হোম রাজনীতি কারাবন্দি নেতাকর্মীদের পরিবারের পাশে বিএনপি: একদফার আন্দোলন

রাজনীতি ডেস্ক:

সরকারবিরোধী চলমান আন্দোলনে কারাবন্দি ও ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের পরিবারের পাশে দাঁড়াচ্ছে বিএনপি এবং বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন। দলটির হাইকমান্ডের নির্দেশে এরই মধ্যে বেশ কিছু পরিবারকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। নানাভাবে নির্যাতনের শিকার নেতাকর্মীদের বাসাবাড়িতে গিয়ে তাদের মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান এবং স্বজনদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা। সেইসঙ্গে আর্থিক সামর্থ্যহীনদের দলের পক্ষ থেকে আইনি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিজেই এসব বিষয় তদারকি করছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

বিএনপির অভিযোগ, দল ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন স্তরের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে মিথ্যা ও গায়েবি মামলায় আটক করা হয়েছে। তাদের অনেকে দীর্ঘদির ধরে কারাবন্দি হয়ে আছেন। অনেকের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। কাউকে কাউকে আটকের পর আদালতে হাজির না করে দীর্ঘদিন অজ্ঞাত স্থানে আটক করে রাখা হয়। এসব কারণে অনেক পরিবারে মানবেতর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। অথচ সংবিধান ও ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করার বিধান।

বিএনপি-সংশ্লিষ্ট কয়েকজন আইনজীবী দাবি করেন, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। এজাহারবহির্ভূতদের ইচ্ছামাফিক গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে মধ্যরাতের পর বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে তল্লাশির নামে আসবাবপত্র ভাঙচুর করা হচ্ছে। এ ধরনের তৎপরতায় পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য ও শিশুরা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত (ট্রমাটাইজড) হচ্ছেন। এমনকি রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে আটক করতে না পেরে তাদের পরিবারের প্রবীণ সদস্য ও নাবালক সন্তানদের পর্যন্ত আটক করা হচ্ছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ সিনিয়র নেতারাও এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন।

বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্র জানায়, গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপি ও তাদের মিত্রদের মহাসমাবেশ কর্মসূচির তিন-চার দিন আগে থেকেই পুলিশ গ্রেপ্তার অভিযান শুরু করে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত ৮২০টির বেশি ‘গায়েবি’ মামলায় ২০ হাজার জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে ৭১ হাজার জন বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে। একজন সাংবাদিকসহ বিএনপির ১৭ কর্মী নিহত এবং ৮ হাজার ১৭৯ জনের বেশি নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। ২৯টি মিথ্যা মামলায় ৯ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১ লাখ ৫০ হাজার মামলায় বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের ৫০ লাখের বেশি নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর ইতিহাসের বর্বরতম নির্যাতন চালানো হচ্ছে। তাদের জামিন লাভের অধিকারও আজ ভূলুণ্ঠিত। নিম্ন আদালত থেকে বিএনপি নেতাকর্মীরা জামিন পাচ্ছেন না। বর্তমানে কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার তিনগুণ বন্দি রাখা হয়েছে, যার বেশিরভাগই বিরোধীদলীয় কর্মী-সমর্থক। কারাগারগুলোতে তাদের নানাভাবে নাজেহাল ও হয়রানি করা হচ্ছে।’

রিজভী জানান, ‘জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অনেক আগে দায়ের করা রাজনৈতিক মামলা অবিশ্বাস্য দ্রুততায় নিষ্পন্ন করে তাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হচ্ছে। গত তিন মাসে ৩১টি মামলায় বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের অন্তত ৫৪৫ জনের সাজা প্রদান করা হয়েছে। এসব মামলার বিচারের ক্ষেত্রে ফৌজদারি বিচার পদ্ধতি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি। আদালতের নির্ধারিত বিচারিক সময়ের বাইরে রাত ৯টা পর্যন্ত সাক্ষী গ্রহণ করা হয়েছে। নিরপেক্ষ সাক্ষী না ডেকে পুলিশের সাক্ষ্যের ওপর নির্ভর করে সাজা দেওয়া হচ্ছে।’

খোঁজ নেওয়া হচ্ছে কারাবন্দিদের স্বজনদের: জানা গেছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে দেশের বিভিন্ন স্থানে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএনপি নেতারা দলের কারাবন্দি ও ক্ষতিগ্রস্ত নেতাদের পরিবারের খোঁজ নিচ্ছেন। গত ১১ নভেম্বর ঢাকা মহানগরীর কয়েকজন কারাবন্দি নেতার বাসায় গিয়ে উপহারসামগ্রী পৌঁছে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইউট্যাব) একটি প্রতিনিধি দল। ইউট্যাবের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম ও মহাসচিব অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ঢাকা মহানগর বিএনপির গ্রেপ্তার কয়েকজন নেতার বাসায় গিয়ে পরিবারের হাতে উপহার তুলে দেন।

ইউট্যাব প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম দৈনিক কালবেলাকে বলেন, ‘বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন ঠেকাতে সরকারের নির্যাতন-নিপীড়ন মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এর ফলে অসংখ্য পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। আমরা আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।’

গত সপ্তাহে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে ক্ষতিগ্রস্ত চারটি পরিবারে সহায়তা দিয়েছেন প্রকৌশলী আইয়ুব হোসেন মুকুল। বিএনপির এই নেতা জানান, বর্তমান আন্দোলন সংগ্রামে ক্ষতিগ্রস্ত এবং কারাবন্দি তৃণমূল পর্যায়ের বিএনপি কর্মীদের বাসায় উপহারসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছি।

এ ছাড়া গত ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে পুলিশের গুলিতে নিহত ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের নেতা শামীম মোল্লার পরিবারের খোঁজখবর নিয়েছে জাতীয়তাবাদী হেল্পসেল। এ সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে হেল্পসেলের সদস্যরা শামীম মোল্লার বাবা, মা ও স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেন এবং তদের হাতে ৫০ হাজার টাকা তুলে দেন।

বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল কালবেলাকে বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে দলের ক্ষতিগ্রস্ত অসংখ্য নেতাকর্মীকে আইনি সহায়তা দিতে সারা দেশে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের নেতা ও জেলার আইন সম্পাদক উদ্যোগ নিচ্ছেন।’

জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের (জেডআরএফ) আইনি সহায়তা সেলের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আশরাফ জালাল খান বলেন, ‘ফাউন্ডেশনের যে কোনো সদস্য গ্রেপ্তার হলে অবশ্যই জেডআরএফের আইনি সহায়তা সেল তার মামলার যাবতীয় পদক্ষেপ নেবে। বিএনপির কোনো সমার্থ্যহীন সমর্থক বা কর্মী সহযোগিতা চাইলে আইনি সহায়তা দেওয়া হবে। সম্প্রতি বিএনপির যেসব নেতাকর্মীর সাজা হয়েছে এবং আগামীতে হতে পারে তাদের তথ্য ও তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিএনপির নেতাকর্মীরা এখন নানা কৌশলে গ্রেপ্তার এড়ানোর চেষ্টা করছেন। এজন্য অনেককে মানবেতর অবস্থায় দিন কাটাতে হচ্ছে। বিশেষ করে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা অবর্ণনীয় কষ্ট করছেন। তারা সবাই নিজের বাড়িঘর ছাড়া। অনেকেই বনে-জঙ্গলে, বাগানে, পুকুরের মাচা, ধানক্ষেত কিংবা মাঝনদীতে নৌকায় রাতযাপন করেন। তা সত্ত্বেও এই নেতাকর্মীরা আন্দোলনে সক্রিয় আছেন।

বিএনপির স্বনির্ভরবিষয়ক সহসম্পাদক নিলুফার চৌধুরী মনি বলেন, ‘সরকারের নানা ধরনের নিপীড়ন সত্ত্বেও নেতাকর্মীরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। অসংখ্য নেতাকর্মী কারাগারে থাকায় তাদের পরিবার খুবই সংকটে রয়েছে। দলের সামর্থ্যবান নেতাদের উচিত, যার যার এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের খোঁজ নিয়ে সাধ্যমতো পাশে দাঁড়ানো।’

বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান ভূঁইয়া মিল্টন বলেন, ‘সরকারের নির্যাতনে উদ্বেগ প্রকাশ করে তা বন্ধের দাবিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা বিবৃতি দিয়েছে। সরকারের উচিত এখনই নির্যাতন বন্ধ করে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সহিংস ঘটনা থেকে শুরু করে চলমান হরতাল-অবরোধে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, বিস্ফোরণ এবং গুপ্তহত্যার বিবরণ তুলে ধরে বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে চিঠি দিয়েছে বিএনপি। গত ২০ নভেম্বর বিএনপির একাধিক সূত্র থেকে চিঠি পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। চিঠিতে বলা হয়েছে, বিএনপি শেখ হাসিনার শাসনামলে সংঘটিত নিন্দনীয় অগ্নিসংযোগ ও সহিংস কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানায়। আমরা একটি নিরপেক্ষ ও সূক্ষ্ম আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানাই এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার রাজনৈতিক সদস্য ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কর্মীদের সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টার তীব্র বিরোধিতা করি,Ñযারা দেশব্যাপী ক্র্যাকডাউনের মাধ্যমে বিরোধী দলকে নির্মমভাবে দমন করতে এ পরিস্থিতিকে কাজে লাগায়।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন