আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
পাকিস্তানের সামরিক প্রধানের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যাহ্নভোজের বৈঠকের পর ভারত একটি ব্যক্তিগত কূটনৈতিক প্রতিবাদ জানিয়েছে। ভারত ওয়াশিংটনকে সতর্ক করে দিয়েছে, তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ঝুঁকি রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে নয়াদিল্লি। শুক্রবার (২১ জুলাই) এক প্রতিবেদনে কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকদের বরাতে রয়টার্স এমনটাই জানিয়েছে।
কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকরা বলেন, কয়েক দশক ধরে সমৃদ্ধ সম্পর্কের পর ওই বৈঠক এবং মার্কিন-ভারত সম্পর্কের অন্যান্য উত্তেজনা বাণিজ্য আলোচনাও প্রভাব ফেলেছে। কারণ ট্রাম্প প্রশাসন ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাদের অন্যতম প্রধান অংশীদারের বিরুদ্ধেও শুল্ক আরোপের বিষয়টি বিবেচনা করছে।
তিন জন ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, এটি এমন একটি বেদনাদায়ক জায়গা তৈরি করেছে, যা ভবিষ্যতের (মার্কিন-ভারত) সম্পর্ককে বাধাগ্রস্ত করবে।
ছোটখাটো বাধা সত্ত্বেও গত দুই দশকে দুই দেশের সম্পর্ক শক্তিশালী হয়েছে, অন্তত আংশিকভাবে। কারণ, উভয় দেশই চীনকে মোকাবেলা করার চেষ্টা করছে।
এশিয়া প্যাসিফিক ফাউন্ডেশন থিঙ্ক ট্যাঙ্কের ওয়াশিংটন-ভিত্তিক সিনিয়র ফেলো মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, তবে ‘বর্তমান সমস্যাগুলো ভিন্ন’।
তার মতে, যেভাবে ঘন ঘন এবং তীব্রতার সঙ্গে আমেরিকা পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ করছে এবং ভারতীয় উদ্বেগগুলোকে বিবেচনায় নিচ্ছে না – বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সাম্প্রতিক সংঘর্ষের পরে। এটি দ্বিপাক্ষিক অস্থিরতার কিছুটা কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কুগেলম্যান বলেন, এবার উদ্বেগের বিষয় হলো, ট্রাম্পের অনির্দেশ্যতার কারণে শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে তার দৃষ্টিভঙ্গি বাণিজ্য জগতেও বিস্তৃত হচ্ছে, যা বৃহত্তর উত্তেজনার কারণ।
নরেন্দ্র মোদির কার্যালয় এবং ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এসব বিষয়ে মন্তব্যের অনুরোধের জবাব দেয়নি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পূর্বে বলেছে, তারা ট্রাম্প-মুনির বৈঠকের ‘নোট নিয়েছে’।
একজন মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, তারা ব্যক্তিগত কূটনৈতিক যোগাযোগের বিষয়ে মন্তব্য করবেন না। তার মতে, ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে।
মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, ‘এই সম্পর্কগুলো তাদের (ভারত-পাকিস্তান) নিজস্ব যোগ্যতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে এবং আমরা আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কগুলোকে একে অপরের সঙ্গে তুলনা করি না।’
হোয়াইট হাউসে দুপুরের খাবার
রয়টার্স জানিয়েছে, মে মাসে ভারতীয় কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর এক মারাত্মক হামলার প্রতিক্রিয়ায় ভারত সীমান্তের ওপারের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা শুরু করে। পারমাণবিক অস্ত্রধারী প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে সংক্ষিপ্ত সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রতি ‘ভিন্ন পদক্ষেপ’ নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। চার দিনের আকাশযুদ্ধ, ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলার পর উভয় পক্ষ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত এবং ইসলামিক পাকিস্তান নিয়মিতভাবে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে এবং তিনটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে হয়েছে – যার মধ্যে দুটি বিতর্কিত কাশ্মীর অঞ্চল নিয়ে।
গত মে মাসের যুদ্ধের কয়েক সপ্তাহ পর ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে জেনারেল মুনিরকে মধ্যাহ্নভোজের জন্য আমন্ত্রণ জানান, যা দেশটির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বড় অগ্রগতি। কেননা পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদ এবং জো বাইডেনের আমলে মূলত স্থবির হয়ে পড়েছিল। এটি ছিল প্রথমবারের মতো যে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রধানকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ।
ভারতীয় নেতারা বলেছেন, ভারত ও পাকিস্তান সম্পর্কে মুনিরের দৃষ্টিভঙ্গিতে ধর্মের ছাপ আছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর মে মাসে কাশ্মীর হামলার কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, পর্যটকদের তাদের পরিবারের সামনে তাদের বিশ্বাস যাচাই করার পরে হত্যা করা হয়েছিল। এটা বুঝতে হলে, আপনাকে এটাও দেখতে হবে…পাকিস্তানি নেতৃত্ব – বিশেষ করে তাদের সেনাপ্রধান, যিনি চরম ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন।
তবে পাকিস্তান বলেছে, মোদিই ধর্মীয় উগ্রবাদ দ্বারা পরিচালিত। তার হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধারা ভারতের বৃহৎ মুসলিম সংখ্যালঘুদের অধিকারকে পদদলিত করেছে।
হোয়াইট হাউসে মুনিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ ভারতের ক্ষোভকে আরও বাড়িয়ে তোলে। ট্রাম্প বারবার জোর দিয়ে বলেছেন, তিনি দুই দেশের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ এড়াতে চান। তাদের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা বন্ধ করার হুমকিও দেন।
এই মন্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মোদি। তিনি ট্রাম্পকে বলেছিলেন, যুদ্ধবিরতি দুই দেশের সেনা কমান্ডারদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমেই অর্জিত হয়েছে, মার্কিন মধ্যস্থতার মাধ্যমে নয়।
দুই কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, ১৮ জুন মুনিরের সঙ্গে ট্রাম্পের সাক্ষাতের পরের দিনগুলোতে, মোদির অফিস এবং ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার অফিসের লোকেরা তাদের মার্কিন প্রতিপক্ষদের কাছে প্রতিবাদ জানাতে আলাদাভাবে ফোন করেছিলেন। এই প্রতিবাদের কথা আগে কখনো জানানো হয়নি।
বিষয়টির সংবেদনশীলতার কারণে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জ্যেষ্ঠ ভারতীয় কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা সীমান্তের ওপার সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে আমাদের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছি, যা আমাদের জন্য একটি লাল রেখা। এখন কঠিন সময়…আমাদের উদ্বেগ বুঝতে ট্রাম্পের অক্ষমতা…সম্পর্কের মধ্যে কিছুটা ভাঁজ তৈরি করছে।
এদিকে, বৈঠকের পর পাকিস্তান জানিয়েছে, ট্রাম্প এবং মুনির সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা অব্যাহত রাখার বিষয়ে আলোচনা করেছেন, যার অধীনে আমেরিকা পূর্বে ন্যাটো-বহির্ভূত মার্কিন মিত্র পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে এবং সম্পর্ক আরও জোরদার করার উপায় নিয়ে আলোচনা করেছে।
দুই কর্মকর্তা বলেন, এতে নয়াদিল্লিতে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে যে, যদি আবারও সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তাহলে আমেরিকার কাছ থেকে পাকিস্তান যে কোনো অস্ত্র পেলে তা ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতে পারে।
কঠোর অবস্থান
ভারতীয় কর্মকর্তারা এবং একজন ভারতীয় শিল্প লবিস্ট রয়টার্সকে বলেছেন, ট্রাম্প এবং মোদির মধ্যে জনসমক্ষে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ভারত আমেরিকার বিরুদ্ধে কিছুটা কঠোর অবস্থান নিচ্ছে। বাণিজ্য আলোচনাও ধীর হয়ে গেছে।
রয়টার্স জানিয়েছে, জুন মাসে কানাডায় জি৭ বৈঠকের পর ট্রাম্পের সফরের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন মোদি। এই মাসের শুরুতে নয়াদিল্লি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপের প্রস্তাবও করেছিল। এটি দেখায় যে, ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের পর বাণিজ্য আলোচনা ততটা সুষ্ঠুভাবে এগোচ্ছে না।
ভারতের অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন থিঙ্ক ট্যাঙ্কের পররাষ্ট্র নীতি প্রধান হর্ষ পন্ত বলেন, অন্যান্য দেশের মতো ভারতও ট্রাম্পের সঙ্গে মোকাবিলা করার উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে এবং চীনের সাথে সম্পর্ক পুনর্গঠন করছে।
তিনি বলেন, ‘নিশ্চিতভাবেই চীনের সাথে যোগাযোগের একটি সুযোগ রয়েছে এবং আমি মনে করি এটি পারস্পরিক…চীনও আমাদের সাথে যোগাযোগ করছে।’
২০২০ সালে ভারত ও চীনা সেনাদের মধ্যে এক মারাত্মক সীমান্ত সংঘর্ষের পর গত সপ্তাহে ভারতের জয়শঙ্কর প্রথমবারের মতো বেইজিং সফর করেন। সেই সংঘর্ষের পর চীন থেকে বিনিয়োগের ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ শিথিল করার জন্যও ভারত এখন পদক্ষেপ নিচ্ছে। চীনের সঙ্গে ভারতের কণ্টকাকীর্ণ সম্পর্ক এবং পাকিস্তানের প্রতি বেইজিংয়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও সামরিক সহায়তা সত্ত্বেও এই বরফ গলানোর ঘটনাগুলো ঘটেছে।
নিউ ইয়র্কের আলবানি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক ক্রিস্টোফার ক্ল্যারি বলেছেন, পাকিস্তানে চীনের সাহায্য এবং বাংলাদেশের মতো ভারতের নিকটবর্তী অন্যান্য স্থানে চীনের প্রভাব বৃদ্ধির কারণে ভারত উদ্বিগ্ন। তবুও নয়াদিল্লি মূলত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের প্রতিক্রিয়ায় নিকটতম প্রতিবেশীদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা উচিত, চীনের ওপর নয়।’