মাহমুদুল হাসান শাওন, দেবহাটা:
লাইভস্টক অ্যান্ড ডেইরি ডেভেলপমেন্ট প্রোজেক্টের আওতায় সাতক্ষীরার দেবহাটায় হাঁস, মুরগি ও ছাগলের ঘর নির্মাণে সরকারি বরাদ্দের ১৬ লাখ ২০ হাজার টাকা খামারিদের মাঝে বিতরণ না করে পকেটে ভরার অভিযোগ উঠেছে উপজেলা ও জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসারদের বিরুদ্ধে।
হাঁস-মুরগির প্রতিটি ঘর নির্মাণে ৩০ জন খামারির প্রত্যেকের জন্য ২০ হাজার টাকা ও ছাগলের ঘর নির্মাণে ৪০ জন খামারির প্রত্যেকের জন্য ২৫ হাজার ৫’শ টাকা করে সরকারিভাবে বরাদ্দ দেয়া হলেও সম্প্রতি বদলি হওয়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডা. মো. তৌহিদুল ইসলাম, প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ অফিসার ও এ প্রকল্প অফিসার ডা. মো. নাজমুল হোসাইন এবং বর্তমান জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডা. এসএম মাহবুবুর রহমান যোগসাজোসে খামারিদের নামে বরাদ্দের টাকা তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে না দিয়ে প্রথমে পকেটে ভরেন, এবং পরে বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ খামারিরা গণমাধ্যমকর্মী ও প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করলে বরাদ্দের তুলনায় অতি সামান্য টাকায় নিন্মমানের সামগ্রী দিয়ে খামারিদের বাড়িতে হাঁস-মুরগি ও ছাগলের ঘর তৈরি করে দেয়ার পায়তারায় মেতেছেন।
খামারিরা অভিযোগ করেন, চলতি অর্থবছরে দেবহাটা উপজেলায় পিজি গ্রুপের ৩০ জন খামারির বাড়িতে হাঁস-মুরগির ঘর নির্মাণের জন্য ২০ হাজার টাকা করে সরকারি বরাদ্দ থাকলেও, সেই টাকা কোথায় আছে তা জানেন না খামারিদের কেউই। আর ৪০জন খামারির বাড়িতে ছাগলের ঘর নির্মাণে প্রত্যেকের জন্য ২৫ হাজার ৫’শ টাকা করে দেয়া সরকারি বরাদ্দের টাকাও আজ অবদি পৌঁছায়নি খামারিদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। তা উত্তোলন করে পকেটে ভরেছেন প্রাণিসম্পদ অফিসাররা। পরে বিষয়টি নিয়ে খামারিদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে ২৫ হাজার ৫’শ টাকার স্থলে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকার মধ্যে নিন্মমানের কিছু নির্মাণ সমাগ্রী কয়েকজন খামারিদের বাড়িতে পৌঁছে ঘর নির্মাণ করে দিতে চাইছেন প্রাণিসম্পদ অফিসাররা। বাকি টাকা এসব দুর্নীতিবাজ অফিসাররা নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
প্রকল্প এলাকা দেবহাটা উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অধীনস্থ লাইভস্টক অ্যান্ড ডেইরি ডেভেলপমেন্ট প্রোজেক্টটি প্রকল্প হিসেবে ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময় দেবহাটা উপজেলায় উপজেলা ভিত্তিক হাঁস-মুরগি ও ছাগল পালনে খামারিদের সমন্বয়ে একটি করে পিজি গ্রুপ এবং ইউনিয়ন ওয়ারী আরও অন্তত পাঁচটি পিজি গ্রুপ গঠন করা হয়। চলতি বছরে এ উপজেলায় হাঁস-মুরগি পিজি গ্রুপের খামারিদের বাড়িতে ঘর নির্মাণের জন্য ৬ লাখ টাকা এবং ছাগল পালন পিজি গ্রুপের খামারিদের বাড়িতে টিনের ঘর নির্মাণের জন্য ১০লাখ ২০ হাজার টাকা সরকারি বরাদ্দ আসে। হাঁস-মুরিগির ঘর নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেয়া ৬ লাখ টাকার ছিটেফোঁটাও পৌঁছায়নি ৩০জন খামারির কাছে।
আর ছাগলের খামারিদের প্রতিটি ঘরের জন্য ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও প্রজ্ঞাপনে বলা হয় খামারিরা এর সঙ্গে ইচ্ছামতো টাকা বিনিয়োগ করে প্রয়োজনানুসরে ঘর বড় করে নির্মাণ করতে পারবেন। আর সেই টাকা প্রত্যেক খামারির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সম্প্রতি বদলী হওয়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডা. তৌহিদুল ইসলাম এবং এ প্রকল্পের দায়িত্বে প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ অফিসার ডা. মো. নাজমুল হোসাইন মাস তিনেক আগে ৪০ জন খামারির কাছ থেকে নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়ে বরাদ্দের টাকা খামারিদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে না পাঠিয়ে উত্তোলন করে পকেটে ভরেন। একপর্যায়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রাণিসম্পদ অফিসার ডা. মো. তৌহিদুল ইসলামকে অন্যত্র বদলি করা হলে সমস্ত টাকা চলে যায় প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ অফিসার ডা. মো. নাজমুল হোসাইন ও জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডা. এসএম মাহবুবুর রহমানের কাছে। একইসাথে উপজেলায় মুখ থুবড়ে পড়ে সরকারের এ উন্নয়ন প্রকল্প।
ছাগল পালন পিজি গ্রুপের খামারিদের মধ্যে কুলিয়া ইউনিয়নের আয়েশা খাতুন বলেন, মাস তিনেক আগে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসাররা এক প্রকার জোর করেই নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে খামারিদের সঁই করিয়ে নেয়। নিয়ম অনুযায়ী বরাদ্দের ২৫ হাজার ৫’শ টাকা আমাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দেয়ার কথা ছিল। আমরা তাতে আরও বিনিয়োগ করে ইচ্ছেমতো বড় ঘর নির্মাণ করতে পারতাম। কিন্তু আমাদের অ্যাকাউন্টে টাকা দেয়া হয়নি। সম্প্রতি আমরা এনিয়ে আন্দোলন করলে অফিসাররা তাদের লোক দিয়ে অতি নিন্মমানের সামগ্রী ব্যবহার করে কেবলমাত্র আমার ঘরটি নির্মাণ করে দিয়েছে। এখন এই ছাগলের ঘর আমার কোনো কাজে আসছে না।
নাজমা খাতুন নামে আরেক খামারি বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় শেষ হতে গেলেও আমরা আমাদের ছাগলের ঘর তৈরিতে সরকারি বরাদ্দের টাকা হাতে পাইনি। আমরা নিজেদের ইচ্ছেমতো সরকারি ওই বরাদ্দের টাকায় ছাগলের ঘর তৈরি করতে চেয়েছিলাম বলেই আমাদের টাকা দেয়া হয়নি। আমরা আন্দোলন শুরু করলে সম্প্রতি অফিসাররা বলেছিলেন আমরা ঘর তৈরি করলে তাদের মনের মতো হবে না। তাই তারাই লোক দিয়ে ঘর বানিয়ে দিবে। কয়েকদিন আগে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা মুল্যমানের কিছু নিন্মমানের নির্মাণ সামগ্রী আমার বাড়িতে পাঠিয়েছেন।
এসব নির্মাণ সামগ্রীর মধ্যে কি কি দেয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৭০ পিস ইট, ১৭ কেজি সিমেন্ট, ৪টি নিন্মমানের রেডিমেড কংক্রিটের খুটি, ৪ পিস পাতলা ঢেউটিন, ৪ সিএফটি’র মতো অ-পোক্ত সিরিস কাঠের তক্তা পাঠিয়েছে প্রাণিসম্পদ অফিসাররা।
দুর্নীতি-অনিয়মের এ বিষয়ে জানতে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে যেয়ে এ প্রকল্পের দায়িত্ব প্রাপ্ত প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ অফিসার ডা. নাজমুল হোসাইনের দেখা পাওয়া গেলেও তিনি সাংবাদিকদের সামনে মুখ খোলেননি।
সাতক্ষীরা জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডা. এসএম মাহবুবুর রহমান বলেন, খামারিরা ঘর তৈরি করলে অনেক সময় আমাদের মনের মতো হয়না, হয়তোবা সেজন্যই দেবহাটা উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের অফিসাররা নিজেদের তত্বাবধানে ঘর নির্মাণ করে দিতে চেয়েছিলেন। নীতিমালা লংঘন করে খামারিদের টাকা তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে না পাঠিয়ে অফিসারদের পকেটে ভরে রাখার কোন বিধান আছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বরাদ্দের টাকা গচ্ছিত আছে, শিগগিরই এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে দেয়া হবে।