হোম অন্যান্যসারাদেশ “দেখেন ডিআইজি স্যার ফোন দিছে”

“দেখেন ডিআইজি স্যার ফোন দিছে”

কর্তৃক
০ মন্তব্য 101 ভিউজ

বিশেষ প্রতিনিধি 

“দেখেন ডিআইজি স্যার ফোন দিছে। কেউ কথা বলেন না। আমি স্যারের সাথে কথা বলছি।” এভাবেই সাধারণ মানুষের মধ্যে গিয়ে ডিআইজি’র নিকট আত্মীয় পরিচয় দিয়ে দাঁপিয়ে বেড়ানো প্রতারক জিন্নাত আলী শেখ হাতিয়ে নিয়েছে লক্ষ লক্ষ টাকা। নিজেই তৈরি করেছেন কোটি টাকা মূল্যে বাড়ি।

ডুমুরিয়ার আরশনগর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মোহাম্মদ চুন্নু শেখ জানান, জিন্নাতের বাড়ীর ছাদ ঢালাইয়ের দিন ডুমুরিয়ার ওসি আসার খবরে আমি সেখানে যায়। কিন্ত সেখানে গিয়ে দেখি, তালা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মেহেদী রাসেল স্যার ও উপ-পরিদর্শক আনোয়ার হোসেন জিন্নাতের বাড়ীর কাজের তদারকি করছেন। প্রায় তিন ঘন্টার মত সময় তারা সেখানে ছিলেন।
সাতক্ষীরার তালা, পাটকেলঘাটা, খুলনার ডুমুরিয়া, বটিয়াঘাটা, দাকোপ ও যশোর জেলার কেশবপুর, মনিরামপুরসহ কয়েকটি থানা এলাকায় তথাকথিত পরিচয়ে দাঁপিয়ে বেড়াতো জিন্নাত আলী শেখ । জিন্নাতের বিরুদ্ধে একের পর এক ঘের দখল, জমি দখল, মামলা থেকে অব্যহতি দেওয়ার নামে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া জিন্নাতের এসব অপকর্মের সহযোগিতা করার অভিযোগ উঠেছে তালা থানার (ওসি) মো. মেহেদী রাসেল ও উপ-পরিদর্শক আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে। ইতিমধ্যে ওই অভিযোগে তালা থানার উপ-পরিদর্শক মো. আনোয়ার হোসেনকে সাতক্ষীরা পুলিশ লাইনে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

জিন্নাত আলী শেখ ডুমুরিয়া উপজেলার হুগলাডাঙ্গা গ্রামের সাহেব আলী শেখের ছেলে। জিন্নাত দীর্ঘদিন ধরে উর্দ্ধত্বন পুলিশ কর্মকর্তার (ডিআইজির) ভাগ্নে পরিচয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদাবাজী করে আসছিল। অভিযোগ উঠেছে, জিন্নাতের সকল চাঁদাবজীতে প্রত্যক্ষ সহযোগীতা করেছেন তালা খানার উপ-পরিদর্শক আনোয়ার হোসেন।
সম্প্রতি খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলা মাগুরাগোনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হোসেনের দায়ের করা প্রতারনা মামলায় জিন্নাত শেখ (৩৫) কে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠানো হয়। এরপরই বেরিয়ে আসে জিন্নাত আলী শেখের প্রতারণার নানান অজানা কাহীনি। তবে প্রতারক জিন্নাত গ্রেফতার হওয়ায় স্থানীয় থানা ও পুলিশ ফাঁড়ির বেশ কয়েক কর্মকর্তার মাঝে প্রত্যাহার আতংক বিরাজ করছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তালা থানার দুই জন উপ-পরিদর্শক জানান, ওসি স্যার ও পুলিশ ক্যাম্পের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বোকা বানিয়ে ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খেয়েছে উপ-পরিদর্শক আনোয়ার হোসেন। তিনি সব সময় জিন্নাতের সাথে এলাকায় দাঁপিয়ে বেড়াতেন। কোথাও ঘের দখল, কোথাও জমি দখল,আবার কোথাও দোকান থেকে বাকীতে লক্ষ লক্ষ টাকার মালামাল নিতে নিজ থানা এলাকা পেরিয়ে জিন্নাতের সাথে অন্য থানা এলাকায় অবাধ দাপট দেখিয়ে বেড়িয়েছেন জিন্নাতের সহযোগী তালা থানার উপ-পরিদর্শক আনোয়ার হোসেন।

সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় ডুমুরিয়া উপজেলার মাগুরা ঘোনা ইউপি চেয়ারম্যান শেখ আবুল হোসেনের সাথে। তিনি জানান, উর্দ্ধত্বন পুলিশকর্তা ’র ভাগ্নে পরিচয় দিয়ে হঠাৎ কোটিপতি বনে গেছে জিন্নাত আলী শেখ। জিন্নাতের প্রতারনায় তালা থানার আনোয়ার দারোগা সহ ১৮ মাইলের কামরুল, জাতপুর বাজার বনিক সমিতির সভাপতি আমজাদ হোসেন টিক্কা, আরশনগরের ওজিয়ার রহমান চৌধুরী, তেঁতুলিয়া আড়ংপাড়ার বাবু মেম্বর জড়িত তার অপকর্মে জড়িত । তারা বিভিন্ন সময় ডিআইজি মামাকে মাছ ও টাকা দিতে হবে, ডিআইজি সাহেবের ওয়াইফ আসছেন ইত্যাদি বলে এলাকায় চাঁদাবাজী করেছে। আমার ছেলের দোকান থেকেও বাকীতে ৫/৬ লক্ষ টাকার রড,সিমেন্ট নিয়ে টাকা না দিয়ে ডিআইজি সাহেবের ফোন ধরিয়ে দেওয়ায় আমার সন্দেহ হয়। পরে আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারি সে একজন প্রতারক।

তালা উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান সরদার রফিকুল ইসলাম জনান, জিন্নাতের কথামত তালা থানার আনোয়ার দারোগা সহ ওসি আমার এলাকার চার-পাঁচ জন্য মৎস্য ঘের ব্যবসায়ীদের তাড়িয়ে টাকার বিনিময়ে প্রতিপক্ষের দখলে দিয়েছে।
তবে প্রতারক জিন্নাতের সহযোগী তেঁতুলিয়া ইউপি সদস্য বাবর আলী বলেন, ‘আমি কোন সহযোগী না ,আনোয়ার দারোগা এবং জিন্নাত ঘের দখল করে দেওয়ার জন্য আমার কাছ থেকে ডিআইজির কথা বলে টাকা নিয়েছে, তবে আমার কাজ করে দিয়েছে জিন্নাত।’

আঠারো মাইল এলাকার আওয়ামীলীগ নেতা কামরুল ইসলাম জানান, ০১৯১০-৭৭৭০৬৭ নম্বরের মোবাইল ফোন থেকে ডিআইজি পরিচয়ে আমার সাথে কথা হয়েছে। সে আমাকে শুধু জিন্নাতকে সহযোগীতা করার কথা বলেছে। এজন্য তাকে সহযোগীতা করেছি।

আঠারো মাইলের মাছ ব্যবসায়ী সামছুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, জিন্নাত বলতো,‘আমি চাইলে আপনার সম্পদ থাকবে, আর না চাইলে অন্যের হয়ে যাবে ! দাড়ান স্যার ফোন করেছে, কোন কথা বলবেন না।’
জাতপুর বজার বনিক সমিতির সভাপতি আমজাদ হোসেন টিক্কা নিজের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে জানান, ০১৭২০-৬৬৬২৭৮ নং- মোবাইল থেকে আমাকে কল দিয়ে ডিআইজি পরিচয়ে জিন্নাতকে সহযোগীতা করার কথা বলেছে। এজন্য তাকে সহযোগীতা করেছি।

এছাড়া জিন্নাতের প্রতারনার স্বীকার আঠারো মাইলের ডাচবাংলা ব্যাংকের মাহবুব, শাহদাত হালদার, পানের দোকানদার প্রতিবন্ধি খালেক সরদার, আলাদীপুরের শাহিনুর রহমান সহ অনেকে জানান, ডিআইজির ভয় দেখিয়ে বিভিন্ন সময় লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে জিন্নাত ও তালা থানার এস আই আনোয়ার।

জিন্নাতের প্রতারনার স্বীকার শিরাশীনি গ্রামের ব্যবসায়ী সোহবার হোসেন জানান, তালা থানার এস আই আনোয়ার হোসেন সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে আমাকে ডিআইজির ভয় দেখিয়ে মৎস্য ঘের ছেড়ে দিতে বাধ্য করেছে।

তালা থানার উপ-পরিদর্শক আনোয়ার হোসেন জানান, জিন্নাতের দেওয়া একটি ভূয়া মোবাইল নাম্বার থেকে ডিআই জি পরিচয়ে আমার কাছে কল আসতো, নাম্বারটি এখন বন্ধ পাচ্ছি। তবে তার সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো।

তালা থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি ) মেহেদী রাসেল জানান, জিন্নাত আমাদের কে ভূল বুঝিয়েছে। ভূয়া নম্বর দিয়ে প্রতারণা করেছে। তবে তার বাড়ির ঢালাইয়ের দিন আপনি সেখানে গিয়েছিলেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমি ওই এলাকায় ঘুরতে গিয়ে ছিলাম। ওই বাড়ির নকশা ভালো লাগায় সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তবে তিন ঘন্টা সেখানে ছিলাম না।

ডুমুরিয়া থানা অফিসার ইনচার্জ আমিনুল ইসলাম বিপ্লব জানান, তার বিরুদ্ধে পুলিশ কর্তার নাম ভাঙ্গিয়ে প্রতারনার অভিযোগ রয়েছে। প্রতারণা মামলায় তাকে গ্রেফতার করে জেল-হাজতে পাঠানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, জিন্নাত তালা থানা পুলিশকে ব্যবহার করতে পারলেও আমাদের এখানে তেমন কিছু করার সুযোগ পায়নি।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন