হোম অর্থ ও বাণিজ্য পণ্যের দাম বেজোড় সংখ্যায়, ক্রেতা ফেরত পান না অবশিষ্ট টাকা

বাণিজ্য ডেস্ক:

যেকোনও পণ্যের দামে প্রায়ই দেখা যায় বেজোড় সংখ্যা। এর পেছনের মূল কারণ কি শুধুই মার্কেটিং পলিসি? যদি তা-ই হয়, তাহলে তা কতটুকু নৈতিক কিংবা অনৈতিক— এ বিষয়ে পরিষ্কার কিছুই জানা নেই কোনও ভোক্তার। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, পণ্যের গায়ে মূল্য দেওয়া থাকে ৯৯, ৯৯৯ কিংবা ২,৯৯৯। এ ক্ষেত্রে ক্রেতাদের মধ্যেও যেমন এক টাকা ফেরত নেওয়ার চাহিদা থাকে না, অপরদিকে বিক্রেতাদের মধ্যেও দেখা যায়— এক টাকা ফেরত দেওয়ার অনীহা।

রাজধানীর বিভিন্ন শপিং মল ও শো-রুমে সরেজমিনে দেখা যায়, পণ্যের মূল্যের এই চিত্র।

জানতে চাইলে আরএফএলের বেস্ট বাই মিরপুর ১-এর ম্যানেজার সুমন বলেন, ‘আমাদের প্রোডাক্টের মূল যে দাম, তার ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট যুক্ত করে যে দাম আসে, সেটাই আমরা লিখে রাখি। ক্রেতা আরএফএলের পণ্য কেনার পর আর ভ্যাট যুক্ত করা হয় না, আগে থেকেই ইনক্লুড করা থাকে। আর যেটার দাম ৯৯ টাকা, সেটা আমরা ১ টাকা ফেরত দিই। কখনও কখনও ১ টাকা কম রাখি। কিন্তু কাস্টমারের থেকে এক টাকা বেশি রাখি না।’

ইয়েলো শো রুমের বিক্রেতা জানান, ভ্যাট যুক্ত করায় পণ্যের দাম এমন হয়। টোটাল দাম থেকে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ বাদ দিলে পণ্যের মূল দাম থাকবে। যেসব পণ্যের দামের সঙ্গে পয়সাও (৩৪৬৪ দশমিক ৬৩ টাকা) যুক্ত হয়, সে ক্ষেত্রে ৫০ পয়সার ওপরে হলে এক টাকা কাউন্ট করা হয়।

মিরপুরে বাটার শো রুমের ম্যানেজার নাজমুল বলেন, ‘আমাদের প্রোডাক্টের প্রাইসের সঙ্গে ভ্যাট যুক্ত করা রয়েছে। প্রাইস কেন এমন রাখা হয়, সেটা আমার ঠিক জানা নেই। এটা মার্কেটিং পলিসি হতে পারে। এ ব্যাপারে তারা ভালো বলতে পারবেন। আর আমাদের এখানে পণ্য কেনার পর যে খুচরা টাকা হয়, ক্রেতাকে সেটা ফেরত দিয়ে দিই। আমাদের খুচরা টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত খুচরা পয়সা বা টাকা রাখা হয়। তবে অনেক সময় কাস্টমার এক বা দুই টাকা না নিয়েই চলে যান। আমরা কিন্তু ফেরত দিয়ে দিই।’

মো.আল আমিন এসেছিলেন বাটার শো রুম থেকে স্যান্ডেল কিনতে। তার পছন্দের স্যান্ডেলের দাম ২৯৯ টাকা। কিন্তু তার কাছ থেকে রাখা হয়েছে ৩০০ টাকা। তিনি বলেন, ‘আমি দাম জিজ্ঞেস করলে বলেছেন ২৯৯ টাকা, কিন্তু এক টাকা আর ফেরত দেয়নি, আমিও আর চাইনি। এরা মাঝেমধ্যে ফেরত দেয়। তবে বেশির ভাগ সময়ই দেয় না।’

নিলয় নামে একজন শিক্ষার্থী বাটা থেকে জুতা কিনেছেন ৩ হাজার ৯৯৯ টাকা দিয়ে। তিনি বলেন, ‘আমি ৪ হাজার টাকা দিয়েছি। কিন্তু এক টাকা ফেরত পাইনি। কখনোই পাই না। বিকাশে দিলে প্রাইস অনুযায়ী দেওয়া যায়, ক্যাশে দিলে ফেরত পাই না।’

বিষয়টি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামানের নজরে আনা হলে তিনি বলেন, ‘পণ্যের দামের বিষয়টি নির্ভর করে। এ ক্ষেত্রে এথিকাল বা আন-এথিকাল কিছু নেই। এ রকমই হতেই পারে। প্রোডাক্টের দাম ৪৯৯ বা ৯৯৯ টাকা, এগুলো হচ্ছে তাদের বিজনেস স্ট্র্যাটেজি। এখানে আবার একটা সাইকোলজিক্যাল ব্যাপারও আছে। যদি কোনও কিছুর দাম ৪৯৯ টাকা হয়, তখন মনে হয় দামটা ৪০০ টাকার মধ্যেই আছে। কিন্তু যদি দাম হয় ৫০০ টাকা হয়, তখন মনে হবে দাম বেশি হয়ে গেছে। আসলে পার্থক্য হচ্ছে এক টাকার।’

তিনি আরও বলেন, ‘যদি প্রোডাক্ট কেনার পর ওই এক টাকা ফেরত না দেয়, বা একটি চকলেট ধরিয়ে দেওয়া হয়, সেটা হবে আন-এথিক্যাল।’

অনেক সময় ক্রেতা তার পাওনা এক টাকা ফেরত নেন না, আবার বিক্রেতারাও ফেরত দেন না, এই প্রশ্নে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) বলেন, ‘এখন এমন একটা সময়, যখন ১০ টাকা ভিক্ষা দিলেও খুব খারাপ দৃষ্টিতে তাকাবে যে, মাত্র ১০ টাকা দিলেন! এছাড়া এক টাকাকে এখন কেউ ভ্যালু দেয় না। কিন্তু এ রকম এক টাকা করে হিসাব করলে অনেক বড় অঙ্ক দাঁড়াবে।’

পণ্যের মূল্য বেজোড় সংখ্যায় নির্ধারণের কারণ প্রসঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘একটা জিনিসের দাম যদি এক হাজার টাকা হয়, তাহলে সেটা সহস্রের ঘরে চলে যায়। কিন্তু যদি সেটা ৯৯৯ টাকা হয়, তাহলে সেটা কিন্তু শতকের ঘরেই থাকলো। এক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনও কিছুর দাম ৯৯৯ টাকা হলে সেটা নিচের দিকে টানবে এবং এক হাজার টাকা হলে সেটা ওপরের দিকে টানবে। এটা হচ্ছে একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার। আর এ ধরনের মূল্য নির্ধারণকে বলে সাইকোলজিক্যাল প্রাইসিং বা মনস্তাত্ত্বিক মূল্য নির্ধারণ।’

তিনি আরও বলেন,‘‘আরেকটা জিনিস দেখা গেছে যে, ভোক্তারা কম দামের থেকে ন্যায্য দাম বেশি পছন্দ করে। একটা হচ্ছে ‘ফেয়ার প্রাইস’ আরেকটা হচ্ছে ‘লো প্রাইস’। ভোক্তারা লো প্রাইসের থেকে ফেয়ার প্রাইসটাই বেশি পছন্দ করে। একটা গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যদি কোনও একটা পণ্যের দাম ২০ টাকা করা হয়, আবার একই পণ্যের দাম একটু বুদ্ধি খাটিয়ে ২১ দশমিক ৩৫ টাকা করা হয়, সে ক্ষেত্রে ২০ টাকা যেহেতু কম, সেটাই ভোক্তার নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভোক্তা সেটা নেয় না, সে নেয় যেটার দাম ২১ দশমিক ৩৫ টাকা। কারণ ভোক্তা ভাবে যেটার দাম ২০ টাকা সেটা হয়তো আন্দাজের ওপর বেশি দাম রাখছে। যেটার দাম ২১.৩৫ টাকা সেটা খুব হিসাব করে অ্যাকুরেট দাম রাখা হচ্ছে। তাই ন্যায্য দাম ভেবে ভোক্তা বেশি দামেরটাই গ্রহণ করে। এটাও একটা সাইকোলজিক্যাল ফ্যাক্টর। এটা অনেক আগে থেকেই চলছে। এক সময় এটা খুব কাজ করতো। কিন্তু এখন মানুষ মার্কেটিং নিয়ে পড়াশোনা করছে, অনলাইনে এসব নিয়ে পড়ছে, তাই বুঝে গেছে যে, এটা একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার।তাই এর ইমপ্যাক্টও অনেক কমে গেছে।’’

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন