হোম খেলাধুলা ৮ বছর আগে নিজের ‘প্রথম’ ম্যাচেই সেঞ্চুরি করেছিলেন মিরাজ

সংকল্প ডেক্স :

ঘরের মাঠে ২০১৬ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ দিয়ে পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছিলেন মেহেদি হাসান মিরাজ। সেই আসরে ব্যাট হাতে ৬ ম্যাচে ৪ ফিফটিতে ২৪২ রান এবং বল হাতে ১২ উইকেট নিয়ে জিতেছিলেন টুর্নামেন্টসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। সে বছর আইসিসির ফিউচার স্টার প্রোগ্রামে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় ‘পরবর্তী সাকিব আল হাসান’ হিসেবে।

সেই বিশ্বকাপের পেরিয়ে গেছে পাঁচ বছর। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের তারকা মিরাজ, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও কাটিয়ে ফেলেছেন পাঁচটি বছর। যুব ক্রিকেটে ব্যাটসম্যান হিসেবে বাজিমাত করলেও, বড়দের ক্রিকেটে তার পরিচয়টা যেন শুধুই অফস্পিনার, যিনি ব্যাটিংটাও পারেন টুকটাক। যে কারণে আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রথম সেঞ্চুরি পেতে লাগল পাঁচ বছর, এ সময়ে তিন ফরম্যাট মিরাজ খেলেছেন ৮০টি ম্যাচ।

আজ (বৃহস্পতিবার) চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে প্রায় পৌনে চার ঘণ্টা (২২৭) ব্যাটিং করে ১৬৮ বলে ১০৩ রানের ইনিংস খেলেছেন মিরাজ। যেখানে ছিল ১৩টি চারের মার। প্রতিপক্ষ দলের প্রায় সব বোলারকেই খেলেছেন দারুণ দক্ষতার সঙ্গে, সফল হতে দেননি ক্যারিবীয়দের রান আটকে উইকেট তুলে নেয়ার পরিকল্পনা। যা দিয়েছে মিরাজের ব্যাটিং সামর্থ্যের প্রমাণ।

অথচ স্বীকৃত ক্রিকেটে নিজের প্রথম ইনিংসেই সেঞ্চুরি করেছিলেন মিরাজ, তাও কি না ২০১৩ সালে! বাংলাদেশ লেখা জার্সি গায়ে প্রথম ২০১৩ সালে কোনো ম্যাচ খেলেছেন মিরাজ। তার বয়স তখন ছিল মাত্র ১৫ বছর। ২০১৩ সালের এপ্রিলে শ্রীলঙ্কান যুবাদের বিপক্ষে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় সেই ১৫ বছরের কিশোরের, যেখানে খেলেন ১০৫ রানের ইনিংস।

সেই ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ৪২২ রান করে কুশল মেন্ডিসের নেতৃত্বাধীন লঙ্কান যুব দল। জবাবে বাংলাদেশের যুবারা করে ৩৯৭ রান। তিন নম্বরে ব্যাট করতে পাঠানো হয় মিরাজকে। অধিনায়ক মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতের সঙ্গে চতুর্থ উইকেটে গড়েন ১৬৬ রানের জুটি। সাজঘরে ফেরার আগে সেঞ্চুরি তুলে নিয়ে ১৭১ বলে করেন ১০৫ রান।

সবমিলিয়ে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে ৪ যুব টেস্টে ২৫০ এবং ৫৬ যুব ওয়ানডেতে ১৩০৫ রান করেন মিরাজ। সহজাত নেতৃত্বগুণ এবং দলের দায়িত্ব নেয়ার সামর্থ্যে আস্থা রেখে ২০১৬ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে তাকেই করা হয় বাংলাদেশ যুব দলের অধিনায়ক। সেই আসরে তৃতীয় হয় বাংলাদেশের যুবারা। উদ্ভাসিত পারফরম্যান্সের পুরস্কারস্বরুপ সে বছরের অক্টোবরেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্বাদ পেয়ে যান মিরাজ।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে তাকে অনেকটা চমক হিসেবেই ব্যবহার করেন তৎকালীন কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। পরিকল্পনায় সফল হন তিনি, দুই ম্যাচ সিরিজে ১৯ উইকেট নিয়ে রেকর্ড গড়েন মিরাজ। কিন্তু এটি মিরাজের ক্যারিয়ারের জন্য হয়ে যায় নেতিবাচক। বোলিং জানা ব্যাটিং অলরাউন্ডার থেকে রীতিমত বিশেষজ্ঞ স্পিনার বানিয়ে ফেলা হয় তাকে। যে কারণে জাতীয় দলে ব্যাটিংয়ের সুযোগও যায় কমে।

২০১৩ সালে যুব টেস্টের সেই সেঞ্চুরির পর যুব ক্রিকেটে ৩টি টেস্ট ও ৫৬টি ওয়ানডে খেলেছেন মিরাজ। চলতি ম্যাচের আগে আন্তর্জাতিক মঞ্চে টেস্ট খেলেছেন ২২টি, ওয়ানডে ৪৪টি, আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ১৩টি। এছাড়া প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ার ৪০ ম্যাচের, লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ ৯৩ আর টি-টোয়েন্টি ৭৫ ম্যাচের। সবমিলিয়ে স্বীকৃত ক্রিকেটে ২৪৭ ইনিংসের দীর্ঘ অপেক্ষার পর আবার তিনি পেলেন সেঞ্চুরির দেখা।

বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতেই সাজঘরে ফেরেন লিটন দাস, প্রায় নতুন বল হাতে তখন আক্রমণে গতির ঝড় তোলা শ্যানন গ্যাব্রিয়েল- মেহেদি মিরাজের জন্য চ্যালেঞ্জটা ছিল বেশ কঠিন। তবে গ্যাব্রিয়েলের মুখোমুখি তৃতীয় বলে বাউন্সার ডেলিভারিতে দারুণ দক্ষতায় পয়েন্ট অঞ্চল দিয়ে চার মেরে লড়াইয়ের জন্য নিজেকে প্রস্তত ঘোষণা করেন তিনি।

এরপর অগ্রজ সতীর্থ সাকিব আল হাসানের সঙ্গে খেলতে থাকেন রানের চাকা সচল রেখে। জোমেল ওয়ারিকানকে সুইপ কিংবা কেমার রোচের ফুল লেন্থের ডেলিভারি অনড্রাইভে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে আত্মবিশ্বাসের জানান দিয়েছেন ২৩ বছর বয়সী এ স্পিনিং অলরাউন্ডার। তার ইনিংসের সেরা শট ছিল ইনিংসের ১১৭তম ওভারে। জোমেল ওয়ারিকানের মিডল-লেগস্ট্যাম্পের ডেলিভারিতে ইনসাইড আউট শটে এক্সট্রা কভার দিয়ে দৃষ্টিনন্দন এক বাউন্ডারি হাঁকান তিনি।

মধ্যাহ্ন বিরতির সময় মিরাজ অপরাজিত থাকেন ৪৬ রানে। দ্বিতীয় সেশনে ফিরে কর্নওয়ালের ওভারে প্রথমে থার্ড ম্যানে ৩ রান নিয়ে পৌছান ৪৯ রানে, পরে ফাইন লেগ দিয়ে ২ রান নিয়ে পূরণ করেন ক্যারিয়ারের তৃতীয় ফিফটি। ব্যক্তিগত পঞ্চাশের আগে অবশ্য ২৪ রানের মাথায় জীবন পেয়েছিলেন তিনি। ওয়ারিকানের বলে সিলি পয়েন্টে তার ক্যাচ ছেড়ে দেন ক্যারিবীয়দের অভিষিক্ত খেলোয়াড় শেন মোজলি।

ফিফটির পরেও দুইবার ‘সুযোগ’ পেয়েছেন মিরাজ। ব্যক্তিগত ৭১ রানের সময় উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে খেলতে গিয়ে বেঁচে যান স্ট্যাম্পিংয়ের হাত থেকে আর ৮৫ রানের মাথায় তার ক্যাচ হাতে রাখতে পারেননি কর্নওয়াল। এ তিনটি ডেলিভারির ঘটনা বাদ দিলে পুরো পৌনে চার ঘণ্টায় দুর্দান্ত ছিলেন মিরাজ। ক্যারিবীয়দের সকল পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়ে রান করতে থাকেন আপন গতিতে।

বাংলাদেশের ইনিংসের ১৪৮তম ওভারে প্যাডল সুইপে দুই রান নিয়ে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিন অঙ্কের ম্যাজিক ফিগার স্পর্শ করেন মিরাজ। প্যাডল সুইপ করা বলটি ফাইন লেগে যেতেই নিশ্চিত হয় তার সেঞ্চুরি, এক রান পূরণ করেই আনন্দে লাফিয়ে ওঠেন তিনি। সেই বলে সুযোগ ছিল দ্বিতীয় রান নেয়ার, নেন সেটিও। এটিই যেন ভালো হলো, সেঞ্চুরির পূর্ণ উদযাপনটা নিজেদের ড্রেসিংরুমকে সামনে রেখেই করেন মিরাজ।

হেলমেট খুলে, দুই হাত উঁচিয়ে মুখে বড় হাসিতে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি উদযাপন সারলেন তিনি, ভোলেননি শুকরিয়া সিজদাহ দেয়ার কথাও। নিঃসন্দেহে তখন বিশ্বের অন্যতম সুখী মানুষটির নামই মেহেদি মিরাজ। নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরির পাশাপাশি দলের সংগ্রহটা দারুণ অবস্থানে পৌঁছে দেয়ার পর আনন্দের আতিশয্য যে তারই মানায়!

জোমেল ওয়ারিকানের করা ১৪৮তম ওভারের শুরুতে মিরাজ অপরাজিত ছিলেন ৯৩ রানে। প্রথম বলেই চার মেরে পৌঁছে যান ৯৭ রানে, পরের বলে নেন আরও ২ রান। সেঞ্চুরির জন্য তাড়া দেখাননি, তৃতীয় বল খেলেন ডট। চতুর্থ বলে প্যাডেল সুইপ করেই পৌঁছে যান ম্যাজিক ফিগারে।

বাংলাদেশের পক্ষে ষষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে আট নম্বর বা তার নিচে নেমে টেস্ট সেঞ্চুরি করলেন মিরাজ। তার আগে মোহাম্মদ রফিক, খালেদ মাসুদ পাইলট, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, আবুল হাসান রাজু ও সোহাগ গাজীদের রয়েছে এ কীর্তি। তাদের পাশে নিজের নাম বসিয়ে দলীয় সংগ্রহটাও ৪৩০ রানে নিয়ে গেছেন ২৩ বছর বয়সী এ স্পিনিং অলরাউন্ডার।

বাংলাদেশ ইনিংসের ৯৩তম ওভারের দ্বিতীয় বলে উইকেটে গিয়ে শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে মিরাজ আউট হন ১৫১তম ওভারের দ্বিতীয় বলে। মাঝের ৫৮ ওভারে দল পেয়েছে ১৮২ রান, যেখানে মিরাজের একার অবদান ১০৩।

প্রায় পৌনে ৪ ঘণ্টা উইকেটে থেকে ১৬৮ বল মোকাবিলা করে ১০৩ রানের ইনিংসটি খেলেছেন মিরাজ। যেখানে ছিল ১৩টি চারের মার, ছিল না কোনো ছক্কা। শেষপর্যন্ত অবশ্য আউট হয়েছেন ছক্কা হাঁকাতে গিয়েই। রাহকিম কর্নওয়ালের বলে ধরা পড়েছেন লংঅনে দাঁড়ানো কাভেম হজের হাতে।

বাংলাদেশের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ তথা যুব টেস্টে সেঞ্চুরি করেছেন ছয় ব্যাটসম্যান। তারা হলেন- অমিত মজুমদার, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত, মাহমুদুল হাসান জয়, জয়রাজ শেখ, রনি তালুকদার ও মেহেদি মিরাজ। এ ছয়জনের মধ্যে মিরাজই একমাত্র, যিনি সেঞ্চুরি করলেন আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটেও। সবমিলিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের পক্ষে ২২তম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান মিরাজ।

s

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন