হোম এক্সক্লুসিভ যশোর রোডে নামল ১৯৭১’র সেই শরণার্থীর ঢল!

অনলাইন ডেস্ক:

প্রথমবারের মতো ঐতিহাসিক যশোর রোডে চিত্রায়িত হলো মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যশোর রোড হয়ে ভারতে গমনকারী শরণার্থীদের অবর্ণনীয় দুর্দশার চিত্র। যশোর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগ সাংস্কৃতিককর্মীরা জীবন্ত সেই চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন।

অবিকল শরণার্থীর বেশে যশোর জেলা স্কুল প্রাঙ্গণ থেকে পদযাত্রা নিয়ে বের হন শত শত সাংস্কৃতিক কর্মী। এসময় তারা একাত্তরের দিনগুলোর চিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড স্মরণের এমন আয়োজনে অংশ নিতে পেরে খুশি সব বয়সী অংশগ্রহণকারীরা।

এদিকে অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে নতুন প্রজন্মের জন্য এমন আয়োজন অব্যাহত রাখার তাগিদ দিয়েছেন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী।

পাকবাহিনীর হাত থেকে জীবন ও সম্ভ্রম রক্ষায় ঐতিহাসিক যশোর রোড হয়ে ভারতপানে ছুটছেন গির্জার ফাদার, ডাক্তার, শিক্ষক, কৃষক দিনমজুর, মৃত সন্তান কোলে ক্রন্দনরত বাবা, নানা বয়সী নারী-পুরুষ, গর্ভবতী নারী , শিশু। এমনকি গবাদিপশু নিয়ে জীবনের আশায় ভারতমুখী মানুষও রয়েছে এ জনস্রোতে। তাদের চোখে মুখে হতাশা ও কষ্ট। এভাবে অবিকল ফুটিয়ে তোলা হয়েছে একাত্তরের শরণার্থীদের বিভীষিকা ও দুর্দশাময় সেই দিনগুলোর চিত্র।

পাকবাহিনীর হাত থেকে জীবন ও সম্ভ্রম রক্ষায় ঐতিহাসিক যশোর রোড হয়ে ভারতপানে ছুটছেন গির্জার ফাদার, ডাক্তার, শিক্ষক, কৃষক দিনমজুর, মৃত সন্তান কোলে ক্রন্দনরত বাবা, নানা বয়সী নারী-পুরুষ, গর্ভবতী নারী , শিশু। ছবি: সময় সংবাদ

মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে পাক হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হাজার হাজার নারী-পুরুষ যশোর রোড হয়ে ভারতে যান। মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিকে যশোর রোডের শরণার্থীদের দেখে রচনা করেন বিখ্যাত সেই কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। যা থেকে পরে গান করা হয়েছিল। তার সেই কবিতায় শরণার্থীদের দুর্দশাময় জীবনের চিত্র উঠে এসেছিল। যা আমাদের ইতিহাসের একটি অংশ হয়ে গিয়েছে।

স্বাধীনতার ৫২ বছর পর অ্যালেন গিন্সবার্গের দেখা শরণার্থীদের সেই দুর্দশার চিত্র সাংস্কৃতিক কর্মীদের মাধ্যমে ফের ফুটিয়ে তুললো যশোরের জেলা প্রশাসন। সেপ্টেম্বর অব যশোর রোড শীর্ষক পদযাত্রায় দেখা গেল সেই শরণার্থীদের। পদযাত্রাটি শুক্রবার বিকেল ৪টায় যশোর জেলা স্কুল থেকে বের হয়ে ঐতিহাসিক যশোর রোড হয়ে সদর উপজেলার কৃষ্ণবাটি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে গিয়ে শেষ হয়। ইতিহাসের এমন একটি দিনকে চিত্রায়িত করতে পেরে খুশি আয়োজক ও অংশগ্রহণকারীরা।

যশোরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবরাউল হাছান মজুমদার বলেন, ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনী যেভাবে নিশ্চিন্তন করেছিল তাতে আমাদের নারী-পুরুষরা দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছিল। শরণার্থীদের সেই দুর্দশা স্মরণ করতেই এ আয়োজন। সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড এ অঞ্চলের মানুষের জন্য একটি ইতিহাস। সেই ইতিহাস নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে এ উদ্যোগ।

পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারী গির্জার ফাদার বেশধারী পিন্টু জামান বলেন, ‘আমি একাত্তর সালের সেই ঝড়ের রাতে ফিরে গিয়েছি। বর্ষা বাদলের দিনে মাথায় পোটলা নিয়ে হতাশাগ্রস্ত মানুষের সেই কষ্টটা অনুভব করেছি। ৭১ সালের সেপ্টেম্বরে যশোর রোডের একটা আলাদা রূপ ছিল। আজকের আয়োজন পরবর্তী প্রজন্মকে অনুভব করাবে একাত্তরের সেই দিনগুলো কত কষ্টের ছিল।’

গর্ভবতী নারীর বেশধারী অনুসূয়া ঘোষ বলেন, ‘অসাধারণ লেগেছে। ৭১ তো দেখিনি। বাবার কাছে মায়ের কাছে গল্প শুনেছি। ওই ফিলিংসটা কাজ করছিল। সে সময় মানুষগুলো কত কষ্ট করেছে। আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। বোঝাতে পারবো না অনুভূতিটা কতটা গভীর। আমার মনে হচ্ছে এমন একটি আয়োজন ৫২ বছর পরে না হয়ে আরো আগে হওয়ার প্রয়োজন ছিল। আমরা নতুন প্রজন্ম ইতিহাসকে আরও কাছাকাছি থেকে অনুভব করতে পারতাম। আমাদের মনে আরও বেশি দাগ কাটতে পারতো।’

ডাক্তার বেশধারী জাহাঙ্গীর হোসেন খোকন বলেন, ‘সবকিছুকে ত্যাগ করে বাঁচার আশায় মানুষ এ পথ ধরেছিল। অনেক ধরনের প্রতিকুলতার মধ্য দিয়ে এ পথ তাদের পাড়ি দিতে হয়েছিল। সেটাই আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আরে কাজটি করতে যেয়ে আন্দোলিত হয়েছি।’

সবার সহযোগিতায় ইতিহাসের একটি ঘটনাকে সফলভাবে চিত্রায়িত সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংস্কৃতির সংগঠনের নেতা ও মুক্তিযোদ্ধারা।

যশোর থিয়েটার ক্যানভাসের প্রধান সম্পাদক কামরুল হাসান রিপন বলেন, ‘অক্লান্ত পরিশ্রম করে আজকের আয়োজনটা সম্পন্ন করতে হয়েছে। অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশ নতুন প্রজন্মের। তারা যশোর রোডকে সেইভাবে চেনেই না। তাদের সেপ্টেম্বর অন যশোর রোডের ইতিহাস বোঝাতে ও তার অংশ হতে আগ্রহী করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। যখন যখন তাদের বোঝানো সম্ভব হয়েছে তখন তারা উদ্বুদ্ধও হয়েছে। যে কারণে তারা একাত্তরের সেই দুর্দশাময় দিনগুলো অবিকল ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়েছে।’

যশোর সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার আফজাল হোসেন দোদুল বলেন, ‘সাংস্কৃতিক কর্মীরা যেভাবে সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড ফুটিয়ে তুলেছে তা অসাধারণ। আমার দেখা যশোর রোড আর আজকের উপস্থাপনায় খুব বেশি তারতম্য নেই। নতুন প্রজন্ম সক্ষম হয়েছে সেই দিনগুলো কী দুর্দশার ছিল।’

এমন আয়োজন করায় সাধুবাদ জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য। তিনি মনে করেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ ও তখনকার মানুষের কষ্টময় দিনগুলোর কথা স্মরণ রাখতে ভূমিকা রাখবে এ আয়োজন। এ ধরনের আয়োজন অব্যাহত রাখারও তাগিদ দেন তিনি।

জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এ আয়োজনে যশোরের ৪ শতাধিক সাংস্কৃতিক কর্মী অংশগ্রহণ করে। পদযাত্রা শেষে কৃষ্ণবাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের কথা থাকলেও বৃষ্টির কারণে হয়নি।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন