হোম জাতীয় নদীর দেশে নদীই করালগ্রাসে

জাতীয় ডেস্ক :

বাংলাদেশে শিরা-উপশিরার মতো ছড়িয়ে আছে ছোট-বড় অসংখ্য নদ-নদী। উত্তরের হিমালয় থেকে নেমে আসা এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোই বাংলাদেশের জলজীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু বর্তমানে প্রায় সব নদীতেই পানি প্রবাহ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত। এসব নদীতে প্রয়োজনের তুলনায় পানি থাকে অনেক কম, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে।

এতে বাংলাদেশের কৃষি, স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে পরিবেশ-প্রতিবেশ ভয়ঙ্কর করালগ্রাসে আক্রান্ত। প্রায় সব নদীর উজানে, নিজের অংশে হয় ব্যারাজ নয় ড্যাম তৈরি করে একতরফা পানি প্রত্যাহার করছে ভারত। এতে ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রাণপ্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য।

আবার নিজেদের দখলে-দূষণে হারিয়ে যাচ্ছে নদীগুলো, বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জলপ্রবাহ। দেশে অবৈধভাবে নদ-নদী দখল নিয়ে আলোচনাও কম হচ্ছে না। সব জেলায় অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করে তা টানিয়ে দেয়া হয়েছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের উচ্ছেদ অভিযানসহ নানা তৎপরতার পরও সাফল্য আসছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো এতো চমৎকার নদীমাতৃক দেশ পৃথিবীর আর কোথাও নেই। কিন্তু সেই নদীগুলোকে আমরা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছি। নদীগুলো ভরাট করে ফেলছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা।

আন্তঃনদী সমস্যা মিটছে না

আন্তঃনদী সমস্যা নিয়ে জানতে চাইলে অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আশরাফ দেওয়ান বলেন, শক্তিশালী কূটনৈতিক চেষ্টার মধ্য দিয়ে এ সংকটের সমাধান করতে হবে। চীন যদি ব্রহ্মপুত্রে বাঁধ দেয়, তাতে ভারতের যেমন অসুবিধা হয়, তেমনি বাংলাদেশেরও হবে। আমাদের অসুবিধার কারণ আমরা হলাম ভাটির দেশ।

কূটনৈতিক দুর্বলতার জন্যই আন্তঃনদী সমস্যার সমাধান হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। এই গবেষক জানান, আমাদের লোকজন যারা বিদেশে যান সরকারের প্রতিনিধি হয়ে, তাদের সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যে কারণে কূটনৈতিক আলোচনায় আমরা পেরে উঠি না। নিজেদের দাবিগুলো যথাযথ তথ্যপ্রমাণ দিয়ে তারা তুলে ধরতে পারছেন না।

আন্তঃসীমান্ত নদীগুলো বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে। যে কারণে বন্যা ও খরা দুটতেই আমাদের ভুগতে হয়।

আশরাফ দেওয়ান আরও বলেন, ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। কিন্তু সেটার মেয়াদ আরও বাড়বে কিনা; তা নিয়ে কোনো কথা হচ্ছে না। এমনিতেই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততা দিনদিন ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে। ফলে সুপেয় পানির সংকটে জনস্বাস্থ্য যেমন সংকটাপন্ন, তেমনি কৃষির উপর বিরূপ প্রভাব সুস্পষ্ট। তাই আমাদের গঙ্গার চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু করা জরুরি।

তিনি জানান, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। নরেন্দ্র মোদির কেন্দ্রীয় সরকার ও পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জির মধ্যে রেষারেষির কারণে আটকে আছে চুক্তিটি। ভারতের অভ্যন্তরীণ কারণে আমরা ভোগান্তিতে পড়েছি। এখন কিছু জিনিস আমাদের হাতে আছে, কিছু জিনিস হাতের বাইরে। কাজেই পশ্চিমবঙ্গ ও কেন্দ্রীয় সরকার যতদিন পর্যন্ত একমত না হবে, ততদিন এর সমাধান নাও হতে পারে।

আশরাফ দেওয়ান আরও জানান, গঙ্গা নদীতে বন্যার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। তার কারণ, যে পানি ভারত শীতকালে ধরে রাখে, তাতে যে পলিটা জমে, গ্রীষ্মকালে পানি ছেড়ে দেয়ার সময় পলিসহ তা চলে আসে। পলি-পানি একসঙ্গে আসার কারণে তার শক্তি বেড়ে যায়। বাংলাদেশের মাটি পলিতে গড়া। মাটি বসে যাওয়ার জন্য যে সময় লাগে, সেটা পায় না। ফলে বর্ষার সময়সহ সারা বছর নদীভাঙনে ভূমি হারাচ্ছে বাংলাদেশ।

নদী দখল প্রসঙ্গে আশরাফ দেওয়ান বলেন, নদীখেকো ও বালুখেকোদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। সরকারের নাম ভাঙিয়ে নদীখেকো ও বালুখেকোরা দেশের সর্বনাশ করছে। আমাদের দেশে নদী-নদীগুলোর বর্তমান সমস্যার জন্য আমরা সবাই মোটামুটি দায়ী। আমাদের দেশের মানুষদের সহজেই কিনে ফেলা যায়, যে কারণে বিদেশিরাও সেই সুযোগটা নিচ্ছে। নদী কমিশন অনেক কিছু করার চেষ্টা করে, কিন্তু তারা পেরে ওঠে না।

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ভারতের সঙ্গে তিস্তা নিয়ে দর কষাকষি চালাতে হবে, তাদের জন্য আমরা কেন ক্ষতিগ্রস্ত হব? আমাদের তো ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। অনিয়মিত ও অসময়ের বন্যা বাড়ছে। নদী ভাঙনে বসতবাড়িগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে আন্তর্জাতিকভাবে জিততে হলে নদী নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা বাড়াতে হবে। কর্মকর্তাদের কূটনীতিতেও পরাদর্শী হতে হবে। আমাদের নদীগুলোর উৎপত্তি ভারত ও চীন থেকে। দুই দেশই পরাশক্তি। তাদের সঙ্গে জিততে হলে তথ্য-উপাত্তভিত্তিক কথা বলতে হবে।

নদী রক্ষায় সরকারের আন্তরিকতা আছে বলে জানান আশরাফ দেওয়ান। কিন্তু স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে।

তিনি বলেন, সরকার আরেকটু আন্তরিক হলে সেই সমস্যাও কমে যাবে। তাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার। মনে রাখতে হবে আমাদের কৃষ্টি, সংষ্কৃতি, বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা নদনদীর উপর নির্ভরশীল। নদীতে আমরাই বর্জ্য ফেলছি, দূষিত করছি। আবার নদীতে বাঁধ নির্মাণ করছি। এক পাড়ে বাঁধ দিলে আরেক পাড় ভাঙবে-এটিই নদীর নিয়ম। নদী একটি জীবন্ত প্রবাহ। এখন কেবল আইন করলেই হবে না; আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

নদী জীবন্ত সত্তা

বছর তিনেক আগে তুরাগ নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। একটি পরিবেশবাদী আন্দোলনের রিটের প্রেক্ষাপটে আদালত থেকে রায়টি এসেছিল। রিট আবেদনকারী আইনজীবী মনজিল মোরশেদ তখন বলেন, আদালতের ঘোষণা অনুযায়ী, এখন থেকে তুরাগসহ নদ-নদীগুলো মানুষ বা প্রাণী যেমন কিছু আইনি অধিকার পায় তেমনি অধিকার পাবে।

তিনি জানান, এ রায়ের ফলে নদীর কিছু আইনি অধিকার তৈরি হয়েছে। নদী নিজেই তার ক্ষতির বা দখলের বিষয়ে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবে। তবে নদী তো আর নিজে যেতে পারবে না। সেক্ষেত্রে কেউ তার প্রতিনিধি হয়ে ক্ষয়ক্ষতিগুলো আদালতকে জানালে তার প্রতিকার পাবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, বিষয়টি নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি আছে। এখন থেকে কুড়ি বছর আগে নিউজিল্যান্ডের একটি নদীকে জীবন্ত সত্তার মর্যাদা দেয়া হয়। অর্থাৎ নদী মানুষের মতোই অধিকার পাবে। আর সেটা হচ্ছে ধর্মীয় কারণে। ওই নদীটাতে ওখানকার মাউরি উপজাতি দেবতার মতো পূজা করে। কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াতে একটি আন্দোলন চলছে, যাতে উপজাতিরা নিজেদের ভূমি অধিকার দাবি করছে। এখন তাদের যতদূর সম্ভব পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে। যে কারণে নিউজিল্যান্ডের সংবিধান পরিবর্তন করে নদী সত্তা দেয়া হয়।

এরপর ইকুয়েডর ও দক্ষিণ আমেরিকাতেও একই পদক্ষেপ নেয়া হয়। যার পেছনে অবশ্য শক্তিশালী কারণ ছিল। একটি মাইনিং কোম্পানির খনিজ সম্পদ তোলার সময় পাথর ভাঙে, যার বজ্র নদীতে ফেলে দেয়া হয়। এতে একসময় নদীর পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। নদীর ধর্ম হচ্ছে একদিকে প্রবাহ আটকে দিলে সে অন্যদিকে চলে যাবে।

পরিবেশগত আইন বিবেচনায় নিয়ে সেখানকার সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন, বর্জ্য ফেলে আপনারা নদীটাকে মেরে ফেলেছেন। এরপর ভারতের উত্তরাখণ্ডের একটি আদালত রুলিং দিয়ে গঙ্গা নদীর একটি শাখা নদীকে জীবিত সত্তা ঘোষণা করে। কিন্তু তার একমাসের মধ্যেই ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট সেই আইন বাতিল করে। এই রুলিংয়ের কোনো বৈধতা থাকল না। এরপরেই বাংলাদেশের ঘটনা আসে। রাজধানী ঢাকার চারপাশের নদীগুলোকে রক্ষা করার কথা বলেছেন আদালত।

আইনুন নিশাত মনে করেন, সুপ্রিম কোর্ট রুলিং দিয়েছেন, তা বাস্তবায়নে কাউকে ব্যবস্থা নিতে হবে। তো সেই ব্যবস্থা কেউ কি নিয়েছেন? নদীগুলোকে বাঁচাতে কার্যকর ব্যবস্থা কোথায়?

নদী রক্ষা কমিশনের পদক্ষেপ
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, মাস ছয়েক আগে আমি এই কমিশনে যোগ দিই। এরইমধ্যে আমরা যা করেছি, তা হলো প্রথমত নদী দখলকারীদের একটি তালিকা বানিয়েছি। তাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। এ কাজটা আমরা ভালোভাবেই করতে পেরেছি।

দূষণের বিরুদ্ধে নেয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, আমরা ব্যাপক প্রচার চালিয়েছি। অনেক জায়গায় গিয়েছি। প্রশাসনকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছি, তারা যাতে দূষণকারীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসেন। আমরা একটি নীতিমালা করেছি। যারা দখল-দূষণ দুটোতেই জড়িত, তারা আমাদের দৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় অপরাধী। জানতে পারলেই তাদের ধরার চেষ্টা করছি।

তিনি আরও বলেন, আমরা মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে পেরেছি। আমরা সরকারের ওপর চাপ তৈরি করেছি। নদীর আইনগত অভিভাবক হিসেবে হাইকোর্ট আমাদের মনোনীত করেছেন। জীবন্ত সত্তা হিসেবে নদীর অধিকার আছে। তাদের সেই অধিকার কী? তা হলো প্রবাহিত হওয়ার অধিকার, দূষণমুক্ত থাকার অধিকার, দখলমুক্ত থাকার অধিকার। নদীর জীববৈচিত্র্য থাকতে হবে; এটা তার অধিকার।

মনজুর আহমেদ আরও বলেন, নদীকে ঘিরে প্রাণপ্রকৃতি গড়ে উঠেছে। এটা তার অধিকার। এগুলো রক্ষা করতে হবে। যখনই আমরা দেখি নদীর ওপর অবিচার হচ্ছে, নদী দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে, দখলের শিকার হচ্ছে—আইনগত অভিভাবক হিসেবে তখনই আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি। আদালত সেই ক্ষমতা আমাদের দিয়েছে।

তিনি জানান, যেমন নদীর পানি দূষণের দায়ে পটুয়াখালীর মেয়রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বললাম পরিবেশ আদালতকে। তার তো ছয় মাসের কারাদণ্ড হয়ে যেতো। ক্ষমা চেয়ে রক্ষা পেয়েছেন তিনি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম ও ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানকে মোবাইল কোর্টের সম্মুখীন করব আমরা। চাইব যেন তাদের ছয় মাসের জেল, চার লাখ টাকা জরিমানা হয়। মেয়র আতিককে যখন বলা হলো, খালের মাথায় বর্জ্য শোধনাগার বসান, তিনি তো আমাদের কথায় পাত্তাই দিচ্ছেন না।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রধান বলেন, খালের দূষিত পানি যাতে নদীতে গিয়ে না পড়ে সে জন্য দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র খালের মুখে বর্জ্য শোধনাগার করার পরিকল্পনা নিয়েছেন। এ জন্য তাকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। এ শহরের মানবসৃষ্ট সব বর্জ্য গিয়ে নদীতে পড়ছে। আমরা যদি এখনই পরিকল্পনা না করি, তবে পানি তো আরও দূষিত হয়ে যাবে।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন