রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী :
৮০ এর দশকের কথা। একদিন পড়ন্ত বিকালে এক ভদ্রলোক বাইসাইকেল চালিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লেন। সাইকেল থেকে নেমেই তিনি দিদি দিদি বলে ডাক শুরু করলেন। মাথায় ছিলো কুকড়ানো লম্বা চুল। পরনে ছিল সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবী। আমার বিধবা মা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। ভদ্রলোকটি মাকে প্রণাম করে জড়িয়ে ধরলেন। সদ্য স্বামীহারা অশ্রুসিক্ত আমার বিধবা মাকে ভদ্রলোকটি সান্তনা দিচ্ছিলেন। কুশলাদি বিনিময়কালে মা জানতে চাইলেন, “আলাউদ্দীন কোথা থেকে আসলি?” প্রতিউত্তরে তিনি বললেন, “দিদি তালা থেকে আসলাম। বাড়ি ফেরার পথে মনে হলো তোকে দেখে যাই। তাই আসলাম।” আমি তখন প্রাইমারী স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কেবল হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছি। তালা উপজেলার কলাপোতা গ্রামের আমার পৈত্রিক বাড়িতে প্রথম যে ব্যক্তিকে দেখলাম, তিনি হলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা স. ম আলাউদ্দীন।
মায়ের মুখ থেকে শুনেছি, আমার মেঝ মামা অঞ্জন রায়ের সাথে স. ম আলাউদ্দীনের ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব। মামার বাড়ি তালা উপজেলার সরুলিয়া গ্রামে, আর স. ম আলাউদ্দীনের বাড়ি মিঠাবাড়ি গ্রামে। দু’জনই একই স্কুলে লেখাপড়া করতেন। সেই সূত্রে বন্ধুত্বের ঘনিষ্ঠতা। ছাত্রজীবনে আমার মামার বাড়িতে প্রায়শ: আলাউদ্দীন সাহেবের উঠাবসা ছিল। সেকারণেই তিনি বন্ধুর বড়বোন আমার মাকে দিদি বলে ডাকতেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি সক্রিয় রাজনীতির সাথে জড়িয়ে ছিলেন। তালা উপজেলার প্রতিটি গ্রাম-মহল্লা ছিল তার রাজনীতির চারণভূমি। মাঝেমধ্যে তিনি আমাদের বাড়িতেও আসতেন। মানুষের সুখ-দু:খের খোঁজখবর নিতেন। আওয়ামী লীগের কোনো কর্মী-সমর্থক বিপদে পড়লে তিনি তার সাহায্য করার চেষ্টা করতেন। কোনো কাজে তার কাছে কেউ আসলে নিরাশ হতেন না। এখন যেমন কোনো নেতার কাছে কাজের জন্য আসলে পকেট ভর্তি টাকা নিয়ে আসতে হয়, তখন ছিলো উল্টো। রাজনৈতিক জীবনে স.ম আলাউদ্দিনের ইমেজ ছিলো খুবই উজ্জ্বল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাও তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করার সুযোগ পেত না।
৮৫ সালের শেষের দিকে আমাদের পৈত্রিক জমির বিবাদকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হলো। আমাদের পক্ষে ছিল তালা উপজেলার কলাপোতা, কেশা, ধলবাড়িয়া ও আমানুল্লাহপুর গ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ লোকজন। অপরপক্ষে ছিলেন তৎকালীন তালা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান প্রয়াত বিএনপি নেতা এবিএম আলতাফ হোসেনের সমর্থিত গ্রুপ। এ ঘটনায় থানায় পাল্টা পাল্টি মামলা হলো। কিন্তু এ মামলায় তালা উপজেলার ফৌজদারি আদালতে আমাদের পক্ষের লোকজন আত্মসমর্পন করে জামিনের আবেদন করলে, বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট জামিনের আবেদন নাকোচ করে আসামীদের জেল-হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তখন সাতক্ষীরা জেলা কারাগার ছিলো জেলা প্রশাসকের বাসভবন সংলগ্ন বর্তমান লেডিস ক্লাব। এলাকার লোকজন হাজতবাস করছে। তারা অধিকাংশ ছিল আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী ও সমর্থক। দলের নেতারা কারাগরে অন্তরীণ কর্মী-সমর্থকদের খোঁজ খবর নিতেন। স. ম আলাউদ্দীন জেলগেটে গিয়ে দলের কর্মী সমর্থকদের সাথে কথা বলে আসতেন। পুরাতন কোর্টের সামনে ছিল আজাদ হোটেল। জেল-হাজতের অন্তরীণ দলীয় কর্মী-সমর্থকদের জন্য আজাদ হোটেল থেকে মাঝেমধ্যে রান্না করা খাবার পাঠিয়ে দিতেন। একদিন তিনি নিজেই হোটেল থেকে রান্না করা খাবার জেলগেটে নিয়ে যাওয়ার সময় গামলা থেকে উপচে পড়া ডালে তার পরিহিত সাদা জামা হলুদ হয়ে গেল। প্রকৃতঅর্থে, একজন আপদমস্তক রাজনীতিবীদ ছিলেন স. ম আলাউদ্দীন। দলের কর্মী-সমর্থকরা তাকে অগাধ ভালোবাসতেন।
১৯৯৬ সালের ১৯ জুন, তার নিজ হাতে গড়া দৈনিক পত্রদূত অফিসে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন বীর মুক্তিযোদ্ধা স. ম আলাউদ্দীন। এর কয়েক মাস পর আমি নিজেই সাংবাদিকতা পেশায় জড়িয়ে পড়ি। শহীদ স. ম আলাউদ্দীন হত্যার বিচারের দাবীতে মিছিল-মিটিং এ অংশ নিয়েছি। পত্রিকায় লেখালেখি করেছি। কিন্তু আজও আলাউদ্দীন হত্যার বিচার হয়নি। বিচারের বানী যেন নীরবে নিভৃতে কাঁদে। জীবদ্দশায় স. ম আলাউদ্দীন সাহবেকে মামা বলে ডাকতাম। তার সাতক্ষীরা শহরের লস্কারপাড়া বাসভবনে কয়েকবার এসেছি। সমস্যার কথা বললে তিনি সাথে সাথে টেলিফোন করে দিতেন। একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তার মধ্যে যে আন্তরিকতা ছিল তা কখনও ভুলবার নয়। নির্লোভ মানুষটি আজও স্মৃতিতে অম্লান হয়ে রয়েছে।
লেখক পরিচিতি : আরটিভি সাতক্ষীরা জেলা প্রতিনিধি ও সম্পাদক (সংকল্প নিউজ)