মানিতেও দাবানল হয়েছে। সেখানে এদিন ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল। যদিও তা কেবল ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত ছিল। শুক্রবার সন্ধ্যায় বার্লিনের কাছের ব্র্যান্ডডেনবার্গ অঞ্চলের আগুন প্রায় ৬০ হেক্টর জমিতে ছড়িয়ে পড়ে।
ভবিষ্যতের আগাম অভিজ্ঞতা
নেদারল্যান্ডস কর্তৃপক্ষ বলছে, শনিবার উষ্ণতম দিন হবে বলে আমরা ধরে রেখেছিলাম। আবহাওয়াবিদরা বলেন, শুক্রবার ছিল যুক্তরাজ্যের উষ্ণতম দিন। সেখানে এদিন দুপুরের পর তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায়।
ক্লেয়ারে মর্গান নামের লন্ডনের এক সম্পাদক বলেন, ‘আমি মনে করি, লোকজন এখন পরিবেশের উষ্ণ আচরণকে উপভোগ করছেন। কিন্তু উষ্ণতা আরও বাড়লে তা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।’
ইতালির উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি শহরে পানির রেশন দেয়া হচ্ছে। আর অনাবৃষ্টিতে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় লিম্বার্লি অঞ্চলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা হতে পারে। এ ছাড়াও দেশটিতে গরুর দুধের উৎপাদন ১০ শতাংশ কমে গেছে।
শনিবার ইতলির কৃষি অ্যাসোসিয়েশন কোল্ডরেত্তি বলেছে, গরুর জন্য আদর্শ আবহাওয়া হচ্ছে ২২ থেকে ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু বর্তমানে সেই তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। প্রাণীরা দিনে ১৪০ ডিগ্রি পানি পান করছে। আর আবহাওয়ার চাপের কারণে তাদের উৎপাদনক্ষমতাও কমে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের হতাশাজনক প্রবণতার কারণে তাপমাত্রা আরও বেড়ে যেতে পারে। দাবদাহ আগেভাগেই শুরু হচ্ছে।
জেনেভায় বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার মুখপাত্র ক্লেয়ার নুলিস বলেন, ‘আজ আমরা যা দেখছি, তা ভবিষ্যতে যা ঘটতে যাচ্ছে, তার পূর্বাভিজ্ঞতা। অর্থাৎ, ভবিষ্যৎ পৃথিবীর উষ্ণতার আগাম স্বাদ নিচ্ছি আমরা।’ বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের ঘনীভবন অব্যাহত থাকলে তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পায়নের স্তরের চেয়ে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে।