আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন সব সময়ই নানা কারণে আলোচনায় থাকেন। কেননা আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতিকে তোয়াক্কা না করেই ‘দুর্বিনীত রাষ্ট্র’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে দেশটি। সবাই অপেক্ষায় থাকেন, এরপর ‘আর কী করবেন কিম? কিম বিশ্বের পরাশক্তিদের সঙ্গে একই টেবিলে বসার সুযোগ যদি নাও পান, তা-ও কিম পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করতে চেয়েছেন, আর যাই করুন না কেন তাকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।
বাকস্বাধীনতা দূরের কথা, জনগণের মৌলিক চাহিদাও এই পরিবারের মুঠোবন্দি। ১৯৪৫ সালে জাপানের কাছ থেকে স্বাধীনতার পর থেকে তিন পুরুষ ধরে উ. কোরিয়ায় একনায়কতন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে কিম পরিবার। আর বছরের পর বছর উত্তর কোরিয়াকে গোলাম বানিয়ে রেখেছে বলে অভিযোগ আছে অহরহ। বিগত কয়েক দশক থেকেই উত্তর কোরিয়ায় চলছে পারিবারিক স্বৈরশাসন। কিম পরিবারের তিন প্রজন্মের কাছেই যুগের পর যুগ ধরে দেশটির সর্বোচ্চ ক্ষমতা গচ্ছিত আছে।
উত্তর কোরিয়ার প্রথম ও ‘চিরন্তন’ প্রেসিডেন্ট কিম ইল-সুং বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান কিমের দাদা ক্ষমতায় আসেন। এরপর দাদার পুত্র অর্থাৎ কিমের বাবা কিম জং-ইল তার উত্তরাধিকারী হন। আর ২০১১ সালের ১৭ ডিসেম্বর বাবার মৃত্যুর পর ক্ষমতায় বসেন কিম জং উন। দেশটিতে সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা করায় শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নিজের আত্মীয়দেরও ছাড় দেয় না। আর খ্রিস্টানদের জন্যতো দেশটি জ্বলন্ত কারাগার। দেশের কোথাও খ্রিস্টান পাওয়া গেলেই তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সরকারের সমালোচনা করলে বা বিরোধী কোনো মনোভাব প্রকাশ করলেই মৃত্যুদণ্ড বা কারাদণ্ডের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়তে হয়।
একনায়কতন্ত্রের কিম রাজবংশের তৃতীয় সদস্য হিসেবে অবারিত ক্ষমতায় বসে আছেন কিম জং উন। সে তার ভাইকেও হত্যা করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বড় সৎ ভাই কিম জং-নামকে উত্তরাধিকারের জন্য উপেক্ষা করা হলে রাজবংশের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন এবং পরে সিআইএ তথ্যদাতা হয়েছিলেন। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ তুলে অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে খুন করা হয় সৎ ভাইকেও। এমনকি যারা এই খুনের সাথে জড়িত, ধরা পরার আগ পর্যন্ত তারা জানতেোই না এমন ঘটনায় জড়াচ্ছেন তারা।
উত্তর কোরিয়া বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলেও অল্প সময়ের মধ্যেই দেশটিকে পরমাণু শক্তিধর করে তুলেছেন কিম। অন্য শক্তিশালী দেশগুলোর হুমকিকে তোয়াক্কা না করে একের পর এক অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছেন তিনি। বাপ-দাদার কিছু রীতি ভেঙে ক্ষমতায়নে নারীদের সামনে এনেছেন কিম। প্রথমবারের মতো নিজের স্ত্রী রি সোল জুকে ফার্স্টলেডির মর্যাদা দিয়েছেন।
ছোট বোন কিম ইয়ো জংকে দলের কার্যনির্বাহী পরিষদ পলিটব্যুরোর সদস্য পদে বসান। উত্তর কোরিয়ার নাগরিকদের কাছে কিম জং উন ভগবানতুল্য। তবে সেটা বাধ্য হয়ে নাকি ভয়ের কারণে তা স্পষ্ট নয়। সরকারের সমালোচকদের কখনও ক্ষুধার্ত কুকুরের মুখে ঠেলে দিয়ে, কখনও কামানের তোপে, আবার কখনও সামনে থেকে গুলি করে দণ্ড দেয়ার একাধিক নজির রয়েছে কিমের। ‘নৃশংস’ এ শাসক তিন শতাধিক অভিজাত লোককে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল রি ইয়ং গিলকে কামানের গোলায় উড়িয়ে দেন পর্যন্ত।
২০১৪ সালে সরকারবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে ক্ষুধার্ত কুকুরের পালে ছেড়ে হত্যা করেন নিজ চাচা জং সাং থায়েককে। জ্যাংয়ের রক্ত সম্পর্কের কাউকে বাঁচিয়ে রাখেননি কিম। রেহাই পায়নি নিরপরাধ শিশুরাও। সামরিক বাহিনীর এক অনুষ্ঠানে ঘুমিয়ে পড়ার কারণে বিমানবিধ্বংসী কামানের গোলায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিওন ইয়ং চলের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন কিম। মৃত্যু ও কারাভোগের হুমকি উপেক্ষা করে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসির কাছে মুখ খোলেন উত্তর কোরিয়ার দু’জন নাগরিক। তাদের কথার সূত্রে জানা যায়, ‘কিম মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেন। অধিকাংশ নাগরিকের মতে রক্তচোষার মতো অর্থ ছিনিয়ে নিতে কিম তার মাথাকে পুরোপুরি কাজে লাগান।’
জাতিসংঘের ত্রাণ সহযোগিতা সংস্থা (ওসিএইচএ) জানায়, দেশটির ৭০ শতাংশ নাগরিক সরকারের খাদ্য প্রোগ্রামের ওপর নির্ভরশীল। দৈনিক তিন বেলার জন্য ৩০০ গ্রাম করে খাবার পান তারা। উত্তর কোরিয়ার ৪১ শতাংশ নাগরিক অপুষ্টিতে ভুগছেন। প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ নাগরিক খাদ্য নিরাপত্তায় রয়েছেন। উত্তর কোরিয়ায় কারও নাম ‘কিম জং-উন’ রাখা যাবে না বলে নির্দেশনা আছে। এছাড়া দাদা ইল-সাংয়ের নামের ক্ষেত্রেও একই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রয়েছে। এমনকি কিমের বাবা ও দাদার জন্মদিনে কেউ জন্মদিনও পালন করতে পারেন না।
দেশের স্কুল-কলেজের পুরো পাঠ্যবইজুড়ে রয়েছে কিম পরিবারের কাহিনী। রয়েছে ‘বিস্ময়বালক’ কিম জং উনের মাহাত্ম্যের বর্ণনা। ভয়ের মাধ্যমে আগামী প্রজন্মকে প্রশ্নহীন আনুগত্য তৈরি করাই এর উদ্দেশ্য কিনা সে প্রশ্নই আজ অনেকের মনে।