হোম অর্থ ও বাণিজ্য বিলম্বে হলেও স্বীকৃতি পেল বিজ্ঞানী মুবারকের উদ্ভাবন

বাণিজ্য ডেস্ক:

বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশনের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা মুবারক আহমেদ খান ২০১৭ সালে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে উদ্ভাবন করেছিলন পাঁটের তৈরি পলিথিন সদৃশ পরিবেশবান্ধব ব্যাগ। দীর্ঘ ছয় বছরের চেষ্টায় অবশেষে নিজের উদ্ভাবনের সরকারি স্বীকৃতি পেলেন তিনি।

বৃহস্পতিবার (৩১ আগস্ট) বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস উপলক্ষে রাজধানীর একটি হোটেলে শিল্প মন্ত্রণালয় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বিজ্ঞানী মুবারকের হাতে তার উদ্ভাবনের পেটেন্ট সনদ তুলে দেন।

সনদপ্রপ্তির অনুভূতি জানিয়ে মুবারক বলেন, ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি তৎকালীন সরকার রাজধানীতে পলিথিনের শপিং ব্যাগ উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ওই বছর ৩১ মার্চ সারা দেশে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার ঘোষণা দেয়া হয়। তখনই বলেছিলাম, যতই পলিথিন নিষিদ্ধ করা হোক না কেন, এর উপযুক্ত বিকল্প আবিষ্কার করতে না পারলে কোনোভাবেই পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না।

উচ্ছ্বসিত মুবারক জানান, এরপর দীর্ঘসময় গবেষণা শেষে ২০১৭ সালে পাট দিয়ে এক ধরনের পলিমার তৈরি করতে সক্ষম হই, যা দেখতে হুবহু পলিথিনের মতো, কিন্তু আসলে পলিথিন না। পাটের তৈরি এ ব্যাগ সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব। এটি পানিতে গলে, মাটিতে পচে, নিঃসরণ করে না কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মতো কোনো ক্ষতিকর গ্যাস। ভয় ছিল, এত কষ্টের পরেও এ ব্যাগ স্বীকৃতি পাবে না। চুরি হয়ে যাবে পেটেন্ট। কিন্তু এই ভয় কাটিয়ে, সব বাধা পেরিয়ে আজকে আমার উদ্ভাবন সারাদেশে স্বীকৃতি পেয়েছে।

তিনি বলেন, ‘পরিবেশে পলিথিন ভেঙে অতি দ্রুত মাইক্রোপ্লাস্টিক এবং ন্যানোপ্লাস্টিক হয়ে যাচ্ছে। মাটি-পানিতে মিশে থাকা এ প্লাস্টিক ছড়িয়ে পড়ছে সব জায়গায়। সাধারণ খাদ্যের কথা না হয় বাদ দিলাম, মায়ের বুকের দুধে পর্যন্ত মিলছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। যেখানে পরিবেশের অবস্থা এমনই দুর্বিষহ সেখানে স্বস্তির বার্তা দিতে পারে এই আবিষ্কার। শুধু এই আবিষ্কার দিয়েই বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে ব্র্যান্ডিং করা যাবে।’

নিজের চেষ্টার কথা উল্লেখ করে মুবারক বলেন, শুরুতে আমি বাঁশ এবং ভাতের মাড় দিয়ে ব্যাগ তৈরির চেষ্টা করেছিলাম। পরে ভাবলাম এতসব কেন যখন আমাদের দেশের পাটেই রয়েছে সমূহ সম্ভাবনা। এই পলিমার দিয়ে শুধু ব্যাগ না, করোনার সময়ে পিপিপি পর্যন্ত বানিয়েছিলাম আমি। পেটেন্ট পাওয়ার মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে এই ব্যাগ ব্যবহারে আর কোনো বাধা রইল না।

রাজধানীর ডেমরায় অবস্থিত সরকারি মালিকানাধীন লতিফ বাওয়ানী জুট মিলে প্রথমবারের মতো এই ব্যাগ তৈরি করেন মুবারক। পরে নানা জটিলতায় এই ব্যাগের বাণিজ্যিক ব্যবহার প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তবে পেটেন্ট পাওয়ার মাধ্যমে এখন এর সর্বাত্মক উৎপাদন এবং বাজারজাতে আর কোনো বাধা নেই উল্লেখ করে শিল্পমন্ত্রী বলেন, একেবারে ক্ষুদ্র পরিসরেই এই ব্যাগের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করা যায়। যেভাবে পলিথিন কারখানায় পলিথিন উৎপাদন হয়, চাইলে এখন থেকে সেভাবে এ ব্যাগ উৎপাদন করা যাবে।

ব্যাগটির পেটেন্ট আন্তর্জাতিক মানের করার ওপর গুরুত্ব দিয়ে পেটেন্ট ও ট্রেডমার্ক অধিদফতরের সাবেক রেজিস্ট্রার ছানোয়ার বলেন, ‘বিজ্ঞানী মুবারকের এ আবিষ্কার আন্তর্জাতিক মানের। আপাতত তিনি দেশে পেটেন্ট পেয়েছেন। তার এই মেধাসম্পদকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে আন্তর্জাতিক পেটেন্টের জন্য আবেদন করা উচিত শিল্প মন্ত্রণালয়ের। কেবল পেটেন্ট নিয়ে অবহেলার কারণে জগদীশ চন্দ্র বসু রেডিওর আবিষ্কারক না হয়ে আবিষ্কারক হয়েছেন মার্কোনি। পেটেন্ট নিয়ে অবহেলার কোনো সুযোগ নেই।’

এর আগে বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস ২০২৩ উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে সাম্প্রতিক সময়ে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রাপ্ত ৭টি পণ্যের সনদ প্রদান করা হয়। নিবন্ধন পাওয়া সাতটি জিআই পণ্যের সনদ সংশ্লিষ্টদের হাতে তুলে দেন শিল্পমন্ত্রী।

তিনি বলেন, নতুন ৭টি পণ্যকে জিআই সনদ দেয়া হয়েছে। এগুলো হলো- রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম, বাংলাদেশের শীতল পাটি, বগুড়ার দই, শেরপুরের তুলশীমালা ধান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আম, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আশ্বিনা আম ও নাটোরের কাঁচাগোল্লা।

শিল্পমন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশ পেটেন্ট আইন, ২০২২, বাংলাদেশ শিল্প-নকশা আইন, ২০২৩ প্রনয়ণ করা হয়েছে এবং ট্রেডমার্ক আইন, ২০০৯ সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এরইমধ্যে ইলিশ, জামদানি, রংপুরের শতরঞ্জজিসহ ১৭টি পণ্যকে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে, যা বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতি লাভবান হতে পারে। বাংলাদেশে মেধাসম্পদ সংরক্ষণ ব্যবস্থা যত শক্তিশালী হবে, এদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ তত বাড়বে।

তিনি বলেন, ‘নতুন উদ্ভাবন ও সৃষ্টিশীলতার প্রকাশই মেধাসম্পদ আর এই উদ্ভাবন ও সৃষ্টিশীলতাকে উৎসাহিত করার সাথে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। জাতি হিসেবে আমরা যত বেশি জ্ঞানভিত্তিক উদ্ভাবন ও সৃষ্টিশীলতাকে কাজে লাগাব, তত বেশি সমৃদ্ধির দিকে অগ্রসর হতে পারবো। একবিংশ শতাব্দীতে এসে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এখন আমরা উন্নয়নশীল দেশের অন্তর্ভুক্ত হয়েছি, এই উন্নয়নশীলতা ধরে রাখতে না পারলে আমরা আবার পিছিয়ে যাব।’

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, শিল্প সচিব জাকিয়া সুলতানা, পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমাকর্স অধিদফতরের মহাপরিচালক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন