বিনোদন ডেস্ক :
হাওয়া সিনেমার হাওয়ায় দুলছে সারা দেশ। হাওয়া মানে অনুভূতি, হাওয়া মানে শিহরণ। হাওয়া মানে জল ও গভীর সমুদ্রের গল্প। হাওয়া হলো মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত প্রথম সিনেমা।
যে সিনেমা নিয়েই এখন তোলপাড় চলছে মিডিয়া অঙ্গনে। সবার মুখে মুখে হাওয়া, হাওয়ার গান। চায়ের দোকানে, বন্ধুদের আড্ডায় কিংবা অফিস-আদালতে বাজছে হাওয়া সিনেমার গান। ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে মেঘদল ব্যান্ডের হাওয়া সিনেমাকে উৎসর্গ করে গাওয়া গান ‘এ হাওয়া’। এ যেন ঘোর, গভীর ঘোর।
যে ঘোর শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। বাংলা নাটকে চিরাচরিত ধারা থেকে বেরিয়ে ভিন্ন ভিন্ন গল্পের বুননে একের পর এক প্রশংসিত, আলোচিত নাটক নিমার্ণ করে তিনি তার মেধা ও মননের পরিচয় দেন। ‘আমি অরুপার কাছে যাচ্ছি’ নাটকের মাধ্যমে প্রথম যাত্রা শুরু করেন এ তরুণ নির্মাতা। তার কাজ মানেই অন্যরকম এক ভালো লাগা।
২০০৬ সাল থেকে ২০১০ সাল অব্দি তিনি ফিকশনের সঙ্গে যুক্ত থেকে পরে বিজ্ঞাপন নির্মাণে মনোনিবেশ করেন। বিজ্ঞাপন শুরুর পর তিনি আর নাটক নিমার্ণ করেননি। তার নির্মিত প্রায় সবগুলো বিজ্ঞাপনই দর্শকদের মন কেড়ে নিয়েছে। বিশেষ করে সেনাবাহিনীর ওপর বিজ্ঞাপনচিত্রটি বেশ সাড়া ফেলেছিল। এমনকি ‘অসম্ভব কে সম্ভব করাই, অনন্ত জলিলের কাজ’ এ জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনটির নির্মাতাও তিনি।
প্রায় ১০-১২ বছর ধরে টিভি বিজ্ঞাপন বানাচ্ছেন প্রতিভাবান এ নির্মাতা। তবে এর মধ্যে অনেকবার সিনেমা বানানোর চেষ্টা করেও বানাতে পারেননি। অবশেষে ২০১৭ সালে হাওয়া লিখে, ২০১৯ সালে শুটিং শুরু করেন; ২০২২ এ এসে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর মুক্তি দিচ্ছেন তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘হাওয়া’।
যে হাওয়ায় বাংলা চলচ্চিত্রের হাওয়া বদলের আশ্বাস পাচ্ছেন সিনেমাপ্রেমীরা, সে হাওয়ার হাওয়া হয়ে ওঠা ও হাওয়ার গল্প নিয়েই সময় সংবাদের সঙ্গে কথা বলেছেন এ সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় বিজ্ঞাপন নির্মাতা ও মিডিয়া অঙ্গনে অন্যতম প্রিয় ব্যক্তিত্ব মেজবাউর রহমান সুমন।
জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে ‘মাতাল হাওয়া’র গল্প লিখেছিলেন। সে সময়ের উত্তাল পরিস্থিতির কারণেই তিনি বইয়ের নামকরণ করেন মাতাল হাওয়া। আর এ সময়ে এসে মেজবাউর রহমান সুমন সমুদ্রের উত্তাল পরিস্থিতি ও জেলেদের না ফেরার গল্প নিয়ে নিমার্ণ করেন হাওয়া। তবে তার সিনেমার নামকরণের কারণ আসলে কী?
গল্পটা স্থলের না, জলের। গভীর সমুদ্রের। এ কারণেই কী সিনেমার নাম হাওয়া? না-কি জীবনের কোনো বিশেষ মুহূর্তের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে হাওয়া?
হাওয়ার হাওয়া হয়ে ওঠার কারণ জানতে চাইলে নির্মাতা মেজবাউর রহমান সুমন বলেন, চিত্রনাট্য থেকে শুরু করে হাওয়ার শুটিং পর্যন্ত কোনো একটা সময়ে আমরা হাওয়া নামটা নির্বাচন করেছি। তবে অনেকগুলো নামের মধ্য দিয়েই এই নির্বাচন প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন হয়েছে। শেষমেষ আমরা হাওয়ায় এসে আটকেছি।
আর হাওয়া কেন? এটা বলতে গেলে বলতে হয়, এটা একটা অনুভূতি। যেমন ধরেন আমার নাম সুমন। নামটা দিয়েছেন আমার বাবা-মা। কিন্তু কেউ যখন ‘সুমন ভাই’ বলে ডাকে তখন তা আমার ভিতরে একটা অনুভূতি তৈরি করে। এটাকে দার্শনিকভাবে বলতে গেলে সম্পর্কের ভিতরে যে হাওয়া, প্রতিশোধ ও বিভেদের মধ্যে যে হাওয়া, নৌকার পালে যে হাওয়া, তারপর কেন হাওয়া তা সিনেমা দেখলে হয়তো বোঝা যাবে।
এতো বছর পর নিজের প্রথম সিনেমা বানানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত আমি ফিকশন বানিয়েছি। এরপর আমি প্রায় ১০-১২ বছর টিভি বিজ্ঞাপন বানিয়েছি। তবে সিনেমা বানানোর চেষ্টা আমি বারবার করেছি। ২০১২ সালে আমি একটা সিনেমার স্ক্রিপ্ট রেডি করেছিলাম। প্রায় এক বছরের মতো কাজ করার পর আমার মনে হলো আমি এ গল্পটা নিয়ে সিনেমা বানাতে চাই না। তারপর ২০১৫ তে গিয়ে আমি আরেকটা গল্প লিখি যেটা হাওয়ার সাথে বেশ কানেক্টেড। কারণ সেখান থেকেই অনুপ্রেরণা পেয়ে আমি ২০১৭ সালে এসে হাওয়া লিখেছিলাম। সবশেষে ২০১৭ সালে শুরু করে ২০২২ এ এসে তা বানিয়ে ফেললাম। মূলত বলা যায় করে ফেললাম। প্রায় ৫ বছরের জার্নি। এর মধ্যে চিত্রনাট্য, লোকেশন র্যাকি, শ্যুট, প্যানডামিকসহ এমন নানা পরিস্থিতির পর তৈরি হলো আজকের এ হাওয়া।
চলচ্চিত্রটি প্রসঙ্গে নির্মাতা মেজবাউর রহমান সুমন বলেন, ‘হাওয়া’ হচ্ছে এ কালের রূপকথার গল্প। যে রূপকথার প্রধান উপাদান সমুদ্র, ঢেউ আর একটি ট্রলার। আবহমান কাল ধরে চলে আসা যে রূপকথা আমরা শুনে এসেছি সেই রূপকথা ’হাওয়া’ নয়, তবে এ চলচ্চিত্রে রূপকথা স্বয়ং নিজে এসে আধুনিক রূপে হাজির হয়। এ সময়ের যে অস্থিরতা, তা থেকে বেরিয়ে এসে এক ধরনের ধ্যানমগ্ন নির্মল যাত্রার নাম ‘হাওয়া’।
তিনি আরও বলেন, এটি মাটির গল্প নয় বরং পানির গল্প, সমুদ্রের গল্প। সমুদ্র এমন এক বিশালতার নাম যার পাড়ে বসে আমরা সাধারণ মানুষ এর সৌন্দর্য দেখি, রোমান্টিসিজমে ভুগি। কিন্তু গভীর সমুদ্রের গল্প জানতে পারি না। এর পাড়ের মানুষগুলোর গল্প জানলেও জানি না সমুদ্রে চলাচলরত মানুষগুলোর ভেতরের গল্প। সেখান থেকে ফেরার গল্প হয়তো জানি, কিন্তু না ফেরার গল্প আমরা কয়টা জানি? এ না জানা মৌলিক গল্পটিই আমি আমার এ সিনেমার মাধ্যমে জানাতে চাই।
‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানটা হাওয়া সিনেমায় আবির্ভাবের কারণ জানতে চাইলে নির্মাতা বলেন, এ গানটা আমার ছাত্রজীবনের গান। সে সময়ে শোনা গান। এ গানের শক্তি আমি তখনই টের পেয়েছিলাম। ইভেন শুধু এ গান না, হাশিম ভাইয়ের আরও অনেকগুলা গান আমি জানি। হাশিম ভাইয়ের সঙ্গে অনেক সন্ধ্যা কাটিয়েছি। উনার গান শুনেছি। উনার সাথে বাজিয়েছি। আসলে হাশিম ভাইয়ের গানের শক্তি কিন্তু আমি এখন টের পাইনি। ছাত্রজীবনেই টের পেয়েছিলাম। যখন আমি আমার হাওয়ার চিত্রনাট্য লিখছিলাম তখনই আমার মনে হয়েছে, হাশিম ভাইয়ের এ গানটা আমার গল্পের সাথে যায়। এবং আমি এটা খুব ভালো করে জানতাম যে, এই গান যখনই বের হবে তখনই মানুষ পছন্দ করবে। কিন্তু মানুষ এটা এতোটা পছন্দ করবে যে, মানুষের ঘরে ঘরে চলে যাবে, গ্রাম থেকে গ্রামে, শহর থেকে শহরে পৌঁছে যাবে, উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত সবাই শুনবে তা কখনো ভাবিনি। তবে এ গানের শক্তি সম্পর্কে আমার দৃঢ় ধারণা ছিল।
সম্প্রতি মেঘদল ব্যান্ড ‘এ হাওয়া’ গান মুক্তি দিয়েছে। এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, মেঘদলের ‘এ হাওয়া’ ও ‘হাওয়া’ সিনেমা একই সময়ে তৈরি হওয়া বিষয়। আমি নিজেও মেঘদলের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও জানতাম না বিষয়টা। খুবই কাকতালীয়ভাবে এটা মিলে গেছে। আমি যখন হাওয়ার চিত্রনাট্য লিখছি তখন শিবু এ হাওয়া গানটা লিখে। অথচ দুজনের কেউই দুজনের গান বা চিত্রনাট্য সম্পর্কে জানতাম না। আমার সিনেমার নাম ‘হাওয়া’ ও শিবুর গানের নাম ‘এ হাওয়া’ কীভাবে যে মিলে গেল তাতে আমরা নিজেরাও অবাক! এটা সম্ভবত অনেক বছরের বন্ধুত্বের কারণে হয়েছে। বন্ধুত্বের যোগাযোগটা অদ্ভুত যোগাযোগ। টেলিপ্যাথি বলেন আর যা-ই বলেন, এটা হয়ে যায়। তবে এটা কিন্তু সিনেমার গান না, সিনেমা উপলক্ষে মেঘদল ব্যান্ডের উৎসর্গ করা গান।
সবশেষে দর্শকদের কাছে নির্মাতা হিসেবে তার চাহিদা জানতে চাইলে তিনি মজার ছলে বলেই ফেলেন, দর্শক সিনেমাটি দেখলে দেখবে, না দেখলেও আফসোস নেই। কেননা, সিনেমা মুক্তি পাওয়ার আগেই দর্শক তার সিনেমাকে যে হাওয়ার সাগরে ভাসিয়েছেন, তাতে তার আর কোনো চাওয়া নেই।
নির্মাতা মেজবাউর রহমান সুমনের পরিচালনায় ‘হাওয়া’র বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী, নাজিফা তুষি, শরিফুল রাজ, সুমন আনোয়ার, নাসির উদ্দিন খান, সোহেল মণ্ডল, বাবলু বোস ও রিজভী রিজু। চলচ্চিত্রটির চিত্রগ্রহণ করেছেন কামরুল হাসান খসরু, সম্পাদনা সজল অলক, আবহসংগীত রাশিদ শরীফ শোয়েব, গানের সংগীতায়োজন করেছেন ইমন চৌধুরী।
আগামী (২৯ জুলাই) শুক্রবার দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত সিনেমা ‘হাওয়া’।