খুলনা অফিস :
করোনা ভাইরাস তথা কোভিড-১৯ বর্তমানে এক আতংকের নাম যা মানব জাতির জন্য দিন দিন আরও কঠিন হয়ে উঠছে। করোনা ভাইরাস মানুষের শ্বাসযন্ত্রে অর্থাৎ ফুসফুসে আক্রমণ করে এবং যাদের ফুসফুসে সমস্যা আছে তারা অত্যন্ত সংকটময় অবস্থায় চলে যেতে পারে। এমন সময়ে আক্রান্ত্রের জন্য ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন পড়ে। এ ব্যাপারে সংকটাপন্ন রোগীদের আইসিইউতে চিকিৎসার জন্য মেকানিকাল ভেন্টিলেটর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র। কিন্তু বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশে করোনা চিকিৎসায় ভেন্টিলেটরের মারাত্নক সংকট রয়েছে। আর যেটুকু বিদ্যমান তাও সাধারনের উপযোগী ও সহজ ব্যবহারযোগ্য নয়। করোনা আক্রান্তদের ভেন্টিলেটরের এই সংকট মোকাবেলায় শ্বাস-প্রশ্বাসে সহায়ক ও সহজ ব্যবহারযোগ্য পজিটিভ এয়ারওয়ে প্রেসার(সিপিএপি) যন্ত্র আবিষ্কারের সফলতা দেখিয়েছেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অধ্যাপক ডঃ মোঃ আমিনুল হক আকন্দ। তিনি ঢাকার এম’স ল্যাব ইঞ্জিনিয়ারিং সলিউশনের সিইও ইঞ্জিনিয়ার মিঠুন কুমার দাসের সাথে যৌথভাবে এই সিপিএপি যন্ত্র তৈরী করেছেন। এই দুই উদ্ভাবকদের প্রত্যাশা সরকারী সহযোগীতা পেলে দেশীয় প্রযুক্তির অবকাঠামো ব্যবহার করে সিপিএপি যন্ত্রটির বাণিজ্যিক উৎপাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবিলায় যুগান্তকারী ভুমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
এই যন্ত্রের উদ্ভাবক অধ্যাপক ডঃ মোঃ আমিনুল হক আকন্দ ও ইঞ্জিনিয়ার মিঠুন কুমার দাস বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কোভিড-১৯ এর প্রায় ৮০% রোগী হাসপাতালে ভর্তি না হয়েই সুস্থ হয়ে উঠেন এবং হাসপাতালে ভর্তি রোগীর কেবলমাত্র একটি ছোট অংশের(ছয়জনের মধ্যে একজন) ভেন্টিলেটর সহায়তার প্রয়োজন পড়ে। এ ব্যাপারে পজিটিভ এয়ারওয়ে প্রেসার (সিপিএপি) শ্বাস-প্রশ্বাস সহায়ক যন্ত্রও ব্যবহৃত হয়।ভেন্টিলেটর ও সিপিএপি উভয়ই শ্বাস-প্রশ্বাস সহায়ক যন্ত্র হলেও তাদের মাঝে বিশেষ পার্থক্য আছে। ভেন্টিলেটর টিউবের মাধ্যমে শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ করে যা রোগীর মুখ, ভোকালকর্ড এর মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করানো হয়। ডিভাইসটি কেবলমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতালে ব্যাবহার যোগ্য এবং কেবল দক্ষ প্রযুক্তিবিদ এটিস্থাপন করে যখন রোগী নিজের শ্বাস নিতে না পারে।
অন্যদিকে, সিপিএপি মুখোশ দ্বারা নাকের মাধ্যমে শ্বাসকষ্টে সহায়তার জন্য ব্যবহৃত হয় এবং এটি ঘুমের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ বা অনিয়মিত হয়ে নিদ্রাহীনতার ক্ষেত্রে কার্যকরি।সিপিএপি ভেন্টিলেটরের তুলনায় অনেক সস্তা এবং এটি হাসপাতাল ও বাড়ি উভয় পরিবেশেই ব্যবহারযোগ্য। কারণ এটি স্থাপনের জন্য দক্ষ প্রযুক্তিবিদ প্রয়োজন নেই। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন দেশের হাসপাতালে সিপিএপিকে ভেন্টিলেটর এর বিকল্প অথবা ব্যাকআপ হিসাবে রাখছে। অতএব, সিপিএপি হল বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক কোভিড-১৯ রোগীকে বিশেষত যাদের শ্বাসকষ্টের সমস্যা রয়েছে তাদের সহায়তার জন্য সবচেয়ে কার্যকর যন্ত্র।
উদ্ভাবকদ্বয় জানান, সিপিএপি যন্ত্র তৈরিতে তাদেরকে যুক্তরাজ্যের আলস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ এন সিদ্দিক ও আরও কয়েকজন চিকিৎসক পরামর্শ দিয়ে সহায়তায় করেছেন। প্রথম দিকে তাদের ভেন্টিলেটর তৈরির পরিকল্পনা থাকলেও যে সকল ডাক্তার বিশেষ করে যারা যুক্তরাজ্যের বেলফাস্ট হাসপাতালে কোভিড-১৯ ফ্রন্ট-লাইনে কাজ করছে তদের পরামর্শে সিপিএপি তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়। তৈরিকৃত সিপিএপি যন্ত্রটি মাইক্রোকন্ট্রোলার ভিত্তিক বৈদ্যুতিক-যান্ত্রিক ডিভাইস যা নিয়ন্ত্রিত নিয়মিত বায়ুচাপ বজায় রাখে ফলে এটি শ্বাসকষ্টজনিত কোভিড-১৯ রোগীদের শ্বাস-প্রশ্বাসের সহায়তার জন্য গুরুত্তপূর্ণ। ডিভাইসে একটি কন্ট্রোল ইউনিট, একটি বিশেষ এয়ার পাম্প, ব্যাকআপ ব্যাটারি সহ পাওয়ার ইউনিট, মাস্ক, এবং ডিজিটাল ডিসপ্লে রয়েছে।পাম্পটি যন্ত্রটির প্রাণকেন্দ্র যা চাপযুক্ত বায়ু তৈরি করে; প্রতিস্থাপিত প্রেসার সেন্সর বায়ুচাপকে পরিমাপ করে ও নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। একটি টিউনারের দ্বারা রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসের অবস্থা অনুযায়ী উপযুক্ত চাপ টিউন করা হয় যা কন্ট্রোল সার্কিটের মাধ্যমে পাম্পটি নিয়ন্ত্রণ করে। ডিভাইসটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে রোগীদের অবস্থা যেমন ঘুম বা জাগ্রত অবস্থার ভিত্তিতেবায়ু চাপ বজায় রাখে।অবশেষে, চাপযুক্ত বায়ু নলের মাধ্যমে মাস্ক এবং রোগীর নাক দিয়ে প্রবাহিত হয়।ডিভাইসটি এসি 220V এর পাওয়ার সাপ্লাই ব্যবহার করে সার্কিট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে রিচার্জেবল ব্যাটারির মাধ্যমে চলে। বিদ্যুৎ না থাকলেওএক ঘন্টা বা আরও বেশি সময়(ব্যাটারির ক্ষমতা নির্ভর করে) ব্যাটারি ব্যাকআপ থেকে চলবে। ব্যাটারি এবং সিস্টেমের অন্যান্য অবস্থা সার্বক্ষণিকভাবে এলসিডি ডিসপ্লেতে পরিলক্ষিত হয়। তৈরিকৃত সিপিএপি যন্ত্রটির মান ইন্টারনেটে প্রাপ্ত ডিভাইসগুলির তথ্যের ভিত্তিতে পর্যালোচনায় সামঞ্জস্যপূর্ণ তবে দাম হিসাবে অত্যন্ত সাশ্রয়ী। এই মুহূর্তে সিপিএপি যন্ত্রটির প্রোটোটাইপ ভার্সন তৈরির ব্যয় প্রায় ১২,০০০ টাকা। তবে অধিক সংখ্যক উৎপাদনের ক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যয় এবং বিপণনের ব্যয় বিবেচনায় খুচরা মূল্য কম হবে। বর্তমানে চীনে তৈরি সিপিএপস-এর অনলাইন খুচরা মূল্য ৫০,০০০ টাকা বা তারও অধিক। মাঝারি বা উচ্চতর উৎপাদন সুবিধা থাকা যেকোন ইলেকট্রনিক অ্যাসেম্বলি কোম্পানিতে উক্ত সিপিএপির বাণিজ্যিক উৎপাদন সম্ভব। ভেন্টিলেটরের অপ্রাপ্যতা ও উচ্চ ব্যয়,জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলিতে পৰ্যাপ্ত সুবিধা ও প্রযুক্তিবিদ না থাকায় উক্ত সিপিএপি যন্ত্রটি বাংলাদেশের কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। যন্ত্রটির সাশ্রয়ী মূল্য এবং সহজ ব্যবহারযোগ্যতা(এমনকি বাড়িতে) কোভিড-১৯ মহামারীতে হাসপাতালের উপর চাপ কমাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণও বটে। তাছাড়া সিপিএপি যন্ত্রটি বাড়িতে শ্বাস-প্রশ্বাস সহায়ক এবং নিদ্রাহীনতার ক্ষেত্রেও ব্যাবহার যোগ্য।
দুই উদ্ভাবকের প্রত্যাশা সরকারী সহযোগীতা পেলে দেশীয় প্রযুক্তির অবকাঠামো ব্যবহার করে সিপিএপি যন্ত্রটির বাণিজ্যিক উৎপাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবিলায় যুগান্তকারী ভুমিকা রাখতে সক্ষম হবে।এ ব্যাপারে উদ্ভাবকগন সরকারী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও বিভাগের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা কামনা করছে।
পূর্ববর্তী পোস্ট