বাণিজ্য ডেস্ক :
জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট উত্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, যা দেশের এ যাবৎকালের সর্ববৃহৎ বাজেট। করোনা মহামারি কাটিয়ে দেশের সার্বিক উন্নয়ন-অগ্রগতিতে এ বাজেটের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই উত্থাপিত বাজেট নিয়ে জনমনে প্রবল আগ্রহ থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
বৃহস্পতিবার (৯ জুন) জাতীয় সংসদে বাজেট ঘোষণার পর দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ কথা বলছেন বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে। রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও চলছে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা।
অনেকেই বলছেন, এই বাজেট ঋণনির্ভর। যার বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব। এমনকি ইতিহাসের রেকর্ড ঘাটতি বাজেট জাতির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে বলেও মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
চলমান বাজেটের আলোচনাকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলতে সময় নিউজ কথা বলেছে দেশের তরুণদের সঙ্গে। যারা নানাবিধ পেশায় যুক্ত থেকেও কাজ করে চলেছেন দেশ ও দেশের মানুষের জন্য। জেনে নেয়া যাক, উত্থাপিত বাজেট নিয়ে তাদের ভাবনাগুলো।
তাদের একজন আমীন আল রশীদ। যিনি কাজ করছেন বেসরকারি নেক্সাস টেলিভিশনের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর হিসেবে।
তিনি কথা বলেছেন বাজেটে ঘোষিত সরকারের ‘সবার জন্য পেনশন’ শীর্ষক বিষয়ের বাস্তবায়নের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে।
আমীন আল রশীদ বলেন, ‘এবারের বাজেটের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো, অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, আগামী অর্থবছর থেকে দেশের ষাটোর্ধ্ব সব মানুষকে পেনশনের আওতায় আনা হবে। সমস্যা হলো, যে পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ায় এ পেনশন চালু করা হবে, সেটি একধরনের বিমা। অর্থাৎ, নাগরিকরা প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ জমা রাখবেন এবং ৬০ বছর বয়স হওয়ার পর তিনি সেই অনুপাতে প্রতি মাসে পেনশন হিসেবে একটি টাকা পাবেন। কিন্তু সরকারি কর্মচারীদের জন্য মূলত থোক বরাদ্দ দিয়ে পেনশন দেয়া হয়। ফলে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাটি বিমার আদলে হওয়ায় এখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সবাই অংশগ্রহণ করবে কি না; বিশেষ করে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষ কী করে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ জমা দেবেন, নাকি তাদের জন্য আলাদা পদ্ধতি থাকবে–সেটি পরিষ্কার নয়। বস্তুত পেনশনকে নাগরিক অধিকার হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে তাদের আয়কর ও পেনশনকে একীভূত করা প্রয়োজন। অর্থাৎ, আয়কর ব্যবস্থার সঙ্গে পেনশন ব্যবস্থা যুক্ত করতে হবে।’
‘সামরিক, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের বাইরে যেসব বেসরকারি চাকরিজীবী ও অন্যান্য পেশার লোক কর দেন, ৬০ বছর বয়স হয়ে গেলে তাদের স্বয়ংক্রিয়ভাবে পেনশনের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। এতে কর প্রদানে মানুষের উৎসাহ বাড়বে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মনে রাখা দরকার, আগামী বাজেট হবে বর্তমান সরকারের শেষ বাজেট। কারণ, আগামী বছরের ডিসেম্বরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। সেই গুরুত্বপূর্ণ বাজেটে সর্বজনীন পেনশনের মতো একটি বহুল প্রত্যাশিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা গেলে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে এটি চালু করা গেলে সেটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ভোটের রাজনীতিতে বাড়তি সুবিধা দেবে–তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু যেসব প্রশ্ন ও অস্পষ্টতা রয়েই গেছে, সেগুলো দূর করা দরকার।’
কথা বলেন তরুণ লেখক ও কবি মো. আসাদুজ্জামান। যিনি পেশায় একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। কাজ করছেন মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড নামে একটি বেসরকারি ব্যাংকে। কথা হয় তার সঙ্গে।
আসাদুজ্জামান বলেন, ‘যখন করোনার ধকল সামলে ওঠার চেষ্টায় ব্যস্ত বিশ্ব, ঠিক তখনই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে পৃথিবী ততটাই বিপর্যস্ত। এরই মধ্যে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি ও আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে টাকার বিপরীতে ডলারের উত্থান ও জনজীবন তীব্র অসংগতির মাঝে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে বরাবরের মতোই দেশি-বিদেশি ঋণনির্ভর বৃহৎ আকারের ঘাটতি বাজেট উত্থাপিত হয়েছে। যেটি বাংলাদেশের নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন ধারণের জন্য খুবই যন্ত্রণাদায়ক ও কষ্টকর। কেননা, মুদ্রাস্ফীতির করাল গ্রাসে জর্জরিত পুরো অর্থনীতির বাজার ব্যবস্থা।’
তিনি বলেন, ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর বাজারে যেখানে আগের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে সামগ্রিকভাবে ১২-১৫ গুণেরও বেশি, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দুর্নীতি, কালোবাজারি ও জনভোগান্তি। সাধারণ জনগণের আয় থামিয়ে রেখে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে আমার মতামত বর্ণনাতীত। গরিবকে আরও গরিব এবং ধনীকে আরও ধনী করার এই বাজেটটি বাঙালি জাতির কপালে আরেকটি অশনিসংকেত।’
‘এরই মধ্যে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ও বিভিন্ন পণ্যের দাম হুহু করে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার, যেখানে আয় ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেই বললেই চলে। যেটা বর্তমান তরুণ প্রজন্মের জন্য এই প্রচণ্ড বেকারত্বের ভিড়ে তীব্র হতাশার বিষয়।’
এই ব্যাংক কর্মকর্তা আরও বলেন, বাংলাদেশের ন্যায় বিশ্বের অনেক দেশ স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশের অনেক পরে। কিন্তু তারা আজ উন্নতির শীর্ষ অবস্থানে পৌঁছে গেছে শুধু তাদের জনশক্তি ও বিদ্যমান সম্পদকে সঠিকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে। মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরকে একটা উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়। বাংলাদেশের মতো একটি পর্যাপ্ত জনবল সমৃদ্ধ পূর্ণ মাত্রায় ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের বর্তমান চিত্র অনেকটাই তরুণ প্রজন্মের বুকে হতাশার বীজ বোনে। অচলায়তন শিক্ষাব্যবস্থা ও ঘুণে ধরা জাতির বিবেক দরবেশ বাবার ভূমিকায় অবতীর্ণ আছে স্বাধীনতার পর থেকেই। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো তাদের জনশক্তির দক্ষতা বৃদ্ধির নিমিত্তে গড়ে তুলে অর্থনীতিতে অবদান রাখতে বিভিন্ন জাতীয় পর্যায়ে রোডম্যাপ তৈরি করে, সেখানে বাংলাদেশে তৈরি হয় শিক্ষিত বেকার তৈরির এক মস্ত বড় কারখানা! অনুমোদন হয় একের পর এক প্রকল্প, যা আগের তুলনায় কোনো অংশে ব্যতিক্রম নয়।’
চরম হতাশার মাঝেও আশার বাতিটা এখনো নিভে যায়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যাইহোক, আশায় বাঁচে মানুষ। যদিও হোক সেটি মিথ্যা! তবুও আশা করতে দোষ কীসের? বর্তমান বাজেটকে যদি সঠিকভাবে তদারকি করা অর্থাৎ পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিটি প্রকল্প পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না, তার যদি সঠিকভাবে দেখভাল করা যায়, তাহলে হয়তো বাংলাদেশের বুকে সত্যিকারের আশার আলো কিয়দংশ হলেও জ্বলে উঠবে।’
শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করছেন আরিফ রহমান শিবলী। চাইল্ড মেসেজ-ইউএনসিআরসি থার্টিন নামে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন তিনি। একই সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থায়। বাজেট নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে।
আরিফ রহমান বলেন, ‘শিশু ও নারীর উন্নয়নে বাজেট আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন বলে মনে করি এবং এই বাজেট কীভাবে খরচ করা হবে, তা-ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রতি ছয় মাস অন্তর গণমাধ্যমে প্রচার করার ব্যবস্থা নেয়া হলে সরকারের উন্নয়নমূলক কাজগুলো শিশুরাও জানতে পারবে।’
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি হ্রাসের পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘চাল, তেল, লবণসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য কমানোর বিষয়টি বাজেটে উল্লেখ থাকা দরকার। যার মাধ্যমে মানুষ স্বস্তি পাবে। সরকারকে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত হিসেবে বসবাস করা জনগোষ্ঠীর দিকে সবার আগে তাকাতে হবে। সবাই যেন তাদের আয় অনুযায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে পারে, সেদিকেও খেয়াল রাখা উচিত।’
আরিফুর রহমান আরও বলেন, ‘আমি বাজেটে দেশের তারুণ্যকে মাদকের ভয়াবহতা থেকে ফিরিয়ে আনতে সিগারেটের দাম বাড়ানোকে সমর্থন করছি। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সমস্যায় বাজেট নিয়েও সরকারকে আরও ব্যাপকভাবে ভাবা উচিত বলেও মনে করছি।’
তরুণ লেখক শফিক রিয়ান সময় নিউজকে জানান, দু-বছরের করোনা মহামারি কাটতে না কাটতেই শুরু হয়ে গেল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বৈশ্বিক এক অর্থনৈতিক ধসের আলামত এ থেকেই পাওয়া যায়। যার প্রভাব আমাদের অর্থনীতিতেও পড়েছে। তবুও দিনশেষে চাওয়া, ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট হোক জনবান্ধব।
তিনি বলেন, ‘হিমশিম খেয়ে জীবনযাপন করা মানুষগুলো যেন স্বস্তিতে দিন পার করতে পারে, সেই চিন্তা মাথায় রেখে যেন বাজেট পাস করা হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য যেন মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে থাকে। পাশাপাশি, যেসব বিদেশি পণ্য আমাদের জন্য জরুরি, সেসব পণ্যে যেন ভ্যাটের হার কম থাকে।’
তরুণ এই লেখক আরও বলেন, ‘বর্তমান সরকার, নিত্য জীবনে প্রয়োজনীয় অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। এই বাজেটও মানুষকে নিরাশ করবে না বলেই আমার বিশ্বাস।’