অনলাইন ডেস্ক:
গরু, ছাগল, মহিষ কিংবা ভেড়া; এসব পশুর চামড়ার ফেলে দেওয়া অংশ দিয়ে তৈরি হচ্ছে এক প্রকার আঠা। যা শিরিষ আঠা নামেও পরিচিত। রাজধানীতে গড়ে উঠেছে এই আঠা তৈরির ছোট ছোট বেশ কিছু কারখানা। এসব কারখানায় তৈরি হওয়া আঠা ব্যবহার হচ্ছে বই বাঁধাই থেকে শুরু করে সুতা ও জুতা তৈরির কারখানাসহ ওষুধ তৈরির কাজেও। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান। রাজধানীর কয়েকটি এলাকা ঘুরে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
জানা গেছে, চামড়া শিল্প বাংলাদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ, যা অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। চামড়া শিল্প বাংলাদেশে বহুতল গ্রাম্য এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে একটি প্রচলিত উদ্যোগ হিসেবে পরিচিত। এটি প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে কারখানাগুলোতে চামড়া ও চামড়া জাতীয় পণ্য তৈরি করে। চামড়া শিল্পের মাধ্যমে একটি আগ্রহী ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়, যা নগদ আয়ের পথ তৈরি এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চামড়া উৎপাদন প্রক্রিয়ায় শ্রমিক শ্রেণি একটি নিরাপদ কার্যক্রম পালন করে। চামড়া শিল্পের মাধ্যমে নির্মিত পণ্যগুলো অভ্যন্তরীণ খাতে ব্যবহৃত হয়, আবার বিদেশে রফতানি হয়ে থাকে, যা দেশের মুদ্রাকে প্রবাহিত করে এবং বাণিজ্যিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। চামড়া দিয়ে উৎপাদিত গুরুত্বপূর্ণ পণ্য- জুতা, ব্যাগ, কোমরের বেল্ট, জ্যাকেটের পাশাপাশি এখন চামড়ার খণ্ডিত অংশ আগুনে সিদ্ধ করে গলিয়ে তৈরি হচ্ছে শিরিষ আঠা।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রাজধানীর হাজারীবাগের বেড়িবাঁধ এলাকার রাস্তার দুই ধারে ছোট ছোট ট্রেতে করে শুকানো হচ্ছে কিছু জিনিস। দূর থেকে দেখে হয়তো মনে হবে আমের আচার বা আমসত্ত্ব শুকানো হচ্ছে। আসলে তা নয়। এটি গরু-ছাগলের চামড়া থেকে আঠা তৈরির একটি প্রাথমিক প্রক্রিয়া। যার নাম শিরিষ আঠা। বর্তমানে গরু-ছাগলের ফেলে দেওয়া চামড়া থেকে তৈরি হচ্ছে এই আঠা। সেই আঠার চাহিদা রয়েছে ওষুধ খাদ্যসহ বিভিন্ন শিল্পে।
রাজধানীর হাজারীবাগের পাশাপাশি বাংলাদেশের অনেক জায়গায় বিশেষ করে সাভারের চামড়া শিল্প নগরীর আশপাশের এলাকায় গড়ে উঠেছে চামড়া থেকে আঠা তৈরির কারখানা। যা থেকে দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশেও রফতানি করা হচ্ছে। বর্তমানে একেকটি কারখানায় মাসে কোটি টাকার পর্যন্ত এই আঠা বিক্রি হয়ে থাকে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গরু ও ছাগলের চামড়া দিয়ে আঠা তৈরির ইতিহাস বহু পুরোনো। একসময় কাঠের আসবাবপত্র সংযুক্ত করা থেকে শুরু করে বই বাঁধাই পর্যন্ত নানান কাজে এই প্রাকৃতিক আঠার ব্যবহার ছিল অপরিহার্য। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি শিল্প কারখানার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠেছে। যা আগে বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। বর্তমানে দেশে চালু করা হয়েছে বেশ কিছু আঠা তৈরির কারখানা।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, গরু-ছাগলের চামড়া থেকে আঠা তৈরি করতে বেশ দীর্ঘ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। শুরুটা হয় চামড়া সংগ্রহের মাধ্যমে। সাধারণত কসাইখানা বা ট্যানারি থেকে এসব কাঁচামাল সংগ্রহ করা হয়। চামড়ার মধ্যে প্রচুর পরিমাণ কোলাজেন নামক উপাদান থাকে, যা এই আঠা তৈরির জন্য একটি উৎকৃষ্ট উপাদান। কাঁচামাল সংগ্রহের পর চামড়াকে বিভিন্ন ধাপে প্রক্রিয়া করা হয়। প্রথমেই চামড়ার গায়ে থাকা চর্বি-ময়লা এবং অন্য অপ্রয়োজনীয় অংশ ফেলে দেওয়া হয়। এরপর চুনের পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয় এসব চামড়া। এর মধ্য দিয়ে চামড়ার গঠন নরম হয়ে যায়। এরপর শুরু হয় মূল কাজ। বাছাই করা সব চামড়ার অংশ উচ্চ তাপমাত্রায় সিদ্ধ করা হয়। দীর্ঘ সময় ধরে চলে এই প্রক্রিয়া। এর ফলে চামড়া গলে গিয়ে তরলে পরিণত হয়। এই তরল অংশ ছেকে আলাদা করা হয়। যা পরবর্তীতে ছোট ছোট ট্রেতে শুকানো হয়। শুকানোর পর তা দেখতে অনেকটা আমসত্ত্বের মতো লাগে। গরু-ছাগলের চামড়া থেকে এভাবে বিভিন্ন ধরনের আঠা তৈরি করা হয়। যার কোনোটা কাজে লাগে ওষুধ শিল্পে।
সূত্র আরও জানিয়েছে, বিভিন্ন ধরনের ক্যাপসুল জাতীয় ওষুধের ওপরের আবরণ তৈরিতেও এই চামড়ার আঠা কাজে লাগে। বিভিন্ন ধরনের কসমেটিকস পণ্যেও এর ব্যবহার হচ্ছে। নানান ধরনের ক্রিম এবং চুলের চিকিৎসায়ও এসব পণ্য কাজে লাগে। একসময় কাঠের আসবাবপত্র তৈরিতে চামড়ার আঠা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এখনও উন্নতমানের ফার্নিচারে এসব আঠা ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি জুতা তৈরির কাজে প্রয়োজন হয় চামড়ার আঠা। বাংলাদেশের এসব কারখানায় উৎপাদিত চামড়ার আঠা প্রচুর পরিমাণে জুতার কাজে লাগে। চামড়া থেকে আঠা তৈরি করা এখন লাভজনক ব্যবসা। কারণ বাংলাদেশের চামড়ার অভাব নেই। খরচও তুলনামূলক কম। তাছাড়া চামড়া সিদ্ধ করতে যে জ্বালানির প্রয়োজন হয় তা ফেলে দেওয়া চামড়ার বিভিন্ন অংশ থেকেই পাওয়া যায়।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়া থেকে বানানো আঠা অনেক বেশি মূল্যবান। চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে জেলাটিন ও চামড়ার আঠার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে ওষুধ ও কসমেটিক শিল্পে এর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। তবে বিদেশে বিক্রির জন্য খুবই উন্নতমানের আঠা তৈরি করতে হয়। বাংলাদেশে এখনও প্রযুক্তির ব্যবহার কম। সে কারণে রফতানির পরিমাণ বেশি নয়। তবে দেশের চাহিদা মেটাতে ভূমিকা রাখছে দেশে তৈরি ব্যবসায়ীদের এসব আঠা তৈরির কারখানা। বাংলাদেশে প্রতিবছর অনেক বেশি চামড়া পাওয়া যায়। সে তুলনায় চামড়া শিল্প উন্নত হয়নি। আগে শুধু জুতা তৈরিতেই সীমাবদ্ধ ছিল এই শিল্প। বর্তমানে চামড়া থেকে আঠা তৈরির ফলে অর্থনৈতিক সুবিধার পাশাপাশি হাজারও মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে।
জানতে চাইলে হাজারীবাগের বেড়িবাঁধ এলাকায় গড়ে তোলা একজন আঠা তৈরির কারখানার মালিক আফজাল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগে ব্যবসা ভালো হতো। কারণ কাঁচামাল সংগ্রহে কোনও টাকা-পয়সা লাগতো না। ট্যানারিতে গেলে এমনিতেই পরিত্যক্ত চামড়ার অংশ ফ্রিতে পাওয়া যেতো। এখন ফ্রি পাওয়া যায় না। কেজি দরে কিনে আনতে হয়। প্রতিকেজি পরিত্যক্ত চামড়া ৮ থেকে ৯ টাকা কেজি দরে কিনতে হয়। এর পর রয়েছে পরিবহন খরচ। হাজারীবাগে ট্যানারি শিল্প থাকাকালীন কোনও পরিবহন খরচ ছিল না। বর্তমানে সাভারের চামড়া শিল্প নগরী থেকে হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ এলাকা পর্যন্ত এক ট্রাক কাঁচামাল আনতে গুনতে হয় ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে উৎপাদিত শিরিষ আঠা বিক্রিতে এখন পর্যন্ত কোনও সমস্যা হচ্ছে না। চাহিদা ব্যাপক থাকায় কারখানা থেকেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। এখানকার পণ্য মূলত বিক্রি হয় নরসিংদীর মাধবদী এলাকায় স্থাপিত কাপড় তৈরির কারখানায়। দাম ভালো পাওয়া যাচ্ছে বিধায় আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ এলাকার শ্রমিক মকবুল হোসেন বলেন, ‘এখানে হাজারও মানুষ কাজ করছে। এসব কারখানায় কাজ করার ক্ষেত্রে ঝুঁকি কম। ঝক্কি-ঝামেলামুক্তভাবে এখানে কাজ করছি। এখন পর্যন্ত পারিশ্রমিকও ভালো। দিনশেষে যা পাই, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ভালোই চলে যাচ্ছে।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আব্দুর রহিম খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখানে তৈরি করা এই শিরিষ আঠার বাজার ভালো। বিদেশেও চাহিদা আছে, কিন্তু রফতানির মতো উৎপাদন হচ্ছে না। যা উৎপাদন হচ্ছে তা দেশীয় বাজারের চাহিদা মেটাচ্ছে বলে শুনেছি। প্রচলিত পণ্যের বাইরে এই আঠা তৈরির কারখানার সঙ্গে জড়িতরা চাইলে সরকারের সহায়তা পেতে পারে।’