হোম খুলনাবাগেরহাট দুবলার চরের স্বঘোষিত রাজা ও মূর্তিমান আতংক খোকন রাজাকারের আত্মগোপনের খবরে চরে জেলে-মহাজনদের মিষ্টি বিতরণ ও উল্লাস, দ্রুত বিচারের দাবীতে বিক্ষোভ

দুবলার চরের স্বঘোষিত রাজা ও মূর্তিমান আতংক খোকন রাজাকারের আত্মগোপনের খবরে চরে জেলে-মহাজনদের মিষ্টি বিতরণ ও উল্লাস, দ্রুত বিচারের দাবীতে বিক্ষোভ

কর্তৃক Editor
০ মন্তব্য 138 ভিউজ

মোংলা (বাগেরহাট) প্রতিনিধি :

খাঁন শফিউল্লাহ খোকন (৭৩) ওরফে রাজাকার খোকন।চারদশক ধরে তিনি হয়ে উঠেন সুন্দরবনের দুবলার চরের স্বঘোষিত রাজা। প্রভাব আর আধিপত্য বিস্তার করে দুর্গম চরে শাসন ও শোষণ করেছেন নিরিহ জেলেদের। অর্থ, বৃত্তে ফুলে ফেঁপে উঠেন লোক চক্ষুর আড়ালে। যে চরে এতোদিন দোদান্ড দাপটে রাম রাজত্ব করেছেন, সেই জেলে পল্লী হতে হঠাৎ আত্মগোপন করেছেন তিনি। খবর ছড়িয়েছে যুদ্ধাপরাধের দায়ে তদন্ত শুরু হলে পালিয়েছেন তিনি। এতে চরে মিষ্টি বিতরণ ও উল্লাসের পাশাপাশি দ্রুত বিচার সম্পন্নের দাবীতে বিক্ষোভও করেছেন জেলে-মহাজনেরা। দুবলার চরের স্বঘোষিত এ রাজা ও রাজাকার খোকন খুলনার রুপসা থানার দেয়ারা এলাকার মৃত শহিদুল্লাহ খাঁনের ছেলে।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছাত্র জীবনে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোনায়েম খাঁনের ন্যাশনাল ষ্টুডেন্ট ফ্রন্টের (এনএসএফ) সভাপতি ছিলেন খাঁন শফিউল্লাহ খোকন। এরপর ১৯৭১এর যুদ্ধের আগে ১৯৬৮/১৯৬৯সালে খুলনায় খাঁন এ সবুরের লাঁঠিয়াল বাহিনীর দলে যোগ দেন তিনি। যুদ্ধকালীন সময়ে খুলনায় খাঁন আমজাদ হোসেন রাজাকার বাহিনীর সভাপতি হওয়ার পর তার দলে যোগ দেন খোকন। পরে তাকে খুলনার রুপসা থানার দেয়ারা এলাকার রাজাকার বাহিনীর সভাপতি করেন খাঁন আমজাদ হোসেন। শুরু হয় তখন খোকন রাজাকারের নারকীয় অত্যাতার-নির্যাতন। খোকন রাজাকারের দলে ২৫/৩০জন সশস্ত্র সদস্য ছিলেন। ওই সময় এলাকার মুক্তিযোদ্ধা শামসুর রহমান ওরফে শ্যাম মল্লিককে গুলি করে হত্যা করেন তিনি ও তার সহযোগীরা। এছাড়া তাদের হাতে আরও দুইটি হত্যাকান্ডেরও ঘটনা ঘটে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর খোকন দলবল নিয়ে ভারতে পালিয়ে যান। সেখানে দুই বছর আত্মগোপনে থাকার পর দেশে ফিরে আবারও খুন, ঘের, দখল ও টেন্ডারবাজির মতো সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করে খুলনার বটিয়াঘাটা এলাকায় একক আধিপত্য বিস্তার করতে থাকেন।

যেভাবে দুবলার চরে স্বঘোষিত রাজা হয়ে উঠেন খোকন!

১৯৮৪সালে প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়া উদ্দিন আহমেদের সাথে বঙ্গোপসাগরের দুবলার চরে শেকড় গড়তে শুরু করেন দুর্ধর্ষ খুনি খোকন রাজাকার। সেখানে শুরু করেন কাঁচা ও শুঁটকি মাছের ব্যবসা। তাতেই হয়ে যান কয়েক’শ কোটি টাকার মালিক। তবে নিজের চরিত্র পরিবর্তন করতে পারেননি তিনি। টাকার প্রভাবে হয়ে উঠেন দোদান্ড প্রভাবশালী। দুবলার চরের নিরিহ জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীদের ভয় দেখাতে ২০০২সালে খুলনার শীর্ষ কুখ্যাত সন্ত্রাসী খুনী এরশাদ শিকারদার ও ক্রসফায়ারে নিহত আরেক সন্ত্রাসী খুনী লিটুকে ভাড়া করে নিয়ে যান সেখানে। তখন দুবলার মৎস্য মৌসুমে জেলেদের উপর হামলা চালিয়ে মেহেরআলীর চরে মাছের ব্যবসা দখলে নেয় খোকন। পরবর্তীতে দখলে নেয় আরেক চর আলোরকোল। সেখানে জেলেদের উপর অমানসিক নির্যাতন চালিয়ে ‘যখন যা খুশি’র মতো ভয়ংকর রীতি রেওয়াজ চালু করেন খোকন। এতে মুহুর্তেই জেলেদের কাছে হয়ে উঠেন মূর্তিমান আতংক। এভাবে চারদশক ধরে সুন্দরবন সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের দুবলার চরে অঘোষিত মুকুটহীন সম্রাট হয়ে উঠেন তিনি।

এরপর ২০১৭সালে মুক্তিযোদ্ধা সাব-সেক্টর কমান্ডার ও দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের চেয়ারম্যান মেজর জিয়া উদ্দিন আহমেদের মৃত্যুর পর পুরো ফিশারম্যান গ্রুপসহ দুর্গম দুবলার চরাঞ্চল দখলে নেয় খোকন। এতোদিনের দোদান্ড দাপটে চরাঞ্চালের সেই স্বঘোষিত শাসক হঠাৎ করে সপ্তাহ খানেক ধরে দুবলার চর থেকে আত্নগোপনে চলে যান।

দুবলার জেলে ও ফিশারম্যান গ্রুপের দেয়া তথ্য মতে, যুদ্ধাপরাধ বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মুক্তিযোদ্ধা শামসুর রহমান ওরফে শ্যাম মল্লিককে হত্যার দায়ে খাঁন শফিউল্লাহ খোকন (৭৩) ওরফে রাজাকার খোকনসহ ৩জনকে আসামী করে ২০২২সালে মামলা করেন ছেলে সাইফুল মল্লিক গামা। ওই মামলায় এ বছরের গত ২৫জানুয়ারী যুদ্ধাপরাধ বিশেষ ট্রাইব্যুনালের তদন্তকারী কর্মকর্তারা সরেজমিনে স্বাক্ষী গ্রহণ করেন।

মামলার বাদী সাইফুল মল্লিক গামা বলেন, মামলা দায়ের হওয়ার আগে ও পরে বিভিন্ন সময় শফিউল্লাহ খোকন এবং তার স্বজনরা তাকে হত্যাসহ মামলায় ফাঁসানোর নানা হুমকি দিচ্ছেন।

এ মামলার অন্যতম স্বাক্ষী আলহাজ্ব মুনসুর আলী পোদ্দার বলেন, খাঁন শফিউল্লাহ খোকন একজন রাজাকার কমান্ডার ছিলেন। তার নেতৃত্বে ১৯৭১সালে রাজাকাররা খুলনার রুপসা থানার শোলপুর ও দেয়ারা এলাকায় নারী ধর্ষণ, লুট ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ছিলেন। ১৯৭১সালে রাজাকার কমান্ডার খাঁন শফিউল্লাহ খোকন রুপসার যুগীহাটি গ্রামের শামসুর রহমান শামা মল্লিকসহ আরও কয়েকজনকে ধরে নিয়ে হত্যা করেন। এ ঘটনায় শামা মল্লিকের পুত্র সাইফুল মল্লিক গামা যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন।

তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ক্ষমতাসীনদের উত্থান-পতন হলেও এখনও বেশ দাপটে ধরে রেখেছেন নিজের কতৃত্ব।। আর চারদশক ধরে লোক চক্ষুর আড়ালে দুবলার চরে শুঁটকি মাছের ব্যবসায় প্রভাব বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন। তার নির্যাতনে অনেক ব্যবসায়ী ও সাধারণ জেলে দুবলার চর ছেড়ে চলে গেছেন।

দুবলার চরে খোকন বাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার তুষখালী গ্রামের মামুন শরিফ ও মফিজুল শরিফ বলেন, খোকন বাহিনীর বেপরোয়া অত্যচার ও নির্যাতনে বিগত কয়েক দশকে সুন্দরবন এবং সাগরে সামুদ্রিক মাছের ব্যবসায় নিঃস্ব হয়েছেন অসংখ্য পেশাজীবি। আবার অনেকে পুরোনো পেশা ছাড়াতে বাধ্য হয়েছেন।

এছাড়া দুবলার জেলে ও শুটকী ব্যবসায়ী গাজী রহমান, কেরামত মল্লিক ও বোরহান গাজী বলেন, যুদ্ধাপরাধের তদন্তের খবর পেয়ে খাঁন শফিউল্লাহ খোকন ওরফে খোকন রাজাকার দুবলার চর ছেড়ে গত সপ্তাহখানেক ধরে আত্মগোপনে রয়েছেন। আর এতে স্বত্বি ফিরেছে দুবলার জেলে পল্লীতে। আনন্দে মিষ্টি বিতরনসহ খোকনের নানা অপকর্মের বিচার দাবীতে মঙ্গলবার (৬ফেব্রুয়ারী) দুপুরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন চরের জেলেরা।

এ বিষয়ে দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিগত কয়েকদিন ধরে বহুল আলোচিত দুবলার চরের মৎস্য ব্যবসায়ী খাঁন শফিউল্লাহ খোকন আত্নগোপনে রয়েছেন। এতে জেলে ও ব্যবসায়ীরা দুবলার চরাঞ্চলে মিষ্টি বিতরণ ও উল্লাস করেছেন বলে এমনও খবর শুনেছেন তিনি।

আত্মগোপনে থাকা খাঁন শফিউল্লাহ খোকন ওরফে রাজাকার খোকনের বক্তব্য জানতে তার ব্যবহৃত ০১৭১১-১৩০০৪৪ ও ০১৫১১-১৩০০৪৪ এই দুইটি নম্বরে যোগাযোগ করা হলে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এছাড়া এই দুই নম্বরে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন