হোম অন্যান্যলিড নিউজ ভাঙছে তিস্তা, কাঁদছে অসহায় মানুষ

ভাঙছে তিস্তা, কাঁদছে অসহায় মানুষ

কর্তৃক
০ মন্তব্য 83 ভিউজ

অনলাইন ডেস্ক :

তীব্র ভাঙনে দিশেহারা লালমনিরহাটের তিস্তাপাড়ের হাজারো পরিবার। চোখের সামনে প্রিয় বসতভিটা হারিয়ে কাঁদছে তিস্তার বামতীরের মানুষ।

জানা গেছে, তিস্তা আর ধরলা নদী বেষ্টিত জেলা লালমনিরহাটে জুন থেকে থেমে থেমে বন্যা চলমান রয়েছে। টানা ৪/৫ দিন পানিবন্দি থেকে মুক্তি মিলতে না মিলতে আবারো পানিবন্দি হচ্ছে মানুষ। গত সপ্তাহে টানা ৫ দিন ডুবে থেকে মুক্তি মিলে জেলার প্রায় ৩০ হাজার পরিবারের। এভাবে থেমে থেমে বন্যায় ফসলসহ ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে জেলাবাসী।

জন্ম থেকে খনন না করায় তিস্তা ও ধরলা নদীর তলদেশ পলি ও বালু জমে ভরাট হয়ে গেছে। ফলে উজানের পাহাড়ি ঢল ও সামান্য বৃষ্টিতে পানি প্রবাহের পথ না পেয়ে নদীর দু-কূল উপছে বন্যায় প্লাবিত হয় লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলা। প্রতিবছর বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে জেলার অর্থনীতিকে পঙ্গু করেছে এই দুই নদী।

বন্যার পানি নেমে গেলে ভয়াবহ ভাঙনের মুখে পড়ে তিস্তা পাড়ের হাজারো পরিবার। চোখের সামনে নদী গিলে খাচ্ছে নদীপাড়ের মানুষের বসতভিটা, ফসলি জমি ও স্থাপনা। ভাঙনের কবলে পড়ে প্রতি বছর নিঃস্ব হচ্ছে নদীপাড়ের মানুষ। ফলে ফসলহানীসহ দিন দিন চরম অর্থ কষ্টে পড়ছে এসব ছিন্নমূল মানুষ। একবার দুইবার নয়, জীবনে ২০/২৫ বার বসতভিটা সরাতে হয়েছে নদীর কড়াল গ্রাস থেকে।

সারা বছরের উপার্জনের সঞ্চিত অর্থে নতুন করেন বসতভিটা তৈরি করলেও তা এক বছরের মাথায় আবারো নদীর গর্ভে চলে যাচ্ছে। প্রিয় বসতভিটা হারিয়ে কেউ কেউ জমি ভাড়া নিয়ে ঘর তুলে কোনো রকম বসবাস করছেন। অনেকেই রাস্তার পাশে বা বাঁধের ধারে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। যা এক বা দুই বছরের মাথায় আবারো নদীর কড়াল গ্রাসের মুখে পড়ছে।

ভাঙন কবলিতদের পুনবাসনের জন্য সরকারিভাবে ৭ হাজার টাকা দেওয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম বলে দাবি ক্ষতিগ্রস্তদের। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর থেকে সদর উপজেলার চর গোকুন্ডা, আদিতমারী উপজেলার বাহাদুরপাড়া, চন্ডিমারী, কুটিরপাড়, কালীগঞ্জের আমিনগঞ্জ, হাতীবান্ধার গড্ডিমারী, ডাউয়াবাড়ি, সির্ন্দুনা ও সানিয়াজানে তিস্তা নদীর ভাঙন তীব্র আকার ধারন করেছে। ঝুঁকিতে পড়েছে সলেডি স্প্যার বাঁধসহ সব বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ। মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে আদিতমারীর কুটিরপাড়া ও বাহাদুরপাড়া গ্রামের বালুর বাঁধ।

আদিতমারী উপজেলার কুটিরপাড় গ্রামে এক রাতেই তিস্তায় বিলিন হয়েছে ৭টি বসতভিটা। গ্রামবাসী রাতেই ঘরবাড়ি সরিয়ে পাশে রাস্তায় ফেলে রেখেছেন। জায়গার অভাবে তারা ঘর উঠাতে পারছেন না। পাশের বাড়ির উঠানে পলিথিনের নিচে বসবাস করছেন তাদের একজন রহিমা বেগম।

তিনি বলেন, গ্রামবাসীর হাতে পায়ে ধরে ঘর দুইটা সরিয়ে রাস্তায় রেখেছি। স্বামী মরণব্যাধী ক্যানসারে শয্যাশায়ী। ভাড়া জমিতে করা বসতভিটাও তিস্তার পেটে। এখন বাড়ি করার কোনো জায়গা নেই। ছেলে মেয়েদের নিয়ে কোথায় যাই।

একই গ্রামের অজিয়ার রহমান (৮৫) ভেঙে যাওয়া বসতভিটার পাশে বসে কাঁদছেন। তার কান্নায় বাতাস ভারি হলেও তিস্তার হিংস্র স্রোত যেন তা শুনতেই পাচ্ছে না। এ বৃদ্ধের কান্না পৌঁছে না দেশের নীতিনির্ধারণীদের কাছে।

তিনি বলেন, জীবনে সব কামাই (আয়) তিস্তার পেটে গেল। ২২/২৩ বার বাড়ি ভাঙতে হয়েছে। তেরান (ত্রাণ) চাই না, নদী খনন করে স্থায়ী বাঁধ চাই। যেন ডেডা (ঝুপরি ঘর) পাতি থাকবার পাই। পুত্তিবছর (প্রতিবছর) সরকার বস্তা ফেলায় আর ভাসি যায়। তেরান দেয়। এগুলা না করিয়া নদী খনন করি বাঁধ দেওয়া হউক। তাইলে হামরা আবাদ সুবাদ করি খাবার পামো বাহে। নইলে মরা ছাড়া কোনো উপায় নাই।

ভাঙনের মুখে পড়া গ্রামটির বাসিন্দা হবিবুর রহমান, আসাদুল বলেন, কুটিরপাড় বালুর বাঁধ থেকে চন্ডিমারী স্প্যার বাঁধ পর্যন্ত এলাকার কিছু অংশে জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। বাকি অংশ টুকুতেও জরুরিভাবে জিও ব্যাগ ফেলা দরকার। নয়তো পুরো কুটিরপাড় গ্রাম ও বালুর বাঁধটি যেকোনো সময় তিস্তায় বিলীন হবে।

তিস্তা নদী খনন করে দুই তীরে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণে নদীপাড়ের মানুষের দীর্ঘদিনের একটি দাবি। লালমনিরহাট ২ আসনের সংসদ সদস্য সমাজ কল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ নির্বাচনের সময় তিস্তার স্থায়ী সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেন। যা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। তবে দীর্ঘদিনের সেই দাবি পূরণের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন তিস্তাপাড়ের মানুষ। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এসব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় জানিয়েছে জেলায় ২৩৬ পরিবার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছেন। যাদের প্রত্যেক পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য ৭ হাজার করে টাকা দেওয়া হচ্ছে। তবে স্থানীয়দের দাবি তিস্তা আর ধরলার ভাঙনের শিকার হয়েছে এক হাজারেরও বেশি পরিবার।

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর জানান, ভাঙনের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় জিও ব্যাগ দিয়ে রক্ষার চেষ্টা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর প্রত্যেককে ৭ হাজার টাকা ও ২০ কেজি চাল দেওয়া হচ্ছে। তবে তিস্তা নদী খনন করে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের একটি প্রকল্প দেওয়া আছে। তা একনেকে অনুমোদন হলে তিস্তাপাড়ের মানুষের দুঃখ ঘুচবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন