রিপন হোসেন সাজু:
যশোরের ভবদহ অঞ্চলের দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা নিরসনে নদী ও খাল খননে শত কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। তবে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে প্রধান বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে নদী ও খালের ওপর নির্মিত অসংখ্য সরু ব্রিজ ও কালভার্ট।
স্থানীয় ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এসব অপরিকল্পিত অবকাঠামোই পানি নিষ্কাশনে বড় বাধা হয়ে আছে। তারা বলছেন, এসব ব্রিজ ও কালভার্ট অপসারণ বা পুনর্নির্মাণ না হলে খনন প্রকল্পের সুফল মিলবে না, বরং দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা নিরসনের স্বপ্ন আরও অনিশ্চয়তায় পড়ে যাবে।
সরেজমিনে ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ভবদহ অঞ্চলের উজানে মুক্তেশ্বরী, টেকা, হরি, শ্রী, হরিহর, বুড়িভদ্রা ও ভদ্রা নদী এবং জিকরা, গজশ্রী, বাদুরিয়া, গাবুখালি–এই ২৫টির বেশি খালের উপর রয়েছে বহু ব্রিজ ও কালভার্ট। কিন্তু এসব ব্রিজ ও কালভার্ট খালের প্রস্থের তুলনায় অনেকটাই সরু। ফলে বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে আসা ঢল ও কচুরিপনা আটকে গিয়ে পানিপ্রবাহ ব্যাহত হয়। এতে প্রতিবছরই ভবদহসহ আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা দীর্ঘদিন ধরে জলাবদ্ধ থাকে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, জলাবদ্ধতা নিরসনে ভবদহের আমডাঙ্গা খাল খননে ৪৯ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। পাশাপাশি ভবদহ সংলগ্ন ৮১ দশমিক ৫০ কিলোমিটার নদী খননে ১৪০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। অনুমোদন মিললেই সেনাবাহিনীর মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।
এ প্রসঙ্গে পাউবোর যশোর অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী দেবাশীষ ব্যানার্জি বলেন, নদী ও খাল খননের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা নিরসনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কিন্তু এসব সরু ও অপরিকল্পিত ব্রিজ ও কালভার্ট পানি নিষ্কাশনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এগুলোর কারণে প্রকল্পের সুফল পাওয়া নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। তিনি আরও জানান, বিআইডব্লিউটিএ’র ছাড়পত্র ছাড়াই এসব অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে, যেগুলো অপসারণে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
পাউবো ছাড়াও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), সড়ক ও জনপদ (সওজ) বিভাগ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের অধীনে এসব ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। তবে এসব অবকাঠামোর জন্য বিআইডব্লিউটিএ’র অনুমোদন নেয়া হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অভিযোগ রয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএ’র খুলনা নৌ সংরক্ষণ ও পরিচালনা বিভাগের যুগ্ম পরিচালক আশরাফ উদ্দীন বলেন, ‘বিআইডব্লিউটিএ’র ছাড়পত্র না নিয়েই ভবদহ সংলগ্ন মুক্তেশ্বরী ও টেকা নদীর ওপর ৮টি ব্রিজ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল। এগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে এসব বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।’
এ বিষয়ে সওজের যশোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মাহবুব হায়দার খান বলেন, ‘আগে এ বিষয়ে সমন্বয়হীনতা ছিল। তবে এখন থেকে ব্রিজ নির্মাণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র নেওয়া হচ্ছে।’
এলজিইডি’র যশোর জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী আহমেদ মাহবুব রহমান জানান, ‘বিআইডব্লিউটিএ’র আপত্তি এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনার কারণে ভবদহ এলাকায় নদীর ওপর নির্মাণাধীন ৮টি ব্রিজের কাজ আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে।’
গত ১৪ এপ্রিল ভবদহের জলাবদ্ধতা নিরসনে করণীয় নির্ধারণে ওই এলাকায় যান অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। ওই সময় তারা ভবদহের আমডাঙ্গা খাল খননে ৪৯ কোটি এবং নদী খননে ১৪০ কোটি টাকার দুটি প্রকল্পের ঘোষণা দেন।
তবে ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি ও ভুক্তভোগীরা বলছেন, যতই খনন হোক, সরু ব্রিজ-কালভার্ট সরানো না হলে সেসব প্রকল্প কার্যকর হবে না।সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রণজিৎ বাওয়ালী বলেন, ‘ভবদহে স্থায়ী জলাবদ্ধতা তৈরিতে একটি দুর্নীতিপরায়ণ গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে নদী ও খাল শাসন করে সরু ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ করেছে, যাতে সংকট জিইয়ে রেখে বছরের পর বছর সুবিধা নেওয়া যায়। এসব অপসারণ না হলে প্রকল্পের সুফল পাওয়া যাবে না।’
ভৈরব রক্ষা আন্দোলনের প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবীর জাহিদ বলেন, ‘নদী-খালের সীমানা উদ্ধার এবং সরু ব্রিজ-কালভার্ট অপসারণ না করলে খননের সুফল থেকে বঞ্চিতই থাকবে ভবদহবাসী।’
সংশ্লিষ্টদের মতে, যত দ্রুত এসব ব্রিজ-কালভার্ট অপসারণ ও সঠিক পরিকল্পনায় পুনর্নির্মাণ করা হবে, তত দ্রুতই ভবদহবাসী স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে। নয়তো কোটি কোটি টাকার প্রকল্পের সুফল ভেসে যাবে উজান থেকে আসা পানির তোড়ে।