হোম জাতীয় বাংলাদেশে লোকালয়ে বাড়ছে শিয়ালের আক্রমণ, সতর্ক করলেন বিশেষজ্ঞরা

বাংলাদেশে লোকালয়ে বাড়ছে শিয়ালের আক্রমণ, সতর্ক করলেন বিশেষজ্ঞরা

কর্তৃক Editor
০ মন্তব্য 15 ভিউজ

অনলাইন ডেস্ক:

বাংলাদেশে দিনেদুপুরে লোকালয়ে শিয়ালের আক্রমণ বেড়েছে। দেশে বনভূমি কমে যাওয়ায় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানুষের ওপর শিয়ালের আক্রমণের ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তাদের মতে, শিয়াল সাধারণত লাজুক প্রাণী। বনভূমি কমে যাওয়ায় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দিন দিন এদের আবাস্থল সংকুচিত হচ্ছে এবং এরা লোকালয়ে চলে আসছে। আর কখনো কখনো মানুষদের কামড়াচ্ছে।

জাহান পরিবার বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বাস করে। এই পরিবারের কেউ কখনো কাছ থেকে শিয়াল দেখেনি। তবে গত নভেম্বরে সকালে ৪ বছরের মুসকানকে ধান ক্ষেতে ধাওয়া করে এবং তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এক পাগলা শিয়াল। প্রাণীটির কামড়ে মারাত্মকভাবে আহত হয় শিশুটি। পরে গ্রামবাসী শিয়ালটিকে পিটিয়ে মারে।

মুসকান এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকলেও দ্রুত চিকিৎসার কারণে সে সুরক্ষিত আছে, তবে তার মুখে কামড়ের দাগ রয়েছে এবং একটি চোখ ফুলে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে রয়েছে।

সংবাদ সংস্থা এএফপিকে মুসকানের তার খালা ইশরাত জাহান জানান, এটা দিনদুপুরে ঘটেছে। এক শিয়াল তাকে মাটিতে ফেলে ক্ষতবিক্ষত করেছে। পরে গ্রামবাসীরা সেটিকে মেরে ফেলে। তবে সবাই এখনো সেই ঘটনাকে ভুলতে পারেনি।

গোল্ডেন জ্যাকাল বা সোনালি শিয়াল নেকড়ের মতো দেখতে এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এরা বাস করে। আকারে এরা গ্রে-হাউন্ড কুকুরের সমান, তবে ওজন আরও কম। মুসকানের ওপর যে শিয়াল হামলা করে, সেটি ছিল অস্বাভাবিক। শিয়াল নিশাচর প্রাণী। তবে এই শিয়ালদিনের বেলায় মুসকানের ওপর হামলা করেছে।

ঢাকার ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী গবেষক জোহেব মাহমুদ বলেন, গত ৮ বছর ধরে সোনালি শিয়ালের আচরণ নিয়ে গবেষণা করেছেন তিনি। এই পর্যবেক্ষণে মাহমুদ দেখেন যে, বনভূমি কমে যাওয়ায় শিয়ালের আচরণে পরিবর্তন এসেছে।

তিনি আরো বলেন, একসময়কার লাজুক প্রাণী হিসেবে পরিচিত শিয়াল এখন মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং দিনের বেলায়ও বের হয়।

নগরায়ণ এবং ব্যাপক পরিমাণে গাছ কাটার কারণে শিয়ালদের মূল বাসস্থানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ-এর তথ্য অনুযায়ী, গত বছরে বাংলাদেশ প্রায় ১৭ হাজার ৮০০ হেক্টর (৪৪ হাজার একর) বনাঞ্চল হারিয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটন শহরের প্রায় তিনগুণের সমান।

গবেষক মাহমুদ সতর্ক করে বলেন, যত দিন বনভূমি ধ্বংসের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে, তত দিন শিয়ালের আক্রমণ বন্ধ হবে না।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। তাই এখন আরো বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বন্যার সম্মুখীন হচ্ছে দেশটি। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর ফলে শিয়াল তাদের বাসস্থল হারাচ্ছে ও খাদ্য সংকটে ভুগছে, যা তাদের লোকালয়ে কাছে আসতে বাধ্য করছে।

গত সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশে ব্যাপক বন্যা হয়, যার ফলে বহু মানুষের ঘরবাড়ি পানিতে ভেসে যায়। এসব এলাকার শেয়ালরাও তাদের বাসস্থান হারিয়েছে। তাই এরা বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে মানুষকে কামড়াচ্ছে।

শেয়ালের কামড়ে আহত নীলফামারীর ওবায়দুল ইসলাম বলেন, বন্যার কারণে শেয়ালরা তাদের আবাস্থল হারিয়েছে ও খাদ্য সংকটে ভুগছে। তাই এরা আমাদের গ্রামে এসে ১২ জনেরও বেশি লোককে কামড়িয়েছে।

আরণ্যক পরিবেশবাদী সংস্থার নির্বাহী পরিচালক রাকিবুল হাসান মুকুল বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের মৌসুমি বন্যাকে আরো তীব্র করে তুলছে। এর ফলে মানুষ তাদের ভূমি হারাচ্ছে এবং আরো বেশি বনভূমি উজাড় করছে। এতে মানুষের সঙ্গে বন্যপ্রাণীর সংঘর্ষ বাড়ছে।

সংকটে বন্যপ্রাণী

শিয়াল কত জন মানুষকে কামড়িয়েছে এমন নির্দিষ্ট তথ্য বা জরিপ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই। তবে বিভিন্ন হাসপাতালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বছর এ রকম হামলার সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে।

মুন্সিগঞ্জ জেলার এক হাসপাতালের অধ্যক্ষ দেবান নিজাম উদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, শেয়ালের কামড়ে আহত হয়ে গত সেপ্টেম্বর মাসে তাদের হাসপাতালে একদিনে ২০ জন রোগী ভর্তি হয়। এভাবে এক দিনে এত শেয়ালের হামলার ঘটনা আগে কখনো হয়নি।

অপরদিকে দিনাজপুরে আরেক হাসপাতালের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ফজলুর রহমান বলেন, আমরা নিয়মিতভাবে শেয়ালের কামড়ে আহত রোগীদের চিকিৎসা করছি। শেয়ালগুলো এখন মুক্তভাবে ফসলি জমিতে ঘুরছে।

গোল্ডেন জ্যাকালরা সাধারণত শান্ত প্রকৃতির, মানুষের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ রাখে না। তবে এরা র‍্যাবিস ভাইরাসে আক্রান্ত হলে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। কুকুরের মধ্যে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এই ভাইরাস। যদি আক্রান্ত প্রাণী মানুষের রক্ত শোষণ করে, তাহলে এটি মানবদেহে ছড়িয়ে যায়।

মুসকানকে গত মাসে কামড়ানো হয়েছিল, কিন্তু দ্রুত চিকিৎসা দেওয়ার কারণে তাকে জলাতঙ্ক থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়। কিন্তু তার আঘাত খুব গভীর এবং তাকে অস্ত্রোপচারের জন্য মাসের পর মাস হাসপাতালে থাকতে হবে।

হাসপাতালের এক চিকিৎসক আরিফুল বাসার এএফপিকে বলেন, আমরা র‍্যাবিস ভ্যাকসিন দিয়ে রক্ষা করতে পারি, তবে বেশির ভাগ সময়ই শিয়াল মানুষের গোশত ছিঁড়ে ফেলে, যার ফলে তাদের অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়।

গত মাসে আহত হওয়ার পর জলাতঙ্ক সংক্রমণ প্রতিরোধে তিন দিন চিকিৎসা নেয় মুসকান। এরপর আঘাতের চিকিৎসার জন্য এক মাস হাসপাতালে ভর্তি ছিল শিশুটি। ওই আক্রমণের ঘটনায় এখনো সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন