হোম খুলনাসাতক্ষীরা স্বাধীনতার ৫৫ বছরেও সাতক্ষীরা জেলার সাংস্কৃতিক কার্যক্রম স্থবির

স্বাধীনতার ৫৫ বছরেও সাতক্ষীরা জেলার সাংস্কৃতিক কার্যক্রম স্থবির

কর্তৃক Editor
০ মন্তব্য 51 ভিউজ
প্রেস বিজ্ঞপ্তি:
সাতক্ষীরা জেলা সাংস্কৃতিক পরিষদের গঠিত কমিটি আড়াই বছরের অধিক সময় অতিবাহিত হলেও দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়েছে তারা। সংগঠনের সদস্যদের বকেয়া চাঁদা প্রায় ৪ লক্ষ টাকা পড়ে থাকলেও তা আদায়ের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। তবে কমিটি ঘোষণা হওয়ার পর সংগঠনের ফান্ড থেকে প্রায় ২ লক্ষ টাকা খরচ করে কার্যনির্বাহী সদস্যদের মাঝে ব্লেজার বিতরণ করা হয়েছিল বলে গুঞ্জন প্রকাশ। তাছাড়া জেলার সামগ্রিক সাহিত্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সার্বিক উন্নয়ন, সম্প্রসারণ, গণমূখী ও আধুনিকরণে কোনো পদক্ষেপ এবং দুঃস্থ, অসহায় ও দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রাত্ম সাহিত্য সাংস্কৃতিক কর্মীদের কোনো আর্থিক সহয়তা প্রদান করেনি। এতে স্বাধীনতার ৫৫ বছরেও সাতক্ষীরা জেলার সাংস্কৃতিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে।

জানা গেছে, এক সময়ের শতাধিক ক্রীড়া, শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চার মাদার সংগঠন হিসাবে সুপরিচিত সাতক্ষীরা জেলা সাংস্কৃতিক পরিষদ। এই পরিষদের কতিপয় সদস্য বিগতদিনে আদালতে ৩ টি মামলা দায়ের করে প্রায় ১১ বছরের অধিক সময় কার্যক্রম বন্ধ করেছিল। তদপ্রেক্ষিতে সেই মামলাগুলো নিষ্পত্তিপূর্বক সংগঠনের কার্যক্রম গতিশীল করতে ১৯ ডিসেম্বর ২০২২ (সোমবার) দুপুর সাড়ে ১২ টায় জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে সংগঠনের সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মাদ হুমায়ুন কবিরের সভাপতিত্বে একটি সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জেলা সাংস্কৃতিক পরিষদের সদস্যরা দীর্ঘদিন ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক পরিষদের কমিটি না থাকায় ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করে ঐহিত্যবাহী এই সাংস্কৃতিক সংগঠন সাংস্কৃতিক পরিষদকে গতিশীল করার লক্ষ্যে দ্রুত একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন সদস্যরা। সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ঐ বছরের শেষার্ধে দুই এমপির প্রস্তাবনায় তৎকালীন সভাপতি (ডিসি) ৩ বছরের জন্য সাতক্ষীরা চেম্বার অব কমার্স এর সভাপতি নাসিম ফারুক খান মিঠুকে সম্পাদক করে ২৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেন। ঐ গঠিত কমিটি অবৈধ বলে অনেক সদস্যরা দাবি করলেও তারা সকলে একত্রিত হতে পারেনি। সেমতে অনেকে ঐ কমিটির নেতৃবৃন্দকে নিরবে মেনে নিয়েছিল। তবে ঐ কমিটি পরিষদের ২৩৩ জন সদস্যকে সাথে নিয়ে বিগত আড়াই বছরের অধিক সময়ে কোনো সভা করতে পারেনি। এছাড়াও ঐ সদস্যদের প্রায় ১৭ বছরের অধিক সময় বার্ষিক চাঁদা ১’শ টাকা করে বকেয়া রয়েছে। যা বর্তমানে প্রায় ৪ লক্ষ টাকায় পৌঁছেছে। কার্যতঃ ঐ টাকা আদায়ে সদস্যদের কোনো নোটিশ প্রদান করেনি তারা।
আরও জানা গেছে, জেলার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা ব্যতিক্রম প্রতিষ্ঠান ‘সাতক্ষীরা জেলা সাংস্কৃতিক পরিষদ’। যা মহান মুক্তিযুদ্ধের ফসল। অথচ সেই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম দৃশ্যমান না থাকার বিষয়টি দুঃখজনক। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে একটি জেলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিকশিত হয় এবং মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়। এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়লে জেলার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং মানুষ তার ঐতিহ্য থেকে দূরে চলে যায়। এই সমস্যা সমাধানে, সরকারের উচিত জেলা সাংস্কৃতিক পরিষদকে প্রয়োজনীয় আর্থিক ও অন্যান্য সহযোগিতা প্রদান করা। এছাড়াও, পরিষদের অভ্যত্মরীণ দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে নতুন নেতৃত্ব তৈরি করতে নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং সদস্যদের মধ্যে আগ্রহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্বাধীনতার ১২ দিন পরে অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ২৮ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের কতিপয় সাংস্কৃতিকর্মী ও নাট্যজনরা ওই জায়গা দখল করতঃ একটি সভায় ‘দরবার হল’ বিলুপ্ত করে নামকরণ করেন ‘শহীদ মিলনায়তন’। তবে ১৯৭৫ সালের ২৪ মার্চ সংগঠনের একটি গঠনতন্ত্র প্রণীত হয়। সেই গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ‘শহীদ মিলনায়তন’ কমিটির একটি উন্নতর প্রকাশ ‘সাতক্ষীরা মহাকুমা সাংস্কৃতিক পরিষদ’। অদ্য তারিখ হইতে ‘শহীদ মিলনায়তন’ কমিটি বিলুপ্ত করা হইল। যা পরবর্তীতে সাতক্ষীরা মহাকুমা জেলায় রুপাত্মরিত হলে এটির নাম পরিবর্তন করে ‘সাতক্ষীরা জেলা সাংস্কৃতিক পরিষদ’ নামকরণ করা হয়।
ময়জমা ৩৩১৩ নং খতিয়ানের বুড়ন পরগণার অত্মগর্ত ১৯১৭ সনের ৫৩২ নং ছোলে ডিক্রী প্রাপ্ত জমির মালিক মৃগাঙ্ককৃষ্ণ ঘোষ গং। পরবর্তীতে জমিদার প্রাণনাথ রায় চৌধুরী ও তাদের উত্তরসূরী হিসাবে বিনয়কৃষ্ণ ঘোষ মালিক হন ওই জমি। তিনি শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে থিয়েটার ঘর নির্মাণের জন্য ২৯ শতক জমি দান করেন। সেই সময়ে থিয়েটার ঘর প্রতিষ্ঠা করতে ‘দরবার হল কমিটি’ নামীয় একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। এবং ১৯২৭ সালের ওই জমি দরবার হল কমিটির পক্ষে প্রাক্তন সেক্রটারী অরবিন্দনাথ রায় চৌধুরীর নামে রেকর্ডও হয়েছিল। তখন থেকে ঐ জায়গায় বিনয়কৃৃষ্ণ ঘোষের শতবছর আগের স্বপ্ন বাত্মবায়িত হতে থাকে।
এই নিয়ে বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও নাট্যজন খায়রুল বাসার বলেন, স্বাধীনতার ১২ দিন পরে এই পরিষদ মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারাই গঠিত হয়। এই পরিষদের প্রথম সভা আমার আহবানে হয়েছিল। সেই সভায় সকলের সম্মতিতে দরবার হল কমিটি বিলুপ্ত করে ‘শহীদ মিলনায়তন’ করা হয়। পরবর্তীতে সেই ‘শহীদ মিলনায়তন’ এর উন্নতর প্রকাশ আজকের ‘সাতক্ষীরা জেলা সাংস্কৃতিক পরিষদ’। অথচ এই পরিষদে আমাকে সাধারণ সদস্য পর্যত্ম রাখা হয়নি। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। এরপরেও এই পরিষদ সাতক্ষীরার ক্রীড়া, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার মাতৃসংগঠন হিসাবে পূর্বের মতো ধারবাহিক কর্মকাণ্ডের মতো পরিচালিত হোক সেই প্রত্যাশা করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিকর্মী পল্টু বাসার বলেন, জেলার একটি ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন। এই সংগঠনটি দীর্ঘদিন ধরে জেলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। আগে মাঝে মাঝে এই পরিষদের কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা হলেও, গত আড়াই বছরের অধিক সময়ে সংগঠনটি নিয়মিতভাবে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কর্মশালা এবং অন্যান্য কার্যক্রম আয়োজন করেনি। এমনকি সংগঠনের একটি গঠনতন্ত্র রয়েছে। সেই অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে না। বর্তমান কমিটিও অবৈধভাবে তৎকালীন ডিসি দুই এমপির পরামর্শে বানিয়েছিলেন। তারপরেও অনেকে ঐ কমিটিকে মেনেও নিয়েছিলেন। তখন আমরা মনে করেছিলাম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে পরিষদ পূর্বের জায়গায় ফিরে আসুক। শিল্পীদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটুক। তবে সেটি হয়নি। গত ১৭ বছর ধরে যাদের চাঁদা বাকি তাদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের কোনো নোটিশও প্রদান করেনি। এছাড়াও পরিষদ’র আয়-ব্যয় এর স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। যেমনঃ অনেকে আর্থিক সাহায্যের জন্য আবেদন করেছিলেন। তবে তাদের কোনো আর্থিক সহয়তা করেনি; বরং কমিটির নেতৃবৃন্দ প্রায় ২ লক্ষ টাকা ব্যয় করে প্রায় ৩০ টি ব্লেজার বানিয়েছিলেন। যা অন্যায়। তিনি আরও বলেন, ইতোপূর্বে সাধারণ সদস্য হিসেবে যে সকল নিষ্কৃয় সংগঠনগুলোর সংগঠকরা রয়েছে তাদের সদস্যপদ বাজেয়াপ্ত, পরিষদে অন্তর্ভূক্ত জেলার শতাধিক সংগঠনগুলোর মধ্যে সক্রিয় সংগঠনগুলোর সংগঠকদের নতুন সদস্যপদে অন্তর্ভুক্তকরণ এবং কমিটির নেতৃবৃন্দ যেন দায়বদ্ধতা নিয়ে সুন্দর একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন সেই প্রত্যাশা করেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে সাতক্ষীরা জেলা সাংস্কৃতিক পরিষদের সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ এর মোবাইলে একাধিকবার ফোন করলেও রিসিভ হয়নি। তবে প্রতিষ্ঠানের সহ-সভাপতি শহীদুর রহমান বলেন, নানান পেশার মানুষ তার আলোত্ব উপভোগ করবে এটিই স্বাভাবিক। তবে আগামীতে এর প্রসারতা আরও বৃদ্ধি করা যায় কিনা তার চিত্মা ভাবনা ছিল আমাদের। সেমতে সংস্কারকৃত ভবনে একজন কর্মচারীও রেখেছিলাম আমরা। সে নিয়মিত পরিষদ খুলতো। দীর্ঘদিন তার বেতন বকেয়া। সেজন্য তাকে আর রাখা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। এছাড়াও তিনি বলেন, দীর্ঘদিন পরিষদের সম্পাদক জেলে ও সাতক্ষীরা এর বাইরে থাকায় তার সাথে আমরা যোগাযোগ করতে পারেনি। তাই সদস্যদের বকেয়া চাঁদা আদায়েও কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারিনি।
আপনাদের কমিটির মেয়াদ তো ডিসেম্বরে শেষ হবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, দেখতে দেখতে প্রায় আড়াই বছরের অধিক সময় পার হয়ে গেলো। আমাদের কাজ করার মানসিকতা থাকলেও করতে পারিনি। এই শেষ বছরে পরিষদের নির্বাচন করতে হলে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়াও ৩১ অক্টোবরের মধ্যে সদস্যদের বকেয়া চাঁদা সংগ্রহপূর্বক নবায়ন কার্যক্রম শেষ করতে হবে। সেটি করতে ব্যর্থ হলে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে কার্যনির্বাহী পরিষদ গঠন করা দুরাহ হয়ে দাঁড়াবে। তিনি আরও বলেন, অনেকে ভাবে পরিষদের ফান্ড থেকে টাকা নিয়ে কার্যনির্বাহী সদস্যদের বেস্নজার বানিয়ে দিয়েছিলাম আমরা। আসলে সেটি নহে। অনেক সদস্য সেটি চেয়েছিল; কিন্তু আমাদের সম্পাদক বললেন না। প্রয়োজনে নিজে দেবো। সেমোতাবেক তিনি নিজ খরচেই ব্লেজার বানিয়ে সদস্যদের দিয়েছিলেন। আর কয়েকজন আর্থিক সাহায্যেও জন্য আবেদন করেছিলেন। তবে একাউন্ট হোল্ডার এর জন্য অর্থ সংকটে সেটি হয়ে উঠেনি। তাছাড়াও উপরিউক্ত বিষয়ে জানতে ঐ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নাছিম ফারম্নক খান মিঠু এর মোবাইলে একাধিকবার ফোন করলেও ফোন রিসিভ করেনি। এমনকি তার বাড়িতে গেলেও তার সাথে যোগাযোগ সম্ভবপর হয়ে উঠেনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই  সাতক্ষীরা জেলা সাংস্কৃতিক পরিষদের একাধিক সদস্য বলেন, এই পরিষদ অবৈধ কমিটি দ্বারা কাগুজে-কলমে পরিচালিত। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী সাতক্ষীরার অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান/সংগঠনগুলোর কমিটি পদাধিকার বলে জেলা প্রশাসক ভেঙ্গে দিলেও সাতক্ষীরা জেলা সাংস্কৃতিক পরিষদের কমিটি ভেঙ্গে দেয়নি। সেখানে ফ্যাসিবাদী সরকারের এমপিদের মনোনীত ব্যক্তিরা ঘাপতি মেরে আজও আছে। তাই, দ্রুত ঐ কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানে নির্বাচনের মাধ্যমে একটি কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হলে জেলার স্থবির হয়ে পড়া সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পূর্বের মতো জাগ্রত হবে বলে বিশ্বাস করেন তারা।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন