আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে রাশিয়ার সঙ্গে সম্ভাব্য কোনও শান্তি চুক্তির আগে ইউক্রেন সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিবিএসের জনপ্রিয় ‘৬০ মিনিটস’ অনুষ্ঠানে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জেলেনস্কি বলেন, আপনার যেকোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অনুগ্রহ করে আমাদের দেশে আসুন। আসুন আমাদের নাগরিক, যোদ্ধা, হাসপাতাল, চার্চ এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত শিশুদের দেখে যান।
এই সাক্ষাৎকারটি ধারণ করা হয়েছিল রুশ বাহিনীর সুমি শহরে মিসাইল হামলার আগে। হামলায় অন্তত ৩৪ জন নিহত এবং ১১৭ জন আহত হয়। এটি ছিল চলতি বছরে ইউক্রেনে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা।
রাশিয়া এখন পর্যন্ত এই হামলা নিয়ে কোনও মন্তব্য করেনি। তবে ট্রাম্প বলেন, তিনি শুনেছেন এটি ‘একটি ভুল’ ছিল, যদিও এই বক্তব্যের উৎস তিনি স্পষ্ট করেননি।
জার্মানির সম্ভাব্য পরবর্তী চ্যান্সেলর ফ্রিডরিশ ম্যার্জ সুমি হামলাকে ‘গভীর যুদ্ধাপরাধ’ বলে অভিহিত করেছেন। জার্মান টেলিভিশন চ্যানেল এআরডিকে তিনি বলেন, এটি ছিল প্রতারণামূলক, পরিকল্পিত এবং একটি যুদ্ধাপরাধ।
যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক মিত্র। যুদ্ধের চতুর্থ বছরে পা রাখা এই সংঘাত থামাতে ট্রাম্প প্রশাসন কূটনৈতিক চেষ্টার পথে হাঁটছে। তবে সুমি হামলার প্রসঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট মন্তব্য করেন, এটি ভয়াবহ ঘটনা। আমাকে বলা হয়েছে এটি ছিল একটি ভুল, তবে এর বেশি কিছু আমি জানি না।
সাবেক মার্কিন সেনা কর্মকর্তা ও ট্রাম্পের ইউক্রেনবিষয়ক বিশেষ দূত লেফটেন্যান্ট জেনারেল কিথ কেলগ এই হামলা ‘শালীনতার সব সীমা অতিক্রম করেছে’ বলে মন্তব্য করেছেন।
তবে জেলেনস্কির আমন্ত্রণ ট্রাম্প গ্রহণ করবেন কিনা তা এখনও অনিশ্চিত। এখন পর্যন্ত ট্রাম্প শিবিরের মাত্র একজন সিনিয়র সদস্য ইউক্রেন সফর করেছেন। তিনি হলেন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট, যিনি কিয়েভ গিয়ে ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের বিনিময়ে সামরিক সহায়তার একটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে বলেন। জেলেনস্কি সেই চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
মার্কিন বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ ইতোমধ্যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তিন দফা বৈঠক করেছেন। কিয়েভ আশঙ্কা করছে, মস্কো এই সংলাপকে ব্যবহার করে আরও অঞ্চল দখলের কৌশল নিচ্ছে।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেন, রাশিয়ার এই হামলা মানুষের জীবনের প্রতি, আন্তর্জাতিক আইন এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার প্রতি নগ্ন অবজ্ঞা।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লিয়েন হামলাকে ‘বর্বরতা’ বলে অভিহিত করে বলেন, আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে রাশিয়া বারবার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধবিরতি চাপিয়ে দিতে এখনই কঠোর পদক্ষেপ দরকার।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেন, সুমি শহরে রাশিয়ার ভয়ংকর হামলায় আমি স্তম্ভিত।
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র বলেছেন, বেসামরিক নাগরিক ও অবকাঠামোর ওপর হামলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে নিষিদ্ধ। এই ধরনের হামলা যেখানেই হোক, তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে সর্বাত্মক হামলা চালানোর পর থেকে কয়েক লাখ মানুষ নিহত বা আহত হয়েছেন। তাদের বেশিরভাগই সেনা হলেও বেসামরিক হতাহতের সংখ্যাও ভয়াবহ। সংঘাতের কারণে প্রায় ৭০ লাখ ইউক্রেনীয় এখন শরণার্থী হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন।
এই যুদ্ধের শেকড় আরও গভীরে। ২০১৪ সালে রুশপন্থি ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর রাশিয়া কৃষ্ণসাগর তীরবর্তী ক্রিমিয়া দখল করে এবং ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বিদ্রোহীদের সমর্থন দেয়। সেই সময় থেকেই রাশিয়া ও ইউক্রেনের সম্পর্ক সংঘাতে গড়ায়, যা এখন আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, শান্তিচুক্তির আগে বাস্তবতা যাচাইয়ের অংশ হিসেবে ট্রাম্পের ইউক্রেন সফর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে রাশিয়ার বর্তমান আগ্রাসী মনোভাব এবং ইউরোপের ঐক্যবদ্ধ প্রতিক্রিয়ার মাঝে শান্তির পথ কতটা সুগম হবে, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
সূত্র: বিবিসি