জাতীয় ডেস্ক :
গত ১৮ আগস্ট, বুধবার রাত সাড়ে ১০টায় বরিশালের ইউএনও এবং বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এই দুই পক্ষের সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে তা আপনারা সবাই জানেন। কিছু জনশ্রুতিতে জানা যাচ্ছে, তাদের ব্যক্তিগত রেষারেষিতে এমন ঘটনা ঘটেছে। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী জানা যায়, দুই দফায় জেলা ছাত্রলীগের কয়েকশ’ নেতাকর্মী (ইউএনও) সরকারি বাসভবনে হামলা চালায়। তাকে গালিগালাজ করেছিল এবং তার বাসায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেছিল।
সংবাদপত্রের খবরে আরও জানা যায়, খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। এরপর তারা পুলিশের ওপরও চড়াও হয় এবং ইউএনও’র নির্দেশে আনসার সদস্যরা নেতাকর্মীদের ওপর গুলি ছুড়েছে। এভাবে পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষে অনেকে আহত হয়েছেন। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, ইউএনও সাহেব মনে করছেন এটা মেয়র সাহেব করিয়েছেন। এ জন্য তিনি তার বিরুদ্ধে একটা মামলা করেছেন। আবার মেয়র সাহেবের বিরুদ্ধে পুলিশ একটা মামলা করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে, পরিস্থিতি সামাল দিতে অতিরিক্ত পুলিশ ও র্যাব মোতায়েন করা হয়েছে, যাতে আরও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে। এই হলো ঘটনাটা।
আমি মনে করি, এ রকম ঘটনা রাজনৈতিক এক দল বা দুই দলের মধ্যে হওয়াটা স্বাভাবিক। পৃথিবীতে এরকম শত শত উদাহরণ আছে। বিশেষ করে, আমাদের মতো উদীয়মান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যারা আমরা পরিচিত। মধ্যম আয়ের দেশের গ্রুপে যাচ্ছি আমরা। এমনকি উন্নত দেশগুলোতেও দুই দল কিংবা এক দলের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে মামলা দেওয়ার ঘটনা আছে।
যারা সাধারণ ব্যক্তি এবং যারা আইনকানুন নিয়ে লেখাপড়া করেন, তারা জানেন যে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে, বাংলাদেশে স্বাধীনতার আগে ও পরে এমন ঘটনা ঘটেছে। স্বাধীনতার আগে রূপ ছিল ভিন্ন কিন্তু স্বাধীনতার পরে এমন ঘটনা খুব বেশি ঘটেনি, তবে ঘটেছে। তবে সাধারণভাবে বোঝা যায় যে, এটা লোকাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, ডিসি এবং কমিশনার, তাদের মাধ্যমে এই ব্যাপারটাকে সুরাহা করা যেত। তবে ঘটনার ভয়াবহতা নিয়ে স্থানীয় সরকারের যারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আছে, তারা বোধ হয় যাতে অবস্থার অবনতি না সে জন্য এই ব্যবস্থাটা করেছে। এবং মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশে যেখানেই হোক না কেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হলে সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাবে। পুলিশ যাবে, র্যাব যাবে এবং প্রয়োজনে বিজিপি যাবে, এটাই স্বাভাবিক। যাতে পরিবেশের শান্তি শৃঙ্খলা বজায় থাকে।
ইতিহাসে দেখা গেছে, একই দলের ভেতরে স্বার্থ নিয়ে, জমি নিয়ে এবং সম্পত্তি নিয়ে এরকম কলহ হয়েছে এবং হয়। ইউরোপের ইতালিতে এটা খুব খারাপভাবে দেখা গিয়েছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে। তখন একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক ছিলেন আন্তোনিও গ্রামসি। তিনি এরকম ঘটনার প্রতিবাদ করেছিলেন বলে তাকে জেলে দেওয়া হয়েছিল। এবং তিনি সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। জেলে বসে তিনি তার বিখ্যাত বই লিখলেন, প্রিসন নোটবুকস (Prison Notebooks)। এই বই সম্পর্কে সাহিত্য রসিকরা ঠাট্টা করে বলে, গ্রামসিকে জেলে দিয়ে মানবজাতির উপকার হয়েছে। জেলে দেওয়া ঠিক হয়নি, তার সাথে অন্যায় হয়েছে। কিন্তু জেলে না দিলে এই প্রখ্যাত বইটি আমরা পেতাম না। তিনি এই বইতে বিভিন্ন গল্প, বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন, তার ভেতরে একটি দেশে একই সরকার বা সরকারের ভিন্নপন্থী বা সরকারপন্থীর একই দলের ভেতরে গোলমাল হয়েছে বা হতে পারে। তার মতে, এরকম গোলমাল হওয়াটা ভালো না, সমীচীন না, সরকার চালাতে সমস্যা হয়। তাহলে এর একটা সুরাহা পেতে হবে।
তিনি বলেছেন, যারা সমাজে জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি আছে, তাদের নিয়ে একটা সংগঠন করে এরকমের সমস্যার সমাধান করা উচিত। জেলায় জেলায় বা জেলার ভেতরে, এলাকার ভেতরে এরকম সমস্যা সমাধানে সংগঠন করা যায়।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হয়তো আগামী দশ-বিশ বছর পরে সমাজ বিজ্ঞানীরা এ ঘটনা নিয়ে লিখবেন। যেরকম আমরা এখনও লিখছি বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যার ওপরে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে আমরা লিখছি ও গবেষণা করছি। এবং লিখে যাব, এই লেখা শত শত বছর ধরে চলবে। যে রকম চলছে এখনও আব্রাহাম লিংকনের মৃত্যু এবং তার মৃত্যুর পরের ইতিহাস অথবা মার্কিন ইতিহাসের সংবিধান। যে সংবিধান অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে শেষ হলো তখন কিছু লোকজন জিজ্ঞাসা করল বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনকে (Benjamin Franklin) যে আপনারা কী করলেন, আপনাদের দেশ কিভাবে চলবে? তিনি তখন উত্তর দিলেন, আমাদের দেশ হবে একটি রিপাবলিক, একটু থেমে আবার বললেন, এটি রিপাবলিক হবে যদি আপনারা এটিকে চালাতে পারেন। কাজেই বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন দায়িত্ব দিলেন জনগণের ওপরে, সরকারের ওপরে না।
আমরা তুলনা করছি এই জন্য যে, সরকারের যে দায়িত্ব সেটা বর্তমান সরকার সবকিছুই করছেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আমাদের সরকার। কিন্তু পঞ্চাশ বছর পরে অর্থাৎ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর পরও যদি আমাদের লোকাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে আমরা গুছিয়ে আনতে না পারি, এখনও আমাদের মধ্যে মারামারি, রেষারেষি, বিদ্বেষভাব থাকবে এটা কেন! এটা আমাদের ওভারকাম করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু আমাদের দেশ দিয়েছেন, গণতন্ত্র দিয়েছেন সেই গণতন্ত্রের গলাটিপে স্বাধীনতাবিরোধী কিছু চরিত্র, কিছু জেনারেল মেরে ফেলতে চেয়েছিল। অনেক জেনারেল আসল গেল। কিন্তু তারা গলাটিপে মারতে পারেনি। এক সময় কন্ট্রোল ডেমোক্রেসি করা হলো কয়েক বছরের জন্য ২০০৭-২০০৯। তারা অনেক ক্ষতি করল। স্বাধীনতাবিরোধী কিছু উচ্চবিলাসী আর্মি সদস্য এবং কিছু রাজনীতিবিদের চেষ্টাও ছিল কী করে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে রাখা যায়। এটাই ছিল তাদের চেষ্টা। কিন্তু জনগণের রায় ছিল উল্টা, তারা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে বিপুল ভোটে জয়ী করে নিয়ে আসল। বঙ্গবন্ধু আমাদের দিয়েছেন একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। সেই দেশকে সঠিকভাবে পরিচালনা করার দায়িত্ব আমাদের। কাজেই সব ধরনের চেষ্টা করতে হবে, এরকম জেলাওয়ারি সংঘর্ষ হবে, এত দূর হওয়ার আগেই স্থানীয় জনগণ এসে ঠিক করবে। তাহলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ আমরা গড়তে পারব। এটা শুধু ঢাকার সেন্ট্রাল গভর্মেন্টের দায়িত না এটা আমাদের সকলের দায়িত্ব।
লেখক: সাবেক সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়