অনলাইন ডেস্ক:
ফরিদপুরে পাট চাষের বাড়তি খরচ মেটাতে পাট অধিদপ্তরের কৃষি প্রণোদনার খবর কৃষকই জানে না। পাট অফিসের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের যোগসাজশে কৃষকের এ টাকা নিজেদের পকেটে ঢুকিয়েছেন জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মচারী ও ব্যবসায়ীরা।
ফরিদপুর জেলার সালথা ও নগরকান্দা উপজেলা পাট উৎপাদনে দেশ সেরা। এবছর কৃষকের এ পাট পচাতে পর্যাপ্ত পানি না হওয়ায় বাড়তি খরচ হচ্ছে বিবেচনায় পাট অধিদপ্তর এবছরই প্রথম পাইলট প্রকল্পের মাধ্যেমে সিদ্ধান্ত নেয় কৃষকদের প্রণোদনার মাধ্যমে অর্থ সহায়তা দেয়ার।
এ প্রণোদনার জন্য জেলার ৯ টি উপজেলায় ৮ জন করে মোট ৭২ জনকে ১১ হাজার ৮শ’ টাকা করে অর্থ সহায়তায় চেক বিতরণ করা হয়। সরেজমিনে সালথা ও নগরকান্দা উপজেলার ৮ জন করে মোট ১৬ জন কৃষককে পাট অফিসের মাধ্যমে দেয়া সহায়তায় ধরা পড়ে ব্যাপক অনিয়ম।
চেক বিতরণের তালিকায় দেখা যায়, সালথা উপজেলার ৮ কৃষকের স্থলে চেক গ্রহণ করেছেন উপজেলা পরিষদের অফিস সহায়ক সোনাপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা শাহাদাৎ হোসেন, রামকান্তপুর গরুর খামার ব্যবাসায়ী হাফিজুর রহমান, একই গ্রামের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক জাহিদ হাসান এমেলি, সোনাপুর ইউনিয়নের ফুকরা বাজারের ব্যবসায়ী আবুল হোসেন, রামকান্তপুর ইউনিয়নের ব্যবসায়ী মোক্তার মোল্লা , ইব্রাহিম হোসেন এবং যদুনন্দী ইউনিয়নের মো. আবুল হাসান।
এর মধ্যে একজন নিজেকে কৃষক সাজাতে বাড়ির সামনে ১৫ শতক জমিতে পাট চাষ করেছেন। যেখানে কোনো কোনো কৃষক ১০ বিঘা জমিতে পাট চাষ করে থাকেন।
আর নগরকান্দা ইউনিয়নের তালিকায় রয়েছে, চরযশোহরদী ইউনিয়নের ইউপি সদস্য ইমারত হোসেন দুলাল, রামনগর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মো. হারেজ, মো. ছরোয়ার ও গিয়াসউদ্দিন ডাঙ্গি ইউনিয়নের রাশেদ মোল্যা, ইকরাম সরদার, তালমা ইউনিয়নের মজনু ফকির, ইকরাম ফকির। এ তালিকায় পাওয়া যায় আরও ভয়াবহ জালিয়াতির চিত্র।
ছবিতে যাদের হাতে কৃষি প্রণোদনার চেক তুলে দেওয়া হচ্ছে, তারা কেউই কৃষক নয় বলে অভিযোগ রয়েছে। নগরকান্দা ও সালথা
এ তালিকার তিনজনকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। এখানে প্রকৃত অসচ্ছল কৃষক হিসেবে কাউকেই খুঁজে পাওয়া গেল না। অভিযোগ রয়েছে স্থনীয় জনপ্রতিনিধি ও নগরকান্দা উপ-সহকারী পাট কর্মকর্তা ভুয়া নাম ব্যবহার করে টাকা আত্মসাৎ করার।
এমন দুর্নীতির কথা সালথা উপজেলা পাট কর্মকর্তা স্বীকার করলেও মানতে নারাজ নগরকান্দা উপজেলা পাট কর্মকর্তা। আর উপজেলা প্রশাসন দায়সারা জবাব দিয়ে বলছে, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নগরকান্দা উপজেলার পাট চাষি আকরাম মাতবর বলেন, ‘এবছর ৩ বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছি। পাট ঘরে তুলে বিঘা প্রতি ১৭-১৮ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এক বিঘায় পাট পেয়েছি ১৪-১৫ মণ। এক মণ পাট বিক্রি করেছি ১ হাজার ৫শ’ টাকায়। এক বিঘায় তিন থেকে সাড়ে তিন মাস সময় দিয়ে পরিশ্রম দিয়ে লাভ আসে ৪-৫ হাজার টাকা। আমার ছেলে মেয়ে না খেয়ে থাকে আর ইউপি মেম্বাররা আমাদের হকের টাকা মেরে খায়।’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘কৃষি অফিস বা পাট অফিস, এমনকি কোনো জনপ্রতিনিধিই আমাদের জানায়নি এমন প্রণোদনার কথা। জানাবে কেন জানালে তো তারা হক মেরে খেতে পারবে না। ১শ’ পাট কাটতে শ্রমিকের মজুরি দিতে হয় ৫শ’ টাকা, পাট জাগ দেওয়ার স্থানে নিতে লাগে ৪শ’ টাকা, পাট ধুইতে নেয় ৫শ’ টাকা। আর আমাগো টাকা খায় ইউপি মেম্বাররা।’
সালথা সদর ইউনিয়নের আরেক পাট চাষি মোবারক হোসেন বলেন, ‘আমি সরকারের কৃষি প্রণোদনার কথা জানি না। আমাকে কেউ জানায়নি। এ প্রণোদনার টাকা, কবে দিয়েছে, কত টাকা দিয়েছে তাও জানি না। আমি পাইনি আর কে পেয়েছে তাও জানি না। আমার এলাকার কোনো কৃষক পেয়েছে কিনা তাও শুনি নাই।’
নগরকান্দা উপজেলার রামনগর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. হারেজ প্রামাণিক বলেন, ‘আমি একজন কৃষক, একজন ব্যবসায়ী এবং বর্তমানে রানিং মেম্বার। আমি ৩ বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছি, তাই সরকার আমাকে প্রণোদনা দিয়েছে।’
আপনি তো সচ্ছল তাহলে অসচ্ছল কৃষককে না দিয়ে আপনি কেন নিলেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি কৃষক তাই নিয়েছি।’
আপনি জনপ্রতিনিধি আপনার উচিৎ ছিল প্রান্তিক কৃষককে এই সহায়তা দেবার সেটা না করে আপনি কেন নিলেন এমন প্রশে তিনি বলেন, ‘এ টাকাটা আমি জনগণের পেছনেই খরচ করবো।’
সালথা উপজেলা পরিষদের অফিস সহায়ক সোনাপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আমি সরকারি চাকরির পাশাপাশি বাড়িতে কৃষি কাজ করি। আমার বাবার কৃষি জমি আছে। আমি এক বিঘার একটু বেশি ৫০ শতাংশ জমিতে পাট বুনেছি। আমার বাড়ির সামনে গর্ত করে মেশিন দিয়ে পানি দিয়ে পাট পচাইছি।
আমি পাট অফিসের কর্মকর্তাকে বলেছিলাম এবার পাটের খরচ অনেক বেশি, পাটের দামে তো খরচ ওঠে না। তখন কর্মকর্তা বলেছিলেন আমরা পাটের প্রণোদনা দেব, দেখি তখন আপনাকে দেয়া যায় কিনা।’
একজন সরকারি কর্মচারী হিসেবে আপনার কি পাওয়ার কথা যেখানে ৫ বিঘা দশ বিঘা জমিতে পাট চাষ করে আরো বেশি পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক রয়েছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমিও কৃষক তাই দিয়েছে।’
নগরকান্দা উপসহকারী পাট উন্নয়ন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে সচ্ছল কৃষকের বদলে অসচ্ছল কৃষককে কেন প্রণোদনা দেওয়া হল জানতে চাইলে তিনি চটে গিয়ে বলেন, ‘সবাই কৃষক। ইউপি মেম্বার জনগণের কাছে জনপ্রতিনিধি আমার কাছে না, তিনি আমার কাছে কৃষক। একজন পাট চাষি। চাষি ধনী গরিব সব শ্রেণিতেই আছে।’
গরিব কৃষককে না দিয়ে ধনী কৃষককে কেন দেওয়া হল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এমন কোনো নিয়ম এখানে বলা হয়নি। বলা হয়েছে কৃষক হতে হবে।’
সালথা উপজেলা উপ-সহকারী পাট উন্নয়ন কর্মকর্তা আব্দুল বারী ভুলের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘যখন প্রণোদনাটা এলো, তখন তাড়াহুড়ার মধ্যে করা হয়েছে। আমাদের আগাম কোনো প্রস্তুতি ছিল না। কিছু ভুলত্রুটি থাকতে পারে আমাদের। ভবিষ্যতে তালিকা প্রস্তুতের সময় আমরা এ সকল বিষয় খেয়াল রাখব।’
নগরকান্দা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মঈনুল হোসেন তার নিজ কার্যালয়ে চেক বিতরণ করে দায় সারা বক্তব্য দিয়ে বললেন, ‘পাটের উপকারভোগী নির্বাচনে যদি কোনো অনিয়ম হয় বা কোনো কর্মকর্তা এরকম অপরাধে জড়িত থাকে এ বিষয়ে কেউ যদি আমার কাছে অভিযোগ দেয় তাহলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
ফরিদপুর জেলা পাট উন্নয়ন কর্মকর্তা তারেক লুৎফর আমিন বলেন, ‘পাট চাষিদের বাড়তি খরচে বিবেচনায় সরকার এবছর একটি পাইলট প্রজেক্টের মাধ্যমে দেশের ফরিদপুর, যশোরসহ তিন জেলায় মোট ১০৯ জন কৃষকে প্রণোদনা দেয়া হয় ১১ হাজার ৮০০ টাকা করে। ফরিদপুরে জেলার ৯ উপজেলার ৮ জন করে মোট ৭২ জন কৃষককে এই প্রণোদনা দেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, তালিকাগুলো করেন উপ-সহকারী পাট উন্নয়ন কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে নিয়ে। তাদের একটি কমিটি আছে। তারাই এটা দেখভাল করেন। কৃষক নির্বাচনে যারা পাট জাগ দিতে অতিরিক্ত খরচ বহন করতে হয়েছে, তাদেরকেই মূলত নির্বাচন করার কথা। কৃষক নির্বাচনের বিষয়টির উপজেলা কমিটির হাতেই থাকে।
তারেক লুৎফর আমিন বলেন, ‘এই পাইলট প্রকল্পটি যাতে ভবিষ্যতে কৃষকের কাছে উপকার হিসেবে যাতে সারা ফেলে সে জন্য ভবিষ্যতে সকল বিষয়ই খেয়াল রাখব। আর এই বছরের নির্বাচন প্রক্রিয়াটা আমি খতিয়ে দেখব।’
ফরিদপুর জেলা পাট অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. জাহিদুল ইসলাম সময় সংবাদকে বলেন, ‘কৃষক নির্বাচনে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না তা আমার জানা নেই। আমি এই প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলব।’