হোম Uncategorized সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে রোগীর খাবার নিয়ে চলছে তুঘলকি কারবার

সংকল্প ডেস্ক :

সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল জেলার প্রায় ২৫ লাখ মানুষের আশা ভরসার জায়গা। সেই ভরসার জায়গাটিতে অনিয়ম দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে।

গুটিকয়েক কর্মচারীর পাশাপাশি ঠিকাদারের গ্যাড়াকলে দিনে দিনে প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এতে করে কর্মচারীরা ও ঠিকাদার আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেন। হাসপাতালে রাজস্ব খাতের অর্থ যাচ্ছে এক পিয়নের পকেটে।

এই পিয়ন এখন অফিস সহকারী। আলোচিত দুর্নীতিবাজ এই অফিস সহকারী নাম মাসুম বিল্লাহ। তিনি সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের প্রধান সহকারী কাম হিসাব রক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন।

সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের কেনাকাটায় রয়েছে ব্যাপক দূর্নীতি। একটি কলাপাকা কেনা হয় ৮ টাকা ৯০ পয়সা। একটি মুরগির ডিম কেনা হয় ১৫ টাকা ৭০ পয়সা। ১ কেজি চিনি কেনা হয় ৭৩ টাকায়। চালের কেজি ৫৪ টাকা ৫০ পয়সা। পোলাও চাউল ১ কেজি ১৬০ টাকা। আটা কেনা হয় ৪৫ টাকা কেজিতে। সেমাইয়ে কেজি ৬০ টাকা। চিনির কেজি ৭৩ টাকা। গুড়ো দুধের কেজি ১১১৫ টাকা। হরলিক্স এক কেজি ১৩৮৭ টাকা ৫০ পয়সা। মিষ্টি এক কেজি ৩১০ টাকা। ৮৫ গ্রাম পাউরুটি কেনা হয় ১৬ টাকাতে ৪৬ পয়সায়। পাউরুটি ৬০ গ্রাম ১১ টাকা ৬৪ পয়সা।

এক কেজি রুই বা কাতলা মাছ কেনা হয় ৫০০ টাকায়। পাংগাস টেংরা কেজি ৩৭৫ টাকা। কাপ মাছের কেজি ৪৭০ টাকা। তেলের কেজি ১৭৮ টাকা। লবণের কেজি ৩৫ টাকা। ডালের কেজি ১৫৪ টাকা। আলুর কেজি ৩১ টাকা। আদার কেজি ১৮০ টাকা। ১৬০ টাকা পেঁয়াজের কেজি ৫৯ টাকা। রসুনের কেজি ৯৭ টাকা। হলুদের কেজি ৪৭০ টাকা। জিরার কেজি ৮০০ টাকা। তরকারির কেজি ৩৫ টাকা। মরিচের কেজি ৩১০ টাকা। ডায়াবেটিকস রোগীদের জন্য খাসির মাংস প্রতি কেজি ৫৮৫ টাকা। মুরগির মাংস প্রতি কেজি ৪শ’ ৫৫ টাকা। তুষ কাঠের কেজি ১০ টাকা ৫০ পয়সা। অথচ বাজার মূল্য অনেক কম।

চার বছর ধরে বিনা টেন্ডারে রোগীর খাদ্য কেনা কাটা করার নানা অনিয়েমের অভিযোগ রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট অফিস সূত্রে জানা যায়, সিভিল সার্জন অফিস ২০১৫-১৬ অর্থ বছর থেকে ২০২০- ২১ অর্থ বছর পর্যন্ত দরপত্র আহবান না করে সদর হাসপাতালের প্রধান অফিস সহকারী কাম হিসাব রক্ষক মাসুম বিল্লাহ ( এম এল এস এস থেকে প্রধান অফিস সহকারী কাম হিসাব রক্ষক (অডিট আপত্তি আছে) যোগসাজশে নিয়মিত ঠিকাদারের বিল পরিশোধ করে যাচ্ছেন। একই ব্যক্তি বিভিন্ন নামে লাইসেন্স করা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের একজন স্বত্বাধিকারী আদালতে একটি মামলা করায় ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জন্য আদালত একটি অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।

এই অর্থ বছরের নিষেধাজ্ঞা আরোপে বাকি ৬ অর্থবছর রোগীদের দৈনন্দিন খাদ্য, পথ্য ও জ্বালানি সরবরাহের কাজের টেন্ডার না হওয়ায় ফলে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে রাম রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর সেই নিষেধাজ্ঞার ওপর ভর করে লম্বা হয়ে যায় সদর হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের রোগীদের দৈনন্দিন খাদ্য, পথ্য ও জ্বালানি সরবরাহকারী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের হাত। দুর্নীতির কবলে পড়ে আর দরপত্র আহবান করতে পারেননি সিভিল সার্জন অফিস। এতেই থেমে থাকেননি সুচতুর ঠিকাদার। তার দুর্নীতির কারণে এক অর্থ বছরের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ৬ অর্থবছর রোগীদের খাদ্য সরবরাহের টেন্ডার হতে দেননি। এভাবে প্রতি নিয়ত রোগীদের জন্য নিম্নমানের খাদ্য সরবরাহ করে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা।

হাসপালের সাধারণ রোগীর পাংগাস টেংরা দিয়ে একবেলার খাবার ৭৭ টাকা ১৬ পয়সা, রুই বা কাতলা দিয়ে ৭৭ টাকা ২৯ পয়সা, গøাস কাপ দিয়ে ৭৭ টাকা ৯ পয়সা, মুরগীর মাংস দিয়ে ৬৬ টাকা ৫০ পয়সা এবং খাসীর মাংস দিয়ে ৬৬ টাকা ৫০ পয়সা। সকালের নাস্তা চিড়া, পাকাকলা, চিনি ও মুরগির ডিম দিয়ে ৪২ টাকা ৯২ পয়সা।

হাসপালের ডায়াবেটিস রোগীর পাংগাস টেংরা দিয়ে একবেলার খাবার ৬৫ টাকা ৬৭ পয়সা, রুই বা কাতলা দিয়ে ৬৬ টাকা ৩০ পয়সা, গøাস কাপ দিয়ে ৬৬ টাকা ২৫ পয়সা, মুরগীর মাংস দিয়ে ৬৬ টাকা ৫০ পয়সা এবং খাসীর মাংস দিয়ে ৬৬ টাকা ৫৫ পয়সা। ডায়াবেটিস রোগীর সকালের নাস্তা রুটি, ডিম, কলা দিয়ে ৫৩ টাকা ৮০ পয়সা।

শনিবারে ও বৃহস্পতিবারে কাপ মাছ, রোববারে কাতলা মাছ, সোমবার, বুধবার ও শুক্রবারে মুরগির মাংস এবং মঙ্গলবারে রুই মাছ দেবার কথা। সিভিল সার্জন কাম তত্ত্বাবধায়কের কার্যালয় থেকে নির্দেশিত রোগীদের দৈনন্দিন খাদ্য, নাস্তা ও জ্বালানি সরবরাহের ব্যাপক গরমিল লক্ষ্য করা যায়।

প্রতিনিয়ত নিম্নমানের খাবার পরিবেশন করে যাচ্ছে ঠিকাদাররা। একদিকে রোগীরা জানান, সপ্তাহে ৩ দিন পোল্ট্রী মুরগির মাংস এবং বাকি দিন পোনা মাছ সহ তেলাপিয়া মাছ ও নিম্নমানের খাবার দেওয়া হয়।

সকালের খাবার সকাল ১০-১১ টার সময় এবং দুপুরে খাবার বিকেল ৪ টার সময় দেওয়া হয়। বাবুর্চি আব্দুল মান্নান মিঠু নিজে দায়িত্ব পালন না করে সুইপার, নাসিমা সাজেদা সহ ৪ জন ব্যক্তির দিয়ে রোগীদের খাদ্য পরিবেশন করায়। হাসপাতালে রোগীদের খাবার নিয়ে রয়েছে আরও অনেক তেলেসমাতি কারবার। সদর হাসপাতালে রান্নাঘর বা বাবুর্চিখানা এই ঠিকাদার ও বাবুর্চি আব্দুল মান্নান মিঠুর দখলে রয়েছে।

এই রান্না ঘরে বসবাস করেন মিঠু ও তার স্ত্রী সালেহা, ছেলে তুহিন, মেয়ে তুলি সহ তার মামাতো, ভাই চাচাতো ভাই ও কয়েকজন যুবক। রাত্রি যাপন ছাড়াও রোগীদের খাবার তারা খেয়ে থাকে। এই রান্না ঘরে ঘটে নারীঘটিত অনেক ঘটনা। বাবুর্চির মিঠুর প্রধান কাজ হাসপাতালে রোগী ভাগিয়ে বাইরের ক্লিনিকে রোগী পাঠানো। সে হার্ট ফাউন্ডেশন ও ইন্সেন্টিভ ক্লিনিকে রোগী পাঠিয়ে সেখান থেকে হাতিয়ে নেয় মোটা অংকের টাকা। রাত ৯টা ১০টার পর তালার পাটকেলঘাটা থেকে ‘গণবধূ’দের এনে রান্নাঘরে অবৈধ কাজ করায়। এই অবৈধ কাজের অন্যতম সহযোগী হল মাসুদা খাতুন ও রেজাউল ইসলাম বাবু।

সরেজমিনে যেয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের রোগীদের সকালের নাস্তা ছোট ৩-৪ পিস পাউরুটি দেওয়া হয় যার ওজন ৪০ থেকে ৫০ গ্রাম হবে। দুপুরের খাবার এক প্লেট ভাত, সাগরের পনির মতো এক চামচ পাতলা ডাউল ও তার সাথে এক পিস চোট মাছ যা ৩০ গ্রামও হবে না।

হাসপাতালে যারা ভর্তি থাকে তারা বেশিরভাগই গরিব রোগী। তাদের চিকিৎসার পাশাপাশি খাদ্য সরবরাহ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। খাদ্য মান নিয়ে সেহেতু রোগীদের অভিযোগ রয়েছে, তাই এতে করে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।

ঠিকাদার বলেন, সবকিছু অফিস জানে। মামলা করেছি আমার প্রত্যায়ন আছে। আর আমি কিছু বলতে পারব না। যা জানার, সিভিল সার্জন অফিস থেকে জেনে নেন। হাসপাতালের রোগীদের নিম্নমানের খাবার ও পরিমাণে কম দেওয়ার কথা জানতে তিনি বলেন, সিডিউল অনুযায়ী খাবার দেওয়া হয়। সিডিউল দেখতে চাইলে তিনি দেখাতে অপরগতা প্রকাশ করেন। পওে অফিস থেকে সিডিউল সংগ্রহ করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে সিভিল সার্জন একজন সৎ ও সফল কর্মকর্তা হলেও একজন প্রভাবশালী নেতার কারণে তিনি সঠিক ভাবে কাজ করতে পারছেন না। সিভিল সার্জন প্রভাবশালী নেতার কথা না শুনলে তাকে বদলী করা হবে।

সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও প্রভাবশালী একজন নেতার কারণে সিভিল সার্জনের হাত-পা বাঁধা রয়েছে বলে তিনি জানান। বিগত সিভিল সার্জনকেও চলে যেতে হয়েছে তাদের কথা না শোনার কারণে।

রোগীরা কর্তৃপক্ষের কাছে নিম্নমানের খাবার নিয়ে অভিযোগ করলেও মাথাব্যথা নেই কর্তৃপক্ষের।

একেতো নিম্নমানের খাবার তারপর পরিমাণেও কম দেওয়ার ঘটনা ঘটে অহরহ। অফিস কর্তৃপক্ষ মামলার গ্যাড়াকলে ফেলে নিজের আধিপত্য বিস্তার সহ সব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন ঠিকাদার।

আরো জানা যায়, দুর্নীতির কালো হাতের ছোঁয়ায় অফিস হারিয়ে ফেলেছে রোগীদের দৈনন্দিন খাদ্য, পথ্য ও জ্বালানি সরবরাহের দরপত্র আহবানের ফাইল।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন