আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধান মোহাম্মদ জিয়াউল হকের মৃত্যু এখনও রহস্যে ঢাকা। ১৯৮৮ সালের ১৭ আগস্ট মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। পাকিস্তানের বাহাওয়ালপুরে তাকে বহনকারী সি-১৩০ বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। এতদিনেও এই রহস্যের কোনও কূলকিনারা হয়নি।
অনেকেই জেনারেল জিয়াউল হকের মৃত্যুকে নিছক দুর্ঘটনা নয়, নাশকতা বলে মনে করেন। শুধু তাই নয়, এই দুর্ঘটনার আড়ালে যুক্তরাষ্ট্রের হাত রয়েছে এমন ধারণাও প্রচলিত আছে অনেকের মধ্যে। সেদিন বিমানটিতে জিয়াউল হকের সঙ্গে ছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্নল্ড লুইস রাফেলও। এছাড়া তাদের সঙ্গে কয়েকজন শীর্ষ পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা নিহত হন।
গত তিন দশক ধরে অনেকেই অনুমান করেছেন নাশকতা করেই জিয়াউল হককে মেরে ফেলা হয়েছে। তাদের বিশ্বাস, বাহাওয়ালপুরে বিমানে আম বোঝাই একটি ক্রেটে বিস্ফোরক লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান ও মার্কিন কর্তৃপক্ষ বার বার এটি অস্বীকার করেছে এবং তাদের মৃত্যুকে নিছক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিয়েছে।
তবে জিয়াউল হকের মৃত্যুর ৩২ বছর পর, তার ছেলে পাকিস্তানের সাবেক ফেডারেল মন্ত্রী মুহাম্মদ ইজাজুল হক দাবি করেছেন, তার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। এ বিষয়ে তিনি যথেষ্ট তথ্য- প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন। তার দাবি, বিমানের ককপিটে নার্ভ গ্যাস স্প্রে করার কারণে বিমানটি অকেজো হয়ে গিয়েছিল।
এছাড়া আমের খাঁচায় বিস্ফোরক থাকার বিষয়টিও নিশ্চিত করেছেন ইজাজুল হক। এর পাশাপাশি একটি প্রজেক্টাইল দিয়েও বিমানটিতে বাইরে থেকে আঘাত করা হয়েছে।
রাওয়ালপিন্ডিতে নিজের অফিসে তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম আনাদোলু এজেন্সির সঙ্গে একটি একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন ইজাজুল হক। বিপদে পড়ার ভয়ে এ বিষয়ে কেউ মুখ খুলতে চান না বলেও দাবি তার।
তিনি দাবি করেন, সেই সময়ের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মির্জা আসলাম বেগ, সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল মাহমুদ আলী দুররানির ভূমিকা ছিল সন্দেহজনক। তিনি যথেষ্ট তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে এই কথা বলেছেন বলেও দাবি করেন। ভারতীয় ও ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা থেকে এসব তথ্য যোগাড় করেছেন এবং দাবি করেন, ভারত ও ইসরাইলও তার বাবার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল।
বিমানটি কীভাবে বিধ্বস্ত হয়েছিল আনাদোলু এজেন্সির এক প্রশ্নের জবাবে ইজাজুল বলেন, ‘যখন দুর্ঘটনা ঘটেছিল, তখন আমরা যতটা সম্ভব কারণ নিয়ে অনুসন্ধান করার চেষ্টা করি। কিন্তু শুরু থেকেই ঘটনাটিকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা চলেছে। সেটা দেশের ভেতর ও বাইরে দু’দিক থেকেই। তবে একটি বিষয় তখন আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে ওঠে মার্কিন-পাকিস্তান বিমান বাহিনীর যৌথ তদন্তের পর, আমেরিকানরা শুরু থেকেই তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়েছে এটি প্রমাণ করার জন্য যে, ঘটনাটি একটি নিছক দুর্ঘটনা।’
ইজাজুল জানিয়েছেন, সেই তদন্ত রিপোর্টের প্রায় ৩৪-৩৫ পৃষ্ঠা প্রকাশ করা হয়েছিল। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট গুলাম ইসহাক খান, যিনি তার বাবার পরে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন, তখন ঘোষণা করেছিলেন যে, রিপোর্ট নিশ্চিত করেছে যে এটি দুর্ঘটনা নয়, নাশকতা ছিল। এরপর থেকে তারা বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একটি দল এই মামলার তদন্ত করে। সেই তদন্ত দলে বিমানবাহিনীর একজন সিনিয়র তদন্তকারী ছিলেন; সেই সময়ে কমোডর, যিনি সেনাবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ারের সমান। তার নাম ছিল এয়ার কমোডর জহির জাইদি।
ইজাজুল জানান, এয়ার কমোডর জহির জাইদি কাউকে কিছু না বলে পাকিস্তানের শীর্ষ গবেষণাগারে বিমানের ধ্বংসাবশেষের কিছু অংশ নিয়ে যান। ওই সময় গবেষণাগারের চেয়ারম্যান ছিলেন তার আত্মীয়। সেখানে বিমানের ধ্বংসাবশেষ এবং আমের খোসার রাসায়নিক বিশ্লেষণ করিয়েছিলেন। সেই রিপোর্টে প্রমাণিত হয়, এটি একটি অপরাধমূলক কাজ ছিল। রিপোর্টে বেশ কিছু অ্যান্টিমনি ফসফরাস পাওয়া যায়, যার মানে হলো- সেখানে নাশকতা ঘটানো হয়েছে।
শুধু তাই নয়, একাধিক পরিকল্পনা করে তাদের হত্যা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়েছে বলেও দাবি ইজাজুলের। তিনি জাইদির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, তারা এটাও জানতে পারেন শুধু একটি বিস্ফোরণই হয়নি। একটি ব্যর্থ হলে যাতে অন্যটি কাজ করে তা নিশ্চিত করা হয়েছিল।
‘তাই, বিমানের ককপিটে নার্ভ গ্যাস রাখা হয়েছিল। এই গ্যাস এতটাই শক্তিশালী যে এটি পাইলটদের পঙ্গু করে দেয়। বিমানটি মাটিতে নামার আগে কেন উপরে এবং নিচে চলে গিয়েছিল তার কারণটাই ছিল এই গ্যাস। পাইলটদের দেহ অবশ হয়ে গিয়েছিল। তারা কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেসনি। তারা কাঁপছিলেন। এছাড়াও ইজাজুল জানান, তার বাবাকে যে ট্রফি দেয়া হয়েছিল তার একটিতে গ্যাস রাখা ছিল। তারা এটি নিয়ে ককপিটে রাখে।’
একজন প্রেসিডেন্ট মারা গেছেন সেই সত্য তারা কেন প্রকাশ করার চেষ্টা করবে না? এটি কি কোনও রাজনৈতিক প্রতিশোধ? এই প্রশ্নের উত্তরে জিয়াউল হকের ছেলে মুহাম্মদ ইজাজুল হক বলেন, ‘আমার মনে হয় এটি কিছুটা রাজনৈতিক প্রতিশোধ ও কিছুটা তাদের ওপর বাইরের চাপ।’
সাক্ষাৎকারে ইজাজুল জানান, তার বাবার মৃত্যু রহস্য বিভিন্নভাবে ঢেকে রাখার চেষ্টা চলেছে। তার মধ্যে একটি হলো, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নির্দেশে মৃতদেহের পোস্টমর্টেম বন্ধ করা।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়নি। টুকরো টুকরো মরদেহ নিয়ে লাহোরের একটি গবেষণাগারে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু শেষ মুহূর্তে তা করতে নিষেধ করা হয়েছে। শুধু ব্রিগেডিয়ার মো. জেনারেল রবার্ট ওয়াসম, যিনি ইউএস মিশনে সামরিক কূটনীতিক ছিলেন তার ময়নাতদন্ত করা হয়েছিল। এর কারণ হলো, তার দেহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত যাওয়ার কথা ছিল।
বিমান দুর্ঘটনায় নিহত ২৯ জনের ময়নাতদন্ত করার কথা ছিল মুলতানের একটি সামরিক হাসপাতালে। কিন্তু তাদের সামনে না এগোতে বলা হয়েছিল। উপর থেকে এই আদেশ এসেছিল বলে সাক্ষাৎকারে বলেন ইজাজুল। এরপর ওই হাসপাতালের কর্মকর্তা ও চিকিৎসকদের পাকিস্তানের দূরবর্তী এলাকায় বদলি করা হয়। জাইদি, যিনি ১০০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন লিখেছেন তাকেও হয়রানি করা হয়েছিল। পরে তিনি মারা যান।
জেনারেল মুহাম্মদ জিয়াউল হককে একজন নম্র, দয়ালু এবং উদার মনের মানুষ বলে উল্লেখ করেছেন ছেলে ইজাজুল। তিনি বন্ধুর মত পিতা ছিলেন তার কাছে, পিতার চেয়েও ভাইয়ের মত বেশি। ইজাজুল দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘তিনি যতটা সময় তার বাবার সঙ্গে থাকতে চেয়েছেন ততটা সময় তিনি থাকতে পারেননি।’
সূত্র: আনাদোলু এজেন্সি