রিপন হোসেন সাজু, মনিরামপুর (যশোর) :
কাজের শুরুতেই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে ৯০% ভাগ বিল প্রদান এবং বিডি’র (ব্যাংক ডিপোজিট) টাকা ফেরত দেওয়াসহ মোটা অংকের ঘুস বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে যশোরের মনিরামপুর উপজেলা প্রকৌশীর বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়; নকল কাগজপত্রে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে এই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সম্প্রতি দুদক অভিযানও চালিয়েছে এই অফিসে। মিলেছে প্রাথমিক সত্যতা। এই ঘটনার পর উপজেলা প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার দাসসহ সংশ্লিষ্ট অনেকেই আতংকে রয়েছেন। সব মিলিয়ে বর্তমানে অফিসটি যেন ঘুষের হাটে পরিণত হয়েছে।
অপরদিকে নিন্মমানের ইট-খোয়া ও বালি দিয়ে প্রায় আট কোটি টাকা ব্যয়ে একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অধীন সড়ক নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতিসহ একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঘুষ দিলেই অনিয়ম যেখানে নিয়ম আর না দিলে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে নিয়মের বেড়াজালে ফেলে নাজেহাল করারও অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, উপজেলার মাহাতাবনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অতিরিক্ত শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ নির্মাণে ৭৯ লাখ ৪৩ হাজার ৬১৪ টাকা চুক্তি ও ৮৩ লাখ ৬১ হাজার ৬৯৯ টাকা প্রাক্কলন মূল্যে জিসান বিল্ডার্স নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ পায়। যার নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার দিন ধার্য্য ছিল ২০২২ সালের ১৯ মে।
অভিযোগ রয়েছে উপজেলা প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার দাস সময় বৃদ্ধি না করেই একই সালের ২২ জুন ওই নির্মাণ কাজের ভিত্তি ঢালাইয়ে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান জিসান বিল্ডার্সকে পত্র দেয়। ওই মাসে নির্মাণ কাজের অগ্রগতি ছিল মাত্র ১৫%। কিন্তু রহস্যজনক কারনে ভিত্তি ঢালাইয়ের ৪ দিন পর ওই নির্মাণ কাজের ৯০% বিল প্রদান করা হয়। কিন্তু অবাক ব্যাপার হচ্ছে ৯০% বিল প্রদানের ১৫ মাস অতিবাহিত হলেও আজও মাহাতাবনগর স্কুলের নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। বিলের বিপরীতে প্রকৌশল অফিস ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ৩৭ লাখ টাকা বিডি করে। কিন্তু নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কাজের শুরতেই প্রকৌশলীর সহযোগীতায় বিডির টাকা উত্তোলন করে নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার।
জানা যায়, ২০১৯ সালের ২৫ এপ্রিল উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় হতে ৯ টি প্যাকেজ কাজের দরপত্র আহবান করা হয়। যার ই-টেন্ডার নোটিশ: ০১/১৮-১৯। টেন্ডারে মেসার্স পারিজাত এন্টার প্রাইজ ও মেসার্স হীরা কনস্ট্রাকশন যৌথভাবে অংশ নেয়। যার রেজি: নং-১৪৬৩ এবং তারিখ ১৮-০৫-২০১৯ ইং। যৌথ উদ্যোগের স্ট্যাম্পের কল নম্বর-২৬৮২৩১৮,২৬৮২৩১৯ ও ২৬৮২৩২০। এই দরপত্র বিজ্ঞপ্তির প্রায় তিন বছর পর উপজেলা খালবাটবিলা ও দূর্গাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণে ২০২২ সালের ৩১ মে উপজেলা প্রকৌশলী র্কাযালয় হতে ০১ টি প্যাকেজ কাজের দরপত্র আহবান করা হয়। এ নির্মাণ কাজের প্রাক্কলন মূল্য ১ কোটি ৫৯ লাখ ৯৪ হাজার ৭০৮ টাকা ও চুক্তি মূল্য ১ কোটি ৪৫ লাখ ২৪ হাজার ৩৯১ টাকা। যার ই-টেন্ডার নোটিশ: ০৭/২১-২২ এবং প্যাকেজ নম্বর-ডবিøউ ১.০৩৮৯১ (আইডি নম্বর.৭০৫৬২৮)। টেন্ডারে মেসার্স পারিজাত এন্টার প্রাইজ ও হীরা কনস্ট্রাকশন নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যৌথ উদ্যোগে টেন্ডারে অংশ নেয়। কিন্তু যৌথ উদ্যোগের এই স্ট্যাম্পটি নকল। যা ২০১৯ সালের ২৫ মে ই-দরপত্র বিজ্ঞপ্তির নম্বর-০১/১৮-১৯ এর বিপরীতে করা যৌথ উদ্যোগের স্ট্যাম্প। এটি স্ক্যানার মেশিনে স্ক্যান করে নতুনভাবে প্রিন্ট দিয়ে ই-দরপত্র বিজ্ঞপ্তি: ০৭/২১-২২-এ দাখিল করে। যার রেজি:নম্বর-১৪৬৩ এবং তারিখ-১৮-০৫-২০১৯ ইং। অভিযোগ রয়েছে উপজেলা প্রকৌশলী দুই লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে নকল কাগজপত্র থাকা সত্তে¡ও এই যৌথ উদ্যোগের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেয়। এ ব্যাপারে মেসার্স পারিজাত এন্টার প্রাইজের কর্ণধার উত্তম কুমার পারিজাত বলেন, তার ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ২০১৯ সালের পর মেসার্স হীরা কনস্ট্রাকশন নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথ উদ্যোগে আর কোন কাজে অংশ নেয়নি। জেলার অন্যান্য উপজেলায় উন্নয়ন তহবিল ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) প্রকল্পের কাজ এলটিএম-এ (লিমিটেড টেন্ডারিং মেথড) দরপত্র আহবান করা হলেও উপজেলা প্রকৌশলী এনওটিএম-এ (ন্যাশনাল ওপেন টেন্ডারিং মেথড) দরপত্র আহবান করেছেন। এতে কাজের মান খারাপ হয়েছে বলে অভিযোগ। এসব সুনির্দ্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে জেলা সমন্বিত দুদুক ((দুর্নীতি দমন কমিশন) গত ২৪ সেপ্টেম্বর উপজেলা প্রকৌশল অফিসে অভিযান পরিচালনা করেন।
এ ব্যাপারে জেলা সমন্বিত দুদক’র উপ-পরিচালক মোঃ আল-আমিন বলেন, অভিযানে প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে। এদিকে মনিরামপুর উপজেলা উন্নয়ন প্রকল্প (জেএমপি), গ্রাম সড়ক পুনর্বাসন প্রকল্প (ভিআরআরপি) ও বৃহত্তর খুলনা অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের (কেডিআরআইপি) -এর আওতায় প্রায় ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে মেসার্স বনান্তর নামের এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান উপজেলার উত্তর ও দক্ষিণা লে রাস্তা নির্মাণের কাজ করছে। জেএমপি-এর অধীন ৩ কোটি ১০ লাখ ২২ হাজার ৮৪০ টাকা ব্যয়ে উপজেলার গালদা মানিকতলা-দিঘিরপাড় বাজার রোড (২ হাজার ৮২ মিটার) ও পাড়ালা সাতগাতী-পাড়ালা রাস্তা নির্মাণ (৯৬০ মিটার) এবং একই প্রল্পের অধীন ২ কোটি ৩৫ লাখ ৮৪ হাজার ১৮০ টাকা ব্যয়ে মথুরাপুর মোল্লাপাড়া-মথুরাপুর রাস্তা (১৪৭৫ মিটার) ও পানিচ্ছত্র রাইস মিল-ঘিবা প্রাইমারী স্কুল রাস্তা নির্মাণ (৯৪০ মিটার), ভিআরআরপি-এর আওতায় ৮০ লাখ ৬৩ হাজার ৪৬৮ টাকা ব্যয়ে কাশিমপুর- বটতলা-রোহিতা ইউপি রাস্তা ও পলাশী রাজবাড়ী-এড়েন্দা রাস্তা এবং কেডিআরআইপি-আওতায় ১ কোটি ৬৮ লাখ ২ হাজার ৬০ টাকা ব্যয়ে খেদাপাড়া ইউপি কাশিপুর মান্দারতলা রাস্তা (২৩৯০ মিটার) নির্মাণ কাজ চলছে। এসব রাস্তা নির্মাণে নিন্মমানের ইটের খোয়া ও বালি ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে। উত্তরা লের রাস্তা কাজে পার্শ্ববর্তী স্মার্ট ভাটায় নিন্মমানের ইট ও বালি মিশিয়ে ট্রলিযোগে এনে বেজ দেওয়া হয়েছে। এসময় রাস্তার নির্মাণ শ্রমিক আব্দুল মান্নান,কবির হোসেন,শাহাদাৎ হোসেন অনেকেই বলেন,এই ইটের খোঁয়া দিয়ে বেজ, সাববেজ করা হয়েছে, যা বেশি দিন টিকবে না।
ইঞ্জিনিয়ার অফিসের স্যারদের সামনে এসব করা হলেও তারা কিছু বলেন না। এক প্রশ্নের জবাবে রাস্তা নির্মাণের কর্তব্যরত উপসহকারি প্রকৌশলী আব্দুল খালেক বলেন, ব্যস্ততার কারনে কয়েক দিন যাওয়া হয়নি। এজন্য এমনটি করা হয়েছে। আর উপজেলার দক্ষিনের রাস্তার কাজের সব ইটের খোঁয়া ভাঙ্গা হচ্ছে তারা নামের এক ইটভাটায়। এসময় ভাটার ম্যানেজার মোঃ কওছার আলী বলেন, সাইদ সাহেব (ঠিকাদার) ৮০ হাজার ইট কিনে খোঁয়া ভাঙ্গাচ্ছেন। ইকবাল ও সালাম নামের দুই শ্রমিক অতি নি¤œমানের ইট ভাঙ্গছেন। তারা বলেন, মালিক ভাঙ্গালে তাদের কি করার আছে ? এসব ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার আবু সাঈদ বলেন, কোন ধরনের নিন্মমানের ইট-বালি ব্যবহার করা হয়নি।
এসব অনিয়ম-দুর্নীতি বিষয়ে উপজেলা প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার দাস দুদক’র অভিযানের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, কোন ধরনের অনিয়ম হয়নি। আর একটা কাগজের জন্য ঠিকাদারকে বঞ্চিত করা যায় না। অপর এক প্রশ্নের জবাবে মাহাতাবনগরের স্কুলের কাজ ১০/১২ দিনের মধ্যে শেষ হবে। জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ শরিফুল ইসলাম বলেন, দুদক’র অভিযানসহ সার্বিক বিষয় উপজেলা প্রকৌশলী ভাল বলতে পারবেন। তিনি এ ব্যাপারে আর মন্তব্য করতে চাননি।