হোম আন্তর্জাতিক বিশ্ববাণিজ্যের ৯০ শতাংশ নির্ভর করছে প্রধান যেসব পানিপথের ওপর

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

সুপ্রাচীন কাল থেকে আজ পর্যন্ত বিশ্ববাণিজ্যের সিংহভাগ নির্ভর করে আসছে পানিপথের ওপর। প্রধান প্রধান প্রণালি, খাল আর চ্যানেলের মাধ্যমে এক দেশ থেকে আরেক দেশে পণ্য পরিবহনের ৯০ শতাংশের ভরসাস্থল বিস্তৃত এ জলভূমি।

কার্গো বিমান কিংবা সুপার ফার্স্ট রেলপথ; প্রযুক্তির কল্যাণে যাই আবিষ্কার হোক না কেন, বিশ্ববাণিজ্যের আধিপত্য এখনও পানিপথের হাতেই। বিশেষ করে জলবায়ুর কারণে সম্প্রতি পানামা খাল সংকট এবং সংঘর্ষের কারণে লোহিত সাগর সংকট শুরুর পর বিশাল এ জলরাশির ওপর বাণিজ্যিকভাবে বিশ্ববাসী যে একেবারেই নির্ভরশীল সে কথা আরেকবার প্রমাণিত হলো।

সম্প্রতি বিশ্ব অর্থনৈতিক সংস্থার (ডব্লিউইএফ) এক প্রতিবেদনে বিশ্বের প্রধান ৫ পানিপথের নাম প্রকাশিত হয়েছে। সুয়েজ খালের জট, পানামা খালের খরা, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে কৃষ্ণসাগরের উত্তাপ আর লোহিত সাগরের সংঘাতের কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা বলতে গেলে পুরোটাই পানিপথের ওপর নির্ভরশীল। প্রাকৃতিক কিংবা কৃত্রিম যে কারণেই হোক না কেন, পানিপথে পণ্য চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে বিশ্ব বাণিজ্য পঙ্গু হয়ে যাবে।

প্রতিবেদনে গুরুত্বপূর্ণ পানিপথের তালিকায় প্রথমেই স্থান পেয়েছে ইংলিশ চ্যানেল। উত্তর মহাসাগরের সঙ্গে আটলান্টিকের সংযোগ এবং যুক্তরাজ্যের সঙ্গে পুরো ইউরোপের পণ্য পরিবহনের এই চ্যানেলটিকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত পানিপথ।

প্রতিদিন গড়ে ৫০০ মালবাহী জাহাজ ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়। এই ইংলিশ চ্যানেল দিয়ে বিশ্বের ১৭০টি বন্দরে পণ্য পরিবহন করা হয়। এসব বন্দরের মধ্যে পোর্টসমাউথ, লা হার্ভে, চেরবোর্গ ও ব্রেস্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ বন্দরের নাম উঠে এসেছে।

প্রতিবছর এই চ্যানেল মারফত ১৬ মিলিয়ন মানুষ ও ৫ মিলিয়ন পণ্যবাহী জাহাজ মালামাল নিয়ে পৌঁছে যায় বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে। বিশেষ করে পশ্চিমাদের আন্তঃ ইউরোপীয় অর্থনীতির অনেকটাই নির্ভর করে ইংলিশ চ্যানেলের ওপর।

ইংলিশ চ্যানেলের পরেই ডব্লিউইএফের তালিকায় জায়গা পেয়েছে মালাক্কা প্রণালি। ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপপুঞ্জ ও মালয় উপদ্বীপের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া এ প্রণালি ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরকে যুক্ত করেছে। এই প্রণালি আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ হয়ে দক্ষিণ চীন সাগরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।’

ইংলিশ চ্যানেল যেমনি পশ্চিমাদের প্রাণ, তেমনি মালাক্কা প্রণালিকে বলা হয় এশিয়ার বাণিজ্যিক প্রাণচাঞ্চল্যের আধার। জাপান, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারতের মতো বাঘা বাঘা এশীয় অর্থনীতির দেশগুলোর বাণিজ্যের সিংহভাগ নির্ভর করে এ প্রণালির ওপর। এই প্রণালির ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া জাহাজগুলোর মাধ্যমে বিশ্বের ৩০ শতাংশ বাণিজ্যিক চাহিদা পূরণ হয়।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, বছরে গড়ে প্রায় ১ লাখের মতো জাহাজ মালাক্কা প্রণালি পাড়ি দেয়। এশিয়া থেকে শুরু করে বিশ্বের ৪০টি গুরুত্বপূর্ণ বন্দরের পণ্য সরবরাহ এ প্রণালির ওপর নির্ভর করে।

জলবায়ু সংকট থেকে শুরু করে নানা কারণে বর্তমানে মালাক্কা প্রণালির চলাচলের রাস্তা সরু হয়ে আসছে। এরই মধ্যে এই দশকের মধ্যে প্রণালিটির চলাচলের পথ বিস্তৃত করার উদ্যোগ নিতে পারে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো। মালাক্কার সবচেয়ে সরু পথ মালয় উপদ্বীপের কাছে। থাইল্যান্ড সরু এ অঞ্চলে ১০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ব্রিজ তৈরির প্রস্তাব দিয়েছে। ব্রিজ তৈরি করা সম্ভব হলে মালয় উপদ্বীপের জায়গাটিতে পণ্যজট কমে আসবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে।

প্রণালির মধ্যে মালাক্কার পরেই গুরুত্বের জায়গায় আছে হরমুজ প্রণালি। ডব্লিউইএফের মতে, বিশ্বের জ্বালানি তেল বাণিজ্যের সূতিকাগার এ হরমুজ প্রণালি। ইরান ও ওমানের সমুদ্রসীমার মধ্য দিয়ে বয়ে চলা এ প্রণালি একদিকে যেমন যুক্ত করেছে পারস্য উপসাগর ও ওমান উপসাগরকে, একইভাবে যুক্ত হয়েছে আরব সাগরের সঙ্গে।

মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি তেলের বড় বড় বহর এই প্রণালি ব্যবহার করে থাকে। প্রতিদিন হরমুজ প্রণালি হয়ে ২১ মিলিয়ন ব্যারেল জ্বালানি তেল পরিবহন করা হয়। শুধু জ্বালানি তেল নয়, এই প্রণালির মাধ্যমে বিশ্বের ২০ শতাংশ প্রাকৃতিক তরল গ্যাস (এলএনজি) পরিবহন হয়ে থাকে।

তেল পরিবহনে যাতে জট সৃষ্টি না হয়, সে জন্য এই প্রাণালিতে সড়কের মতো করে দুই লেনের পথ ধরে জাহাজ চলাচল করে। বর্তমানে লোহিত সাগরে চলমান সংকটের কারণে জ্বালানি তেল পরিবহনের মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অনেকটা একমুখীভাবে হরমুজ প্রণালির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

ডব্লিউইএফের প্রতিবেদনের তালিকায় থাকা চতুর্থ ও বিশ্ববাণিজ্যে ব্যবহৃত খালের মধ্যে শুরুতেই উঠে এসেছে মিশরের সুয়েজ খালের নাম। সুয়েজ খাল ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরকে যুক্ত করেছে এবং দ্বিখণ্ডিত করেছে ইউরোপ ও এশিয়াকে।

লোহির সাগরের একদম শেষ মাথায় এবং বাবেল আল মান্দেব উপসাগরের কাছে অবস্থিত এ খালটিকে বলা হয় ইউরোপ-এশিয়া বাণিজ্যপথের সবচেয়ে সহজ রাস্তা। কোনো কারণে সুয়েজ খাল বন্ধ হয়ে গেলে এশিয়া-ইউরোপের বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ অব গুড ঘুরে আসতে হবে, যা একদিকে সময়সাপেক্ষ অন্যদিকে ব্যয়বহুল।

১৮৬৯ সালের ঔপনিবেশিক আমলে ফ্রান্স তার সুবিধার জন্য মিশরে এই খালটি খনন করেছিল। বিভিন্ন মেয়াদে সংস্কারের পর বর্তমানকালে সুয়েজ খালের দৈর্ঘ্য প্রায় ২০০ কিলোমিটার। প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার জাহাজ সুয়েজ খাল হয়ে চলাচল করে।

প্রতিবেদনের তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ পানিপথ হিসেবে সব শেষে জায়গা পেয়েছে পানামা খাল। ১৯১৪ সালে খনন করা এ খালটি আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরকে যুক্ত করেছে।

শুরুর দিকে সংকুচিত হওয়ার কারণে পানামা খাল দিয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট কার্গো জাহাজ চলাচল করলেও কয়েক দফা সংস্কারের পর এ খালের মাধ্যমে এখন বড় বড় ভেসেল জাহাজও পণ্য পরিবহন করছে। মূলত দক্ষিণ আমেরিকার কেপ হর্ন ঘুরে আসার থেকে পানামা খাল হয়ে যাতায়াত সহজ হওয়ায় বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর পছন্দের জায়গায় স্থান করে নিয়েছে এ খাল।

পানামা খাল হয়ে ১৭০টি দেশের ২ হাজার বন্দরে পণ্য পরিবহন হয়ে থাকে। ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, এ খালে ১৪ হাজার পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করেছে। তবে লম্বা সময় পানামা খালে খরা চলার কারণে জাহাজ চলাচল আগের থেকে কমেছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

পানামা খালের খরা প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাহাজ চলাচল স্বাভাবিক করতে যে পরিমাণ পানি দরকার তার থেকে প্রায় ১ লাখ কিউবিক মিটার পানি কম আছে পানামা খালে। এতে জাহাজ চলাচলে যেমন বিঘ্ন হচ্ছে, তেমনি বিশ্ব বাণিজ্যেও পড়ছে বিরূপ প্রভাব।

প্রাক-ঔপনিবেশিক ও ঔপনিবেশিক আমলে পানি পথে সংঘাত ও যুদ্ধ নিত্য বছরের ঘটনা থাকলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এসব সংঘাতের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছিল। কিন্তু করোনা-পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা ও মেরুকরণের রাজনীতিতে আবারও অস্থির হয়ে উঠেছে পানিপথ। এর সঙ্গে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু সংকট। এসব মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক সংকট চলমান থাকলে বিশ্ব সরবরাহ ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়বে বলে প্রতিবেদনটিতে শঙ্কা প্রকাশ করেছে ডব্লিউইএফ।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন