অনলাইন ডেস্ক:
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের চতুর্থ কিস্তি বিলম্বিত হলেও পঞ্চম কিস্তির সঙ্গে একসঙ্গে তা আগামী জুন মাসে ছাড় হতে পারে। সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সব শর্ত একসঙ্গে পূরণ করতে পারবে না বলে আইএমএফকে জানানো হয়েছে। দুই পক্ষের আলোচনার ভিত্তিতে দুই কিস্তি একসঙ্গে ছাড়ের সিদ্ধান্ত হতে পারে।’
বাজেট সহায়তার জন্য আইএমএফ ঋণ লাগবে। এ কারণেই বাংলাদেশ সরকার ও আইএমএফ যৌথভাবে নির্ধারিত দুটি কিস্তি একসঙ্গে ছাড়ের বিষয়ে সম্মত হয়েছে বলেও জানান অর্থ উপদেষ্টা।
এদিকে ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে বিভিন্ন শর্ত পালনের অগ্রগতি পর্যালোচনায় আইএমএফের একটি দল আগামী ৫ এপ্রিল ঢাকায় আসছে। দলটি ৬ এপ্রিল থেকে সরকারের বিভিন্ন দফতরের সঙ্গে বৈঠক করবে। দলটির সঙ্গে অর্থ বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বিদ্যুৎ বিভাগ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি), জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। ১৭ এপ্রিল বৈঠকের মাধ্যমে আইএমএফের শর্তপূরণের অগ্রগতি পর্যালোচনা হবে।
কিস্তি পেতে কী কী শর্ত পূরণ করতে হবে
চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ পেতে বাংলাদেশকে অন্তত তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা, জিডিপির ০ দশমিক ৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নীতি ও প্রশাসনকে পৃথক করা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জিডিপির ০ দশমিক ৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করতে হলে অন্তত ৫৭ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করতে হবে। এটি করতে ভর্তুকি কমানোর পাশাপাশি বিদ্যুতেরও দাম বাড়াতে হবে। এর বাইরে মুদ্রা বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। এই শর্তগুলো পূরণ না হলে, বাংলাদেশ নতুন আর্থিক সংকটে পড়তে পারে। যা শুধু আইএমএফ নয়, অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছ থেকেও ঋণ প্রাপ্তিতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
আর যদি আইএমএফের ঋণের আশায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়, সেক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের কাছাকাছি চলে আসা মূল্যস্ফীতি আবার বাড়াতে পারে। এছাড়া মুদ্রা বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থা হতে পারে।
জুনের আগে বিনিময় হার বাজারভিত্তিক হচ্ছে না বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার জন্য সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ থাকলেও, আগামী জুনের মধ্যে এটি কার্যকর হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
গত ২৫ মার্চ অর্থ বিভাগের সভাকক্ষে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) কার্যনির্বাহী কমিটি ও অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত প্রতিবেদকদের সঙ্গে বাজেট প্রণয়নের নীতিগত বিষয়গুলো নিয়ে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা জানান।
তিনি বলেন, ‘বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, তবে বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় তাৎক্ষণিকভাবে এটি করা সম্ভব নয়। মূল্যস্ফীতি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখেই সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।’ এখনই বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থা হতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেন সালেহউদ্দিন আহমেদ। বর্তমানে ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে ডলারের বিনিময় হার ১২২ টাকায় স্থিতিশীল রাখা হয়েছে।
অপরদিকে, জিডিপির ০.৫ শতাংশ হারে বাড়তি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে সরকার ভ্যাট বৃদ্ধি করেছে। বিশেষ করে ৪৩টি পণ্য ও সেবার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট কার্যকর করা হয়েছে। তবে এখনও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব হয়নি। ব্যবসায়ীরা করজাল সম্প্রসারণের বদলে ভ্যাট বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শর্তগুলো পূরণ না হলে আইএমএফের ঋণের পরবর্তী কিস্তি পেতে বাংলাদেশকে জটিলতার মুখে পড়তে হতে পারে।সরকার এখনও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, লক্ষ্যমাত্রা পূরণে অন্তত ৫৭ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত আদায় করতে হবে, কিন্তু সে অনুযায়ী উদ্যোগ কম। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মানতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নীতি ও প্রশাসন বিভাগ পৃথক করা হতে পারে এবং কর অব্যাহতি সুবিধা কমানোর পরিকল্পনাও রয়েছে। তবে ব্যবসায়ীরা কর অব্যাহতি কমানোর বিরুদ্ধে একাট্টা, যা সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে।
আইএমএফের শর্তের অংশ হিসেবে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও এখনও স্বস্তির জায়গায় পৌঁছায়নি। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে তা আবার মূল্যস্ফীতি বাড়াতে পারে। তাই সরকারকে হিসাব-নিকাশ করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং আইএমএফেরও বাংলাদেশের বাস্তবতা বোঝা উচিত। উভয় পক্ষের সমঝোতার মাধ্যমে ঋণ কর্মসূচি বজায় রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বর্তমান কর-জিডিপি অনুপাত প্রায় ৭ দশমিক ৬ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। এমন প্রেক্ষাপটে আইএমএফ ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি পাওয়ার শর্ত হিসেবে জিডিপির ০ দশমিক ৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। কিন্তু এই লক্ষ্য অর্জন কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সংশয় রয়েছে।
কঠিন বাস্তবতা: রাজস্ব সংগ্রহের চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রতিবছর লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম রাজস্ব আদায় করে। করজালের সংকীর্ণতা, কর ফাঁকি, কর অব্যাহতির ব্যাপকতা এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে। এ অবস্থায় অতিরিক্ত ০ দশমিক ৫ শতাংশ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণ কঠিন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
আইএমএফের শর্ত মানা সম্ভব?
অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, রাজস্ব নীতি থেকে রাজস্ব প্রশাসনকে আলাদা করার কাজ কিছুটা এগোলেও, বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার ও অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই।
এনবিআর দুই ভাগ হচ্ছে
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) দুই ভাগে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে সরকার। অচিরেই ‘রাজস্ব নীতি’ এবং ‘রাজস্ব প্রশাসন’ নামে দুটি পৃথক বিভাগ চালু করতে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হবে। জুলাই থেকে নতুন কাঠামো কার্যকর হবে বলে জানিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান। তবে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, এনবিআরের এই কাঠামোগত পরিবর্তনের ফলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি পাওয়া সহজ হবে কি না।
এনবিআরের কাঠামো পরিবর্তন কি কাজে আসবে?
সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, এনবিআরকে দুই ভাগে ভাগ করলে রাজস্ব আদায় ব্যবস্থা আরও কার্যকর হবে। এতে কর ফাঁকি কমবে এবং রাজস্ব আদায় বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, “রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় যারা অভিজ্ঞ, তারাই মূলত এই কাজগুলো করবেন। এতে শুল্ক ক্যাডার ও কর ক্যাডারের কর্মকর্তারা নতুনভাবে সংগঠিত হয়ে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে পারবেন।”
এনবিআরের সংস্কার কার্যক্রমকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা, তবে তারা বলছেন, একে সফল করতে আরও কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন।
রাজস্ব বাড়ানোর সম্ভাব্য উপায় ও সীমাবদ্ধতা
১. করজাল সম্প্রসারণ: এনবিআর করজাল বাড়ানোর পরিকল্পনা করলেও বাস্তবে নতুন করদাতার সংখ্যা খুব বেশি বাড়ছে না।
২. ভ্যাট ও কর আদায় বাড়ানো: মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও আয়কর আদায় বাড়ানোর মাধ্যমে রাজস্ব বাড়ানোর চেষ্টা চলছে, কিন্তু ব্যবসায়ীদের প্রতিরোধ এবং আইন বাস্তবায়নের জটিলতা এটি কঠিন করে তুলছে।
৩. শুল্ক ও আমদানি শুল্ক: আমদানি নির্ভর অর্থনীতির কারণে শুল্ক বাড়ালে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে, যা সরকারের জন্য চাপ সৃষ্টি করবে।