শিক্ষা ডেস্ক :
স্বপ্ন একজন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। একজন মানুষ ঠিক ততটাই বড় যতটা তার স্বপ্ন বড়। আমাদের দেশের তরুণ শিক্ষার্থীরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে।
তরুণরা দেশের সম্পদ। স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শেষ করে অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা জীবনের একটা সময়ে গিয়ে হতাশায় ডুবে যায়। মূলত চাকরি-বাকরির দুশ্চিন্তা থেকে এ-হতাশার শুরু হয়। তবে বর্তমানে এ চিত্র খানিকটা হলেও পাল্টিয়েছে। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে অনেক সফল উদ্যোক্তা উঠে আসে। নিজেরা স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অনেকে। ঠিক তেমনই এক তরুণ উদ্যোক্তার গল্প তুলে ধরার চেষ্টা নিয়ে এই ফিচার।
সুরাইয়া ইয়াসমিন। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিভাগের শিক্ষার্থী। স্বপ্ন দেখা- উদ্যোক্তা হওয়া নিয়ে। স্বাধীন ভাবে কাজ করা যেন এক ভালো লাগার বিষয় সে ছোটবেলা থেকেই। গতাণুগতিক চিন্তা ধারার বাইরে গিয়ে তিনি ভালোবাসেন সৃষ্টিশীল কোন কিছু করার। সে চিন্তা থেকে উদ্যোক্তা হওয়ার পথচলা।
২০১৮ সালে স্নাতক ৩য় বর্ষে পড়াশোনাকালীন এই উদ্যোক্তা হওয়ার ঝোঁকটা আরও প্রবল হয়। স্বপ্ন দেখেন, এবং সে স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য শুরু করেন নিজের প্রচেষ্টা শুরু করেন নিজের উদ্যোগ। শ্রম ও মেধা দিয়ে অটল নিজের স্বপ্নের ওপরে।
উদ্যোক্তা জীবনের শুরু নিয়ে তিনি বলেন, ‘আর্ট এবং ক্রাফটের প্রতি আমার ভালোবাসা ছিল সবসময়ই। সেই ভালোবাসার হাত ধরে জন্ম হলো আমার প্রতিষ্ঠান ‘সুকন্যা’র’। ভাবলাম, অনলাইনের সহজলভ্যতা এবং সুযোগ সুবিধাকে কাজ লাগানোর এখনই সময়। এ ভেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘সুকন্যা’ নামে একটি পেইজ খুলি। শুরুটা হয়েছিল হাতে আঁকা টিপ দিয়ে। তারপর একটু ভিন্নতা আনলাম। নতুন কিছু আনার চেষ্টা করলাম। হাতে তৈরি শৌখিন গয়না, হাতে আঁকা পোশাক। তখন এত বেশি অর্ডার পেতাম যে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রমে সমস্যা হতো। তখন ঠিক করলাম স্নাতক শেষ হলে তারপর কাজ শুরু করব। তাই সুকন্যার পথ চলার প্রায় আটমাস পরে বন্ধ করে দেওয়া হয় সকল কার্যক্রম। এখানে আমার ভালোলাগার কারণ ছিল। অচেনা কিছু মানুষ আমার কাজ দেখে মুগ্ধ হচ্ছে, ভালোবাসছে, ভরসা করে পেমেন্ট করছে।’
‘দ্বিতীয় ধাপে কাজ শুরু করলাম ২০২০ এর মার্চ মাসে। ২০২০ সালে করোনাকালীন শুরু হয়। মহামারি! পুরো বিশ্ব স্তব্ধ। লকডাউন! পুরো দেশ অচল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। তখন চিন্তা করছিলাম আমার প্রতিষ্ঠানের যাত্রা না হয় পুনরায় শুরু করা যাক। মাঝখানে প্রায় ১ বছর বন্ধ থাকার পর আবার শুরু করলাম সুকন্যার কার্যক্রম। তবে এবার ভাবলাম সুকন্যার কাজে ভিন্নতা আনা যায়। আমাদের যশোরের আদি শিল্প হচ্ছে- ‘সূচিশিল্প’। শৈশব থেকে দেখে এসেছি কীভাবে একেকটা নকশীকাঁথা তৈরি হয়। ছোট থেকে দেখার কারণে আমি নিজেই সবগুলো সেলাই পারি। প্রথমে নিজেই ডিজাইন করে ফেসবুকে পোস্ট করতাম। অর্ডার হলে অ্যাডভান্স পেমেন্টের টাকা দিয়ে আবার কাপড় কিনে কাজ করে ডেলিভারি দিতাম। এভাবে ধীরে ধীরে আবার পথচলতে শুরু করে সুকন্যা। করোনার দীর্ঘ ছুটিতে অবসর পেয়ে পুরো দমে চলছে সুকন্যার কাজ। এসময়ে উদ্যোক্তা হয়ে নিজের কাজের পাশাপাশি অনেক বেকারের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন সুকন্যার সুরাইয়া। গ্রাহকসংখ্যা ছড়িয়েছে দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায়। বেড়েছে গ্রাহকদের আস্থা।’
‘এই পথে সবসময় দুজন আমার পাশে ছায়ার মতো ছিলেন, অনুপ্রেরণা, ভালবাসা এবং সবমিলিয়ে বিভিন্ন সময় ভরসা দিয়ে তারা হলেন মা ও ছোট বোন।’
তিনি আরও বলেন, ‘মাত্র ২৬০ টাকা মূলধন নিয়ে শুরু করে এখন প্রতি মাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকার পণ্য উৎপাদন করছি। বর্তমানে আমরা হস্তশিল্পের পোশাক, যেমন: শাড়ি, থ্রিপিস, রেডি কুর্তি পাঞ্জাবি এগুলো নিয়ে কাজ করছি। এর সাথে হোম ডেকর আইটেম নকশীকাঁথা, কুশন এগুলোও উৎপাদন করছি। যশোর অঞ্চলের অরজিনাল নকশীকাঁথা , যেগুলো ২০-৩০ বছর আগে উৎপাদন হতো সেগুলো আবার উৎপাদন শুরু করছি।’
বর্তমানে উদ্যোক্তা সুরাইয়া ইয়াসমিনের উদ্যোগের সাথে কাজ করছেন ৩০ জনের বেশি কর্মী। এরা সবাই গ্রামের মহিলা কিংবা স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থী। অধিকাংশই হতদরিদ্র পরিবারের। তাদের সংসারের চলে সেলাই-এর টাকা দিয়ে। অনেকেই পড়াশোনা করছে সেলাইয়ের টাকা দিয়ে। মহামারির কারণে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের আয় বন্ধ থাকার কারণে সেলাইয়ের ওপরে পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন তারা। সুকন্যার লক্ষ্য এসব প্রান্তিক নারীদের অবস্থার উন্নয়ন করা, তাদের প্রাপ্য মজুরি নিশ্চিত করা।
নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে সুরাইয়া বলেন, ‘আমি যেহেতু অনুজীব বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী, তাই আমার পড়াশোনাকে কিভাবে আমার উদ্যোগে কাজে লাগানো যায় সেটা নিয়ে আরও পড়াশোনা করছি’। তিনি আরও বলেন, একটা সময় নারীরা শুধু ঘরের কাজের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিল। বর্তমান নারীর ক্ষমতায়নের ফলে ঘরের গণ্ডি পেরিয়ে এখন দৃষ্টি রাখছে তারা বহু দূরে।
লিখেছেন, ইকবাল মনোয়ার
ইংরেজি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়