আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
মিয়ানমারে শক্তিশালী দুটি ভূমিকম্পের প্রভাবে থাইল্যান্ডে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোতেও কম্পন অনুভূত হয়েছে। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, প্রথম ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৭.৭ এবং দ্বিতীয়টি ৬.৪। এই ভূমিকম্পের পর উদ্ধার তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে, তবে ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। থাইল্যান্ডের ব্যাংককে একটি নির্মাণাধীন ৩০ তলা ভবন ধসে পড়ে ধ্বংসস্তূপে অন্তত ৪৩ শ্রমিক আটকা পড়েছেন। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা এ খবর জানিয়েছে।
শুক্রবার দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে (স্থানীয় সময়) মিয়ানমারের সাগাইং শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ভূমিকম্পটি আঘাত হানে। ভূগর্ভস্থ ১০ কিলোমিটার গভীর থেকে উৎপত্তি হওয়া এই কম্পনে মিয়ানমারের ছয়টি অঞ্চল ও রাজ্যে জরুরি অবস্থা জারি করেছে দেশটির সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত সরকার। টেলিগ্রামে এক বিবৃতিতে তারা জানায়, রাষ্ট্র দ্রুত পরিস্থিতি যাচাই করে উদ্ধার তৎপরতা ও মানবিক সহায়তা প্রদান করবে।
নেপিদোর একটি বড় হাসপাতালকে ‘গণহতাহতের এলাকা’ ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের এক কর্মকর্তা। এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, হাজারের বেশি বেডের এই হাসপাতালের জরুরি বিভাগের বাইরে সারিবদ্ধভাবে আহতদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। কেউ কেউ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, আবার কেউ নিশ্চল পড়ে রয়েছেন—আত্মীয়স্বজন তাদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন।
মিয়ানমারে ভূমিকম্প: থাইল্যান্ডে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা ৪৩ শ্রমিক
মিয়ানমারের ফায়ার সার্ভিস বিভাগের এক কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, ইয়াঙ্গুনে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি যাচাই করতে আমরা অনুসন্ধান শুরু করেছি। এখনও কোনও তথ্য পাইনি।
বাগো অঞ্চলের টাউংনু শহরের দুই বাসিন্দা রয়টার্সকে জানান, একটি মসজিদ আংশিক ধসে পড়ায় কমপক্ষে তিনজন নিহত হয়েছেন। একজন বলেন, আমরা নামাজ পড়ছিলাম, এমন সময় কম্পন শুরু হয়… তিনজন সেখানে মারা যান।
আল জাজিরার সাংবাদিক টনি চেং নেপিদো থেকে জানান, ভূমিকম্পের সময় তিনি মিয়ানমারের ডিফেন্স সার্ভিসেস মিউজিয়ামের বাইরে ছিলেন। তিনি বলেন, আমরা বিদায় নেওয়ার জন্য বাইরে এসেছি, এমন সময় সবকিছু কাঁপতে শুরু করে। কম্পন ধীরে শুরু হলেও দ্রুত তীব্র হয়ে ওঠে, ভবনের কংক্রিটের প্যানেলগুলো ভেঙে পড়ে।
চেং বলেন, আমি এই অঞ্চলে আগেও ভূমিকম্প অনুভব করেছি, কিন্তু এতটা শক্তিশালী কখনোই নয়। আমরা বেশ কয়েকটি আফটারশক অনুভব করেছি, যা সবাইকে আতঙ্কিত করে তুলেছে।
মিয়ানমারের প্রাচীন রাজধানী মান্ডালয়ে ধসে পড়া ভবন ও রাস্তায় ছড়িয়ে পড়া ধ্বংসাবশেষের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। শহরের এক বাসিন্দা হ্তেট নাইং উ বলেন, একটি চায়ের দোকান ধসে পড়েছে, যার নিচে বেশ কয়েকজন আটকা পড়েছেন। তিনি বলেন, আমরা ভেতরে যেতে পারিনি, পরিস্থিতি খুবই খারাপ।
ব্যাংককে ধসে পড়লো আকাশচুম্বী ভবন
পাশের দেশ থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককেও কম্পন অনুভূত হয়। ভীতসন্ত্রস্ত বাসিন্দারা দ্রুত উঁচু ভবনগুলো থেকে বেরিয়ে আসেন। আল জাজিরার সাংবাদিক ইমরান খান ব্যাংককে থাকা অবস্থায় জানান, নিরাপত্তার কারণে পুরো গণপরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
ব্যাংককের চাতুচাক এলাকায় একটি নির্মাণাধীন ৩০ তলা ভবন ধসে পড়ে ৪৩ নির্মাণ শ্রমিক আটকা পড়েছেন বলে জানা গেছে। শহরের কিছু মেট্রো ও রেল পরিষেবাও স্থগিত করা হয়েছে।
থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পায়েতংটান সিনাওয়াত্রা দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন। ব্যাংকককে দুর্যোগ এলাকা ঘোষণা করেছে শহরের কর্তৃপক্ষ।
চীনেও কম্পন, ক্ষয়ক্ষতি
চীনের ইউনান ও সিচুয়ান প্রদেশেও ভূমিকম্পের কম্পন অনুভূত হয়েছে। মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী রুইলি শহরে কিছু বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং আহতের খবর পাওয়া গেছে। চীনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা গেছে, রাস্তায় ভবনের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে আছে এবং একজনকে স্ট্রেচারে করে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে।
মিয়ানমারে অতীতের ভূমিকম্প
ইউএসজিএসের তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমারে ভূমিকম্প তুলনামূলকভাবে সাধারণ ঘটনা। ১৯৩০ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে সাগাইং ফল্ট লাইন বরাবর ৭.০ বা তার বেশি মাত্রার ছয়টি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। ২০১৬ সালে মিয়ানমারের প্রাচীন রাজধানী বাগানে ৬.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে তিনজন নিহত হয়েছিলেন এবং পর্যটন স্পটের মন্দিরের দেয়াল ও চূড়াগুলো ধসে পড়েছিল।
দরিদ্র এই দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে, খুবই দুর্বল। এছাড়া, আল জাজিরার সাংবাদিক টনি চেং বলেন, মিয়ানমার বর্তমানে একটি রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, অনেকেই গ্রাম থেকে শহরে চলে এসেছেন নিরাপত্তার খাতিরে। এতে শহরগুলো অতিরিক্ত জনবহুল হয়ে পড়েছে এবং ভবন নির্মাণের মানও খুব ভালো নয়।