বাণিজ্য ডেস্ক :
যুদ্ধের নামে আরও একবার বিশ্বের ধনী ও উন্নত দেশগুলোর খামখেয়ালির শিকার হচ্ছে বিশ্বের দরিদ্ররা। পশ্চিমা দেশগুলোর নিজেদের সুবিধা ও স্বার্থের জন্য বাধানো ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বে তৈরি হওয়া খাদ্য সংকটের খেসারত দিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলোর দরিদ্র জনগণ। একইসঙ্গে ভালো নেই উন্নত দেশগুলোর নিম্নবিত্ত এবং শ্রমজীবীরাও। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে এই দেশগুলোতে হানা দিয়েছে মূল্যস্ফীতি। বেড়ে গেছে খাদ্যপণ্য, জ্বালানিসহ প্রায় সব জিনিসের দাম। ফলে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
ইউক্রেন যুদ্ধের সবচেয়ে মারাত্মক শিকারে পরিণত হয়েছে এশিয়া, আফ্রিকা, মধপ্রাচ্যসহ বিশ্বের উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোর জনগণ। দৈনিক গড় আয় এক দশমিক ৯০ ডলারেরও কম, বিশ্বে এমন মানুষের সংখ্যা ৭০ কোটি। যাদের অধিকাংশই এ সব দেশে অবস্থিত। বিশ্বের খাদ্যশস্যের দামের সামান্য হেরফেরেই এই মানুষগুলোর জীবন শঙ্কার মধ্যে পড়ে যায়।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে দেয়া পশ্চিমা অবরোধই সংকটের কারণ
এ বছর বিশ্বে প্রচুর খাদ্যশস্য উৎপাদন হলেও মূলত ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে রাশিয়ার ওপর দেয়া পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণেই এ সংকট তৈরি হয়েছে। এক ইউক্রেনেই এ মুহূর্তে আটকা পড়েছে প্রায় ৪০ কোটি মানুষের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য। পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার কারণে কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলো দিয়ে বিশ্ব বাজারে গম আসতে পারছে না।
গম, ভুট্টা, সূর্যমুখী তেলসহ অন্যান্য খাদ্যশস্যের শীর্ষ রফতানিকারক রাশিয়া ও ইউক্রেন। বিশ্বের গম রফতানির তিন ভাগের এক ভাগই এ দেশ দুটি করে থাকে। পাশাপাশি রাশিয়া বিশ্বের শীর্ষ রাসায়নিক সার সরবরাহকারী।
এ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল থেকে বারবার রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তায় প্রভাব ফেলবে বলে হুঁশিয়ারি দেয়া হলেও তাতে কর্ণপাত করছে না পশ্চিমারা। উল্টো রাশিয়ার জ্বালানি রফতানির ওপর সর্বাত্মক আবরোধ আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। ফলে বাড়তি খাদ্যের দামের সঙ্গে বাড়তি পরিবহন ব্যয় যোগ হবে।
বেড়ে যাওয়া তেলের দামও প্রভাব ফেলছে খাদ্য সংকটে
খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্যাস ও জ্বালানি রফতানিকারক দেশও রাশিয়া। নিষেধাজ্ঞার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে ইতোমধ্যেই তেলের দাম ১২০ ডলারের উপরে উঠে গেছে। নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি কার্যকর হলে তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ১৫০ ডলারের ওপর চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বেড়ে যাওয়া এই তেলের দামের প্রভাবে খাদ্যের দাম আরও বেড়ে যাবে।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে আর্থিক নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়ছে খাদ্যপণ্যের দামে
জ্বালানি খাতের পাশাপাশি রাশিয়ার বেশির ভাগ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইউরোপ ও পশ্চিমা বিশ্ব। এ বিষয়টিও বিশ্বের খাদ্য ও জ্বালানি তেলের দামে ব্যাপক ভাবে প্রভাব ফেলছে। কারণ প্রচলিত ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে আমদানিকারক দেশগুলোর পক্ষে রাশিয়া থেকে তেল খাদ্য ও সার আমদানি কঠিন হয়ে পড়েছে।
বাড়তি খাদ্যের দাম প্রভাব ফেলবে বিশ্বের সর্বত্র
এ পরিস্থিতিতে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। যার প্রভাবে সারা বিশ্বে তৈরি হয়েছে খাদ্য সংকট। গত মার্চ মাসে রেকর্ড অবস্থানে পৌঁছায় জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার খাদ্যমূল্য সূচক। গত মে মাসে খাদ্যমূল্য সূচক ছিল আগের বছরের একই সময়ের থেকে প্রায় ২৩ শতাংশ বেশি।
এতে বিশ্বের অনাহারী ও দুর্ভিক্ষের মধ্যে থাকা মানুষের জন্য জরুরি খাদ্য সহায়তাও হুমকির মুখে পড়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা। তারা জানিয়েছে, জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় ত্রাণের খাদ্য পৌঁছানোর খরচও অনেক বেশি বেড়ে গেছে। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ২০২৩ সালে বিভিন্ন স্থানে দুর্ভিক্ষ তৈরি হতে পারে।
আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং সংস্থা স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পোর জানিয়েছে, ইউক্রেন সংকটের কারণে চলমান এই খাদ্য সংকট আগামী ২০২৪ সালের পরও থাকবে। বিশ্বের দেশে দেশে সামাজিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং দেশগুলোর ঋণমানে এই সংকট প্রভাব ফেলবে।
ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি জানিয়েছে, বর্তমান খাদ্য সংকট অব্যাহত থাকলে আফ্রিকা, আফগানিস্তান, ইয়েমেনসহ বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর আরও সাড়ে চার কোটি মানুষ ব্যাপক অনাহারের সম্মুখীন হবে।
নিষেধাজ্ঞার জেরে ব্যাহত সাপ্লাই চেন ব্যবস্থা
বিশ্বে খাদ্য উৎপাদন কম না হলেও মূলত সাপ্লাই চেন সংকটের কারণেই এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধ দেয়ায় বিশ্বে তেলের সংকট সৃষ্টি হয়। ফলে তেলের দাম বেড়ে যায়। ফলে বিশ্বজুড়ে জাহাজ ভাড়া, ট্রাক ভাড়াসহ পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়ে যায়। পাশাপাশি রাশিয়ায় উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ গমও বিশ্ববাজারে আসার পথে বাধার সৃষ্টি হয়।
অপরদিকে ইউক্রেনের অধিকাংশ বন্দর রাশিয়ার দখলে থাকায় সেখান দিয়ে নিজেদের উৎপাদিত গমসহ বিপুল খাদ্যপণ্য রফতানি করতে পারছে না দেশটি। বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা রাশিয়ার প্রতি ইউক্রেনের এসব বন্দর দিয়ে খাদ্য রফতানির অনুমতি দেয়ার জন্য আহ্বান জানালেও রাশিয়া তাদের ওপর আরোপ করা অবরোধ প্রত্যাহারের শর্ত দেয়। তবে পশ্চিমা দেশগুলো এতে কর্ণপাত করছে না। বরং রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও কঠোর অবরোধ আরোপ করেছে তারা।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থার হিসাবে, এ মুহূর্তে ইউক্রেনে থাকা খাদ্য দিয়ে বিশ্বের ৪০ কোটি মানুষের ক্ষুধা নিবারণ সম্ভব।
ইউক্রেন সংকট শুরুর পরপরই পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে খাদ্য রফতানি বন্ধের ঘোষণা দেয় বিশ্বের ২০টিরও বেশি খাদ্য রফতানিকারী দেশ। এর প্রভাবও বিশ্বের খাদ্যের দামে পড়ছে। ইউক্রেন সংকটের কারণে নিজেদের অভ্যন্তরীণ বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতেই এই পদক্ষেপ নেয় তারা।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় ব্যাহত হবে কৃষি উৎপাদন
রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের অবরোধের প্রভাব বিশ্বের খাদ্যশস্য উৎপাদনেও পড়ছে। কারণ পটাশ, অ্যামোনিয়া ও ইউরিয়াসহ বিশ্বের রাসায়নিক সারের শীর্ষ রফতানিকারক দেশ রাশিয়া। অবরোধের কারণে সারের জন্য রাশিয়ার প্রতি নির্ভরশীল দেশগুলোতে কৃষি উৎপাদনে সংকট তৈরি হবে। পশ্চিমা অবরোধের কারণে রাশিয়ার কাছে সার কিনতে পারছে না তারা।
এদিকে নিজের দেশে সংকট বেড়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যেই সার রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে অপর শীর্ষ সার রফতানিকারক চীন। বিশ্বের সার রফতানির এক তৃতীয়াংশ চীন ও রাশিয়ার দখলে।
নিষেধাজ্ঞায় ক্ষতিগ্রস্ত উন্নত দেশগুলোর দরিদ্র জনগণও
সব মিলিয়ে গত এক বছরে বিশ্বের গমের দাম ৬০ শতাংশ, পাম ওয়েলের দাম ৫৬ শতাংশ, দুধের দাম ৪০ শতাংশ এবং চালের দাম ২৬ শতাংশ বেড়েছে। পাশাপাশি তেলের দাম ৭২ শতাংশ, গ্যাসের দাম ১৮৭ শতাংশ, কয়লার দাম ২৩৯ শতাংশ বেড়েছে।
এ মূল্যস্ফীতি ও খাদ্যপণ্যের অস্থিরতায় শুধু দরিদ্র দেশগুলোই ভুগছে না। এর প্রভাব কম বেশিও বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতেও বেড়েছে।
ব্রিটেনের ভোক্তামূল্য সূচক এক বছরে ৯ শতাংশ বেড়েছে। যা ১৯৮২ সালের পর সর্বোচ্চ। পাশাপাশি বিদ্যুতের দাম ৫৩ শতাংশ এবং গ্যাসের দাম ৯৫ শতাংশ বেড়েছে। এর ফলে বেড়ে গেছে খাদপণ্যের দাম।
ইউরোপের আরেক উন্নত দেশ জার্মানিতে ভোক্তামূল্য সূচক প্রায় ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যা গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
পাশাপাশি সেখানে খাদ্যের দাম ১১ শতাংশ এবং জ্বালানির খরচ ৩৮ শতাংশ বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রেও ভোক্তামূল্য সূচক বেড়েছে সাড়ে আট শতাংশ। এর মধ্যে জ্বালানির খরচ বেড়েছে ৩০ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির কারণে দাম বেড়েছে প্রায় সব পণ্যের। গত ৫০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক জ্বালানি সংকটে দেশটি।