আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক ব্যক্তি নিজ শরীরে কোবরা, মাম্বা, রেটলস্ন্যাকসহ ১৬ প্রজাতির প্রাণঘাতী সাপের বিষ প্রয়োগ করে এক ব্যতিক্রমী রোগ প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তুলেছেন। ফলে ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্তৃত ও কার্যকর অ্যান্টিভেনম তৈরি করতে পেরেছে বিজ্ঞানীরা। এটি ভবিষ্যতে সাপের কামড়ের চিকিৎসায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। খবর বিবিসির।
জানা যায়, ওই ব্যক্তির নাম টিম ফ্রিড। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিনের সাবেক ট্রাক মেকানিক। এদিকে, বিজ্ঞানীরা প্রাণীর ওপর পরীক্ষা করে দেখেছেন, টিমের রক্তে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি প্রাণঘাতী মাত্রায় প্রয়োগ করা বিভিন্ন প্রজাতির বিষ প্রতিরোধ করতে পারে।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বায়োটেক প্রতিষ্ঠান সেন্টিভ্যাক্সের প্রধান নির্বাহী এবং গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক জ্যাকব গ্ল্যানভিল বলেন, ‘অন্তত ১৮ বছর ধরে টিম নিজের শরীরে সাপের বিষ প্রয়োগ করে চলেছেন, যেগুলো সাধারণত একটি ঘোড়াকেও মেরে ফেলতে পারে। এটা এক কথায় বিস্ময়কর!’
সেই গবেষণা অনুযায়ী, ফ্রিডের রক্ত থেকে সংগৃহীত দুটি সুরক্ষা অ্যান্টিবডি এবং একটি ক্ষুদ্র আণবিক বিষ প্রতিরোধক একত্র করে অ্যান্টিভেনম ককটেল তৈরি করা হয়েছে। এটি ১৯টি মারাত্মক প্রজাতির মধ্যে ১৩টির ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সুরক্ষা এবং বাকিগুলোর ক্ষেত্রে আংশিক সুরক্ষা দিতে সক্ষম। বর্তমানে প্রচলিত অ্যান্টিভেনম সাধারণত নির্দিষ্ট একটি প্রজাতির বিষের বিরুদ্ধে কার্যকর হয়ে থাকে। আর সাধারণত ঘোড়া বা ভেড়াকে বিষ দিয়ে এই অ্যান্টিবডি তৈরি করা হয়। ফলে গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ারও আশঙ্কা থেকে যায়।
বর্তমান চিকিৎসা পদ্ধতিতে যে নির্দিষ্ট প্রজাতির বিষাক্ত সাপ কামড়ায় তাতে অ্যান্টিভেনমের সঙ্গে মিল থাকতে হয় সেটির।
তবে ১৮ বছর ধরে ফ্রিড যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তা সব ধরনের সাপের কামড়ের প্রতিষেধক হিসেবে একটি সর্বজনীন অ্যান্টিভেনম খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হতে পারে।
বিশ্বে প্রতিবছর ১৪ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয় সাপের কামড়ে। এর তিন গুণ মানুষ সাপের কামড় খেয়ে অঙ্গচ্ছেদ করতে বাধ্য হন বা স্থায়ীভাবে অক্ষম হয়ে পড়েন।
তবে ফ্রিড এই সময়ে মোট ২০০ বারেরও বেশি কামড় খেয়েছেন এবং ইনজেকশনের মাধ্যমে ৭০০ বারের বেশি শরীরে বিষ ঢুকিয়েছেন। শরীরে যেসব বিষ প্রয়োগ করেছেন তিনি তার মধ্যে কেউটে, মাম্বাসহ বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী কয়েকটি সাপের বিষ উপস্থিত ছিল।
২০০০ সালে ফ্রিড যখন তার সাপ সংগ্রহের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন হন, তখন থেকে নিজেই নিজেকে প্রতিষেধক হিসেবে বিষ প্রয়োগ করতে শুরু করেন তিনি। ২০০১ সালে একটি মিসরীয় কোবরা কামড়ানোর পর তিনি চার দিন কোমায় ছিলেন, তবু থেমে যাননি। ফ্রিড বলেন, পরপর দুটি কেউটের কামড় খাওয়ার ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে কোমায় চলে গিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেন, ‘আমি মরে যেতে চাইনি। আমি আমার একটি আঙুল খোয়াতে চাইনি। আমি আমার কাজ হারাতে চাইনি।’পরে তিনি তাঁর হাতের ওপর সাপের ছোবল নিতেও রাজি হন।
ফ্রিডের লক্ষ্য ছিল বিশ্বের জন্য (সাপের কামড়ের) আরও ভালো চিকিৎসা পদ্ধতির উন্নয়ন করা। কোথা থেকে এ কাজের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন তার ব্যাখ্যা তিনি আরও বলেন, ‘এটা আমার রোজকার অভ্যাস হয়ে ওঠে এবং আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করতে থাকি, চেষ্টা করতে থাকি—ওই সব মানুষের জন্য যারা আমার থেকে আট হাজার মাইল দূরে থাকে, যারা সাপের কামড়ে মারা যায়।’
এই কর্মকাণ্ডের খবর একটি ইউটিউব ভিডিওর মাধ্যমে গ্ল্যানভিলের নজরে এসেছিল। তখনই তিনি ফ্রিডের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। গবেষকের ভাষায়, ‘ফোন ধরেই ফ্রিড বললেন—অবশেষে! আমি এই ফোনকলের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।’
এই গবেষণা মূলত অ্যালাপিড শ্রেণির বিষধর সাপকে কেন্দ্র করে হলেও ভবিষ্যতে ভাইপার শ্রেণির বিরুদ্ধেও অনুরূপ প্রতিষেধক তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। প্রথম ধাপে এই অ্যান্টিভেনম অস্ট্রেলিয়ায় সাপের কামড় খাওয়া কুকুরদের ওপর প্রয়োগ করে কার্যকারিতা যাচাই করা হবে, এরপর শুরু হবে মানবদেহে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল।
লিভারপুল স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের স্নেকবাইট গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক নিকোলাস কেইসওয়েল বলেছেন, ‘এই গবেষণা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। কমসংখ্যক অ্যান্টিবডি একত্র করে এমন বিস্তৃত সুরক্ষা পাওয়া যাবে—এই ধারণা ভবিষ্যতের চিকিৎসায় বিপ্লব আনতে পারে।’