আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
সম্প্রতি উপসাগরীয় অঞ্চলের লোকজন ওপরমুখ তাকালেই দেখছেন কমলা রঙের আকাশ। যেন আকাশ ভেঙে মহাপ্রলয় নেমে আসছে। একের পর এক বালু ও ধূলিঝড়ের দমকা এসে অঞ্চলটিকে পর্যুদস্ত করে তুলছে।
বাঁধ নির্মাণ, বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধ, পানি অব্যবস্থাপনা, অতি শুষ্কতা, মরুকরণসহ বিভিন্ন ধরনের ঘটনা মানুষের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে আবির্ভাব হচ্ছে। জলবায়ুসংক্রান্ত ঘটনায় ১৬ মে কুয়েতের তিনটি বন্দরে—দোহা, শোয়াইবা ও শুয়াইখ—নৌ-অভিযান বাতিল করতে হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনে ভয়াবহ সংকট ও সংঘাত নেমে আসছে মধ্যপ্রাচ্যে। বালু ও ধূলিঝড় আঘাত হেনেছে রিয়াদসহ সৌদি আরবের বিভিন্ন অংশে। এতে গেল মাসেই দেশটির অন্তত ১ হাজার ২০০ বাসিন্দা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত জটিলতা দেখা দিয়েছিল।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভবন বুর্জ খলিফাকেও ছাড়েনি ধূলিঝড়। ধুলার আস্তরণে ভবনটি মানুষের দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। একই কারণে ইরানের রাজধানী তেহরানের স্কুল ও সরকারি অফিস বন্ধ রাখতে হয়েছে। বাতিল কিংবা বিলম্ব করতে হয়েছে কয়েক ডজন ফ্লাইট।
ধূলিঝড় সবচেয়ে বেশি আঘাত হেনেছে ইরানের খুজিস্তানে। সেখানের অন্তত ৮০০ মানুষ শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যায় পড়েন। চিকিৎসার জন্য তাদের হাসপাতালে যেতে হয়েছে।
বালু ও ধূলিঝড়ের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ ইরাক। গ্রীষ্ম ও বসন্তেই সাধারণত বালুঝড়ের আঘাত আসে। এর সঙ্গে যোগ হয় মৌসুমি বায়ু। মার্চ থেকে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই সেখানে এ ঝড় আঘাত হানছে। যার প্রভাব পড়েছে জনজীবনে। হাসপাতালে ভর্তি হন হাজার হাজার ইরাকি।
সরকারি কর্মকর্তা ও সাধারণ নাগরিকদের বাড়িতে থাকতে বলা হয়েছে। ঘোষণা করা হয়েছে সরকারি ছুটি। আর হাসপাতালগুলোয় অক্সিজেন ক্যানিস্টারের মজুত বাড়িয়েছে ইরাকি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের সবশেষ উপসর্গ হিসেবে উপসাগরীয় দেশগুলো এসব বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে। পরিস্থিতি আরও অস্বাভাবিক হতে এতে ভূমিকা রাখছে যুদ্ধবিগ্রহসহ বিভিন্ন অনুষঙ্গ।
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ইরানিয়ান স্টাডিজের গবেষক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ বানাফেসহাহ কেইনুশ বলেন, বালু ও ধূলিঝড়ে লেক-জলাভূমির কাছে পলি জমে আটকে যাচ্ছে। কখনো-কখনো উপসাগরীয় জলাশয়ের বিশাল অংশ ঢেকে যায় এতে।
তিনি বলেন, যখন সবকিছু ধুলোয় ঢেকে যায়, তখন নবায়নযোগ্য সৌর প্যানেলেও ত্রুটি দেখা দেয়। এ বিষয় আমলে নিয়ে বলা যায়, বালু ও ধূলিঝড়ের এক দুষ্টচক্রে পড়েছে মধ্যপ্রাচ্য। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝড় হচ্ছে। অর্থাৎ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে আরও তীব্র করে তুলছে ক্রমাগত ঝড়। আবহাওয়ার ধরনের সঙ্গে সম্পর্কিত সামাজিক-অর্থনৈতিক জীবনে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রভাব পড়ছে। এতে মানুঝের জীবন ও জীবিকা মারাত্মক হুমকিতে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে, মধ্যপ্রাচ্যে বালু ও ধূলিঝড়ে বছরে ১ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের সম্পদ ক্ষতি হচ্ছে। এসব ঝড়ে আন্তঃ আঞ্চলিক সংকট তৈরি করছে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্ব বিবেচনায় নিলে অন্য দেশগুলোকেও সেই খেসারত দিতে হচ্ছে। কারণ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এ অঞ্চলের কৌশলগত জলপথ গুরুত্বপূর্ণ। এখান দিয়েই বিশ্বের অধিকাংশ জ্বালানি পরিবহন করা হচ্ছে।
সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর জন্য সুযোগ
এসব ঝড়ের সুযোগ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে বাড়ছে সহিংসতা। ধুলা ও বালুর কারণে মানুষের দৃষ্টির পাল্লা কমে যায়। অর্থাৎ, দূরের দৃশ্যাবলি চোখে পড়ে কম। সেই সুযোগ নিয়ে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস বেশ কয়েকটি হামলা চালিয়েছে ইরাকে।
গেল মে মাসে কিরকুক ও দিয়ালা প্রদেশে প্রাণঘাতী হামলা চালিয়েছে তারা। এপ্রিলেও ভয়াবহ দুর্যোগের সুযোগ নিয়ে আনবার প্রদেশের হিত শহরে ইরাকি সামরিক বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায় আইএস। এতে দুই সেনা নিহত হয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই ধুলাবালির সঙ্গে পেরে উঠছে না ইরাকি নিরাপত্তা বাহিনী। এতে ব্যাপক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তাদের, যা ভবিষ্যতে আইসের হামলার সুযোগ তৈরি করে দেবে। আবহাওয়ার চরম মাত্রায় সামরিক বাহিনীর বেশ কিছু অভিযান স্থগিত রাখতে হচ্ছে। আর আইএসসহ অন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সেই সুযোগ নিয়ে সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক নাগরিকের ওপর হামলা বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে বিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলোতে সহিংসতা বেশি ঘটেছে।
সন্ত্রাসবাদের উদ্বেগ ছাড়াও বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলছেন, এই অস্বাভাবিক ঝড়ে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংঘাত বেড়ে যেতে পারে। আর তা হবে পানি নিয়ে। জলবায়ু সংকটে বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে। অনাবৃষ্টিতে নদীর পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এতে দেশগুলোর মধ্যে উত্তেজনা তীব্রতর হচ্ছে।
টাইগ্রিস ও ফোরাত নদীতে বাঁধ দিচ্ছে তুরস্ক। এতে মরুকরণের দিকে যাচ্ছে ইরাক। ২০২১ সাল থেকে ইরাকের পানি সম্পদ ৫০ শতাংশ কমেছে। উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে ইরাকে পানির উল্টো প্রবাহেও নতুন সংকট দেখা দিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তালহা আবদুল রাজ্জাক বলেন, মিঠাপানির এলাকায় ঢুকে যাচ্ছে সাগরের নোনা পানি। ফলে চাষ্যযোগ্য জমি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। উর্বরতা হারাচ্ছে মাটি, বাড়ছে লবণাক্ততা। আর তাতে বিশাল ভূখণ্ড মরুভূমিতে রূপ নিচ্ছে।
শাত-ইল-আরবে প্রবহমান বাহামানসির নদী ঘিরে খাল খনন করছে ইরান। এতে শাত-ইল-আরবের স্রোতের নিম্নরেখার মধ্যবিন্দুতে পরিবর্তন আসছে। আলজিয়ার্স চুক্তি অনুসারে, শাত-ইল-আরব বরাবর ইরান ও ইরাকের মধ্যে সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইরানের জিম্মি সংকটের অবসানে ১৯৮১ সালের ১৯ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে চুক্তিটি হয়েছিল। চুক্তির মধ্যস্থতা করেছিল আলজেরীয় সরকার।
আবদুল রাজাক বলেন, মূলত দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে জলরেখা মাঝখান দিয়ে দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। কিন্তু কৃত্রিমভাবে সেই সীমানায় পরিবর্তন আনা হলে সংঘাত অনিবার্য। তিনি বলেন, শাত-ইল-আরবে প্রবেশ ও ইরাকের পানি সরবরাহে দূষণ নিয়েও সংঘাত তৈরি হতে পারে।
মরুকরণ
তুরস্ক বাঁধ নির্মাণ করায় আঙ্কারার সঙ্গে তেহরানের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাচ্ছে। দুদেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। ইরানের শুষ্কতার জন্য নদীর উজানে তুরস্কের বাঁধ নির্মাণকে দায়ী করা হচ্ছে।
১২ মে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, এই অভিযোগের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনো সম্পর্ক নেই। সংকট নিরসনে তেহরান বাস্তবিক কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে আঙ্কারার ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে।
ইরাকিদের জন্য ক্রমাগত আতঙ্ক হয়ে দেখা দিচ্ছে বালু ও ধূলিঝড়। একদিকে মরুকরণের প্রভাবে সবাই যখন অতিষ্ঠ, তখন বৈশ্বিক উষ্ণায়নে বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে। এতে পরিবেশের ওপর বিপর্যয়কর প্রভাব পড়ছে বলে দাবি করছেন বিশ্লেষকরা।
পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের বড় কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে পরিবেশ বিপর্যয়। বাগদাদের আল-কাদেসিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-প্রত্নতত্ত্ববিদ জাফার জোথেরি বলেন, পুরো অঞ্চলটিতে সমস্যা প্রকট আকার নিয়েছে। কিন্তু প্রতিটি দেশের ঝুঁকি ও দুর্বলতা আলাদা।
তিনি বলেন, বৃষ্টিপাত কম থাকায় ইরাক মরুকরণের দিকে যাচ্ছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ঝড়ের প্রবণতা। নিম্নভূমির দেশ হিসেবে অনেক মরু অঞ্চল থাকলেও তার প্রভাব দ্বিগুণ রূপ নিয়েছে। কারণ, ১৭ বছর ধরে পানি ও নগরায়নের অব্যবস্থাপনায় ভূখণ্ডের দুই-তৃতীয়াংশ সবুজ আবরণ হারিয়েছে।