রাজনীতি ডেস্ক:
বহির্বিশ্বের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক এবং যোগাযোগের বিষয় নিয়ে কথা উঠলেই দলটির ফরেন অ্যাফেয়ার্স (এফআরসি) তথা বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটি নিয়ে সমালোচনা হয়। অভিযোগ আছে, দলের কূটনৈতিক উইং শক্তিশালী নয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে চীন, মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমা অধিকাংশ দেশের দলটির আস্থার সম্পর্ক ছিল। তবে ২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর কয়েকটি দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন হলেও অবনতি হয় বেশি। এরপর আর কূটনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি দলটি। সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনায় এফআরসির তৎপরতাও চোখে পড়ার মতো ছিল না। এমন পরিস্থিতি বিএনপির হাইকমান্ডকে কিছুটা ভাবনায়ও ফেলেছে।
কূটনীতিক বিষয়ে খবর রাখেন এবং বিএনপির রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করেন এমন ব্যক্তিদের মতে, বর্তমান যুগে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে চোখ-কান খোলা রাখলেই শুধু হয় না, বরং অন্তর্দৃষ্টিও রাখতে হয়; কিন্তু বিএনপির এফআরসির সেই দক্ষতা কতটুকু আছে, তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। কেননা, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর নানা অনিয়মের বিষয় আলোচনায় এলেও আন্তর্জাতিক মহলে তা ভালোভাবে তুলে ধরতে পারেনি তারা।
বলা হচ্ছে, ২০০৬ সালে ক্ষমতা ছাড়ার পর বৈদেশিক সম্পর্কোন্নয়নে কিছুটা হোঁচট খেয়েছে বিএনপি। পেশাদার কূটনীতিক হিসেবে খ্যাতিমান বা সে মহলে ভালো যোগাযোগ এবং জানাশোনা আছে, এমন কোনো ব্যক্তি এখন এফআরসিতে নেই। ফলে বিশ্বের চলমান গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো সেভাবে সামলাতে পারছে না দলটি। তাই পেশাদার কূটনীতিক এবং দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে এফআরসি পুনর্গঠন তথা ঢেলে সাজানোর কথাও বলছেন দলের নেতাকর্মী ও পর্যবেক্ষকরা। তবে বর্তমান কমিটির একাধিক সদস্যের দাবি, সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকগুলো প্রমাণ করে, তারা এ ক্ষেত্রে সফল। যেটি তারা ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় করতে পারেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় এক যুগ ধরে অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে চলছিল বিএনপির বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটি। কমিটির সিনিয়র সদস্যদের অনেকেই অসুস্থতার কারণে ধারাবাহিকভাবে মিটিংয়ে আসতে পারেন না। অনেকে অংশ নিলেও বাড়তি চাপ নিতে অনীহা ছিল তাদের মধ্যে। এ ছাড়া এমন সদস্যও ছিলেন যাদের কেউ কেউ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ধারণা ও কৌশল সম্পর্কে কিছুই জানেন না। এসব কারণেই মূলত পিছিয়ে পড়ে এ কমিটি।
সম্প্রতি বিশ্বের প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থাগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি হাইকমান্ড। যার ফল যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে একাধিক বৈঠক। বিশেষ করে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ও দেশের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর সরকার প্রকাশ্যে কথা বলছে। একে সাফল্য হিসেবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিদেশিদের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক আছে। তারা বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে কথা বলছে, সোচ্চার হচ্ছে। আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করতে নানা সুপারিশ করছে। তবে বিদেশিরা বিশেষ কোনো দলের সঙ্গে সম্পর্ক দেখায় না। এটি তাদের কৌশল।
দলীয় সূত্র জানায়, গত কয়েক বছরে এফআরসির সিনিয়র কিছু সদস্য বয়স, সময় ও সক্ষমতার কারণে কাজের ক্ষেত্রে খুব একটা সময় দিতে পারছিলেন না। বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী দল থেকে পদত্যাগের পর এ কমিটির দায়িত্বে আসেন সিনিয়র সাংবাদিক শফিক রেহমান (বর্তমানে যুক্তরাজ্যে থাকেন)। ২০১৫ সালে একটি মামলায় গ্রেপ্তার হলে তিনি কাজ বন্ধ করে দেন। এরপর সাবেক পররাষ্ট্র সচিব রিয়াজ রহমানকে চেয়ারম্যান করতে চাইলে সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ইনাম আহমেদ চৌধুরীকে এ পদে নিয়োগের প্রস্তাব করেন তিনি। অবশ্য ২০১৮ সালের গত ১৯ ডিসেম্বর ইনাম আহমেদ চৌধুরী আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এরপর দলের নীতি ও বৈদেশিক কাজে নতুন অগ্রগতি আনতে ২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারির আগে বিলুপ্ত করে একই বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি ২১ সদস্যের নতুন কমিটি গঠন করা হয়।
বর্তমানে বিএনপির এফআরসির নেতৃত্ব দিচ্ছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। সদস্যরা হিসেবে আছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান, সাবিহ উদ্দিন আহমেদ, এনামুল হক চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, বিশেষ সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপন, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক নওশাদ জমির, আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল, মানবাধিকারবিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ, ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সহ-সম্পাদক ফাহিমা নাসরিন মুন্নী ও রুমিন ফারহানা, নির্বাহী কমিটির সদস্য তাসভিরুল ইসলাম, জিবা খান, মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, তাবিথ আউয়াল, খন্দকার আহাদ আহমেদ, ইয়াসের খান চৌধুরী ও ইশরাক হোসেন। তাদের মধ্যে ২০২১ সালে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন খন্দকার আহাদ আহমেদ। বাকিদের বেশিরভাগই নিজ নিজ পেশা ও এলাকার রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কমিটি গঠনের পর থেকে এর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করছেন কয়েকজন সদস্য। তাদের দৌরাত্ম্যের কারণে অনেকেই নিজেদের গুটিয়ে রেখেছেন। তবে এ বিষয়ে মুখ না খুললেও নাম গোপন রাখার শর্তে অনেকেই এ তথ্য দিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২১ সদস্যের এ কমিটিতে এখন বেশি সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যায় তিনজনকে। তারা হলেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, শামা ওবায়েদ এবং আসাদুজ্জামান। মাঝেমধ্যে হেলাল ও তাবিথ আউয়ালকেও দেখা যায়। নানা ইস্যুতে বিএনপির হয়ে সর্বদা মুখর থাকেন রুমিন ফারহানা। কয়েক মাস আগেও বেশ সক্রিয় ছিলেন তিনি; কিন্তু সম্প্রতি তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। কূটনৈতিক মিটিংয়ে প্রায়ই তাকে ডাকা হয় না। রিয়াজ রহমান, এনামুল হক চৌধুরী, আসাদুজ্জামান রিপন, জিবা খান, নওশাদ জমির, ফাহিমা মুন্নি, অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, তাবিথ আউয়াল, ব্যারিস্টার মীর হেলাল, ইশরাক হোসেন প্রমুখের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।
এ প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, দল হয়তো মনে করে, আমার যোগ্যতা নেই। তাই আমাকে ডাকে না। আমিও যাই না। অন্যরা কেন যায় না, তা আমার জানা নেই।
কমিটির একাধিক সদস্য বলেন, কমিটিতে রাজনীতিকদের মধ্য কাউকে প্রধান করা হলে বাকিদের ওপর চাপ পড়ে। একই সঙ্গে কমিটিতে থাকা সার্বক্ষণিক রাজনীতিকরাও অনীহা দেখান। এ নিয়ে স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য, যারা একই সঙ্গে এফআরসির সদস্য, তাদের মধ্যে বেশি বিভাজন রয়েছে। কমিটি গঠনের পর থেকে সাড়ে চার বছরে কমিটির আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে মাত্র একটি। অনানুষ্ঠানিকভাবে অবহিতকরণ সভা হয়েছে কয়েকটি। ভার্চুয়ালি যোগাযোগই হয় বেশি। ফলে কিছুটা সমন্বয়হীনতা তৈরি হয়েছে। বর্তমানে কমিটির সিনিয়র সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু কয়েক মাস ধরে বিদেশে অবস্থান করছেন। কবে ফিরবেন সেটিও নিশ্চিত নয়।
সদস্যদের অভিযোগ, বিদেশিদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কমিটির সদস্যদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। কমিটির কোনো কর্মসূচির সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ত করা হয় না। শুধু সদস্য হিসেবে কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানানো হয়। ঢাকার বেশিরভাগ বিদেশি দূতাবাসের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে ঘাটতি আছে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের।
দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির কয়েকজন আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ও সহ-সম্পাদক কালবেলাকে জানান, কূটনৈতিক উইং শক্তিশালী করতে হলে শুধু এফআরসির মাধ্যমেই কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলে হবে না। অনেক প্রভাবশালী দেশে দলের কোনো কোনো নেতা থাকেন। তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে অঞ্চলভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনা করলে বিষয়টি সহজ হয়।
তবে এফআরসির কার্যক্রমে সন্তুষ্ট দলের সদস্য আসাদুজ্জামান রিপন। গতকাল বুধবার তিনি কালবেলাকে বলেন, কমিটির কার্যক্রম নিয়ে যেসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে তা সঠিক নয়। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কান্ট্রি ফোকাস করাটা মুখ্য বিষয়। পেশাদার কূটনীতিক যারা কাজ করতে আগ্রহী তাদেরও গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে সব রাজনীতিবিদ ও কূটনীতিক যে যোগ্য বা দক্ষ, সেটি বলা যাবে না। কে কত আগ্রহ ও মনোযোগ নিয়ে কাজ করবেন সেটিই বিবেচ্য।
এদিকে বিএনপির কয়েকজন নেতা ও এফআরসির সদস্য কালবেলাকে বলেন, বিএনপির সঙ্গে বৈদেশিক সম্পর্ক কম বা নেই, এটি বলার সুযোগ নেই। সম্প্রতি বিশ্বের প্রভাবশালী দেশ বা পরাশক্তিগুলো বাংলাদেশের বিষয়ে এমনিতেই সোচ্চার হননি। এক্ষেত্রে কমিটি ছাড়াও দেশের বাইরে থাকা দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির কয়েকজন আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ও সহ-সম্পাদকও ভূমিকা রাখছেন। তবে এফআরসির কমিটিকে আরও শক্তিশালী করা দরকার, যা আরও আগে করা যেত; কিন্তু এখনো সময় ফুরিয়ে যায়নি।