রিপন হোসেন সাজু, মনিরামপুর (যশোর) :
হচ্ছে না কর্মসংস্থান-মিলছে না টাকা ফেরত। এমন সংকটময় পরিস্থিতি নিয়ে মনিরামপুরের ২৫ টি অটিস্টিক এন্ড প্রতিবন্ধী স্কুলের ৩ শতাধীক শিক্ষক-কর্মচারীর দিন কাটছে। নিয়োগ প্রাপ্ত এসব স্কুলের শিক্ষক কর্মচারীগণ বেতনের আশায় বছরের পর বছর বিদ্যালয়ে শ্রম দিয়েছেন। বর্তমানে বেতন না পাওয়া এবং আগামী দিনগুলোতেও বেতন না হওয়ার সম্ভবনা দেখেই হাল ছেড়ে দিয়েছেন তারা। ২৫ টি প্রতিষ্টানের প্রায় সবক’টিতেই শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে টাকা ফেরতের আশায় ঘুরছেন।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বলছেন, প্রতিটি উপজেলাতে একটি করে এ বিদ্যালয় বেতনের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত রয়েছে। খোঁজ খবর নিয়ে জানাগেছে, মনিরামপুরে এক শ্রেণীর ব্যক্তিরা উপজেলার ইউনিয়নগুলোতে অটিস্টিক এন্ড প্রতিবন্ধী স্কুল খুলে বসেন। ২০১৮ সালে প্রথম এ বিদ্যালয় চালু করেন মণিরামপুরের বেলতলা গ্রামের মিজান মিন্টু নামের এক স্কুল শিক্ষক। মোটা অংকের অর্থ নিয়ে এ বিদ্যালয়ে ১৭ জন শিক্ষক-কর্মচারী পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এরপর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে রাতা-রাতি ব্যাঙ্গের ছাতার মত গড়ে ওঠে। কথিক প্রতিষ্ঠাতারা রান ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির নামের এনজিও’র সাথে যোগসাজসে বেতন-ভাতার লোভ দেখিয়ে এসব প্রতিবন্ধী স্কুল স্থাপন করে নেন।
সূত্র জানায়, এ সব স্কুলে নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে সাড়ে ৩ লক্ষ থেকে ৭ লক্ষ করে টাকা নেয়া হয়েছে। ৩ শতাধীক শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে প্রায় ১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ওই সব প্রতিষ্ঠানের কথিত প্রতিষ্ঠারা। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ার শিক্ষক-কর্মচারীরা বন্ধ করে দিয়েছে তাদের কার্যক্রম। তারা এখন ডোনেশনের নামে দেওয়া টাকা গুলো ফেরত পাবার আশায় দিনের পর দিন ঘুরছেন ওই সব কথিত প্রতিষ্ঠাতাদের পিছু পিছু। কিন্তু টাকা ফেরত না পাবার সম্ববনার কথা ভেবে হতাশায় ভূগছেন তারা। সরেজমিন খোজ নিয়ে জানাগেছে, উপজেলায় কমপক্ষে ২৫ টি অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় রয়েছে।
এর মধ্যে ময়েজউদ্দীন মেমোরিয়াল অটিস্টিক এন্ড প্রতিবন্ধী স্কুল ও অ্যাড. খান টিপু সুলতান অটিস্টিক এন্ড প্রতিবন্ধী স্কুলে চোখে পড়েছে। উপজেলার মোবারপুর অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী স্কুলের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিদ্যালয় প্রাঙ্গনটি এখন বনায়নে পরিণত হয়েছে। এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে দশআনি, দিঘিরপাড়, জয়পুর, খানপুর, বালিদাহ,পাচাকড়ি, দূর্বাডাঙ্গা, সুন্দলপুর, ঝাঁপা, মাঝিয়ালী, ডুমুরখালি প্রতিবন্ধী স্কুলগুলোতে। তবে প্রতিষ্ঠাতারা দাবী করেছেন, রান রান ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি এনজিও’র মাধ্যমে গড়ে তোলা হয় এসব প্রতিষ্ঠান। তাদের অভিযোগ প্রতিষ্ঠান করার নামে অর্থও হাতিয়ে নিয়েছেন তারা।
ওয়ান ডেভেলমেনট সোসাইটির সেক্রেটারি গাউছুল আজম প্রতিষ্ঠাতাদের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সামজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ২০০৯ সালের এক নীতিমালা অনুযায়ী এসব স্কুল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তারা কাজ করেছেন। উপজেলা প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি সুকান্ত ঘোষ টপি বলেন, বিভিন্ন সময় ভূয়া পরিদর্শন ও এমপিওভূক্তির দোহায় দিয়ে বেলতলা স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা মিজান মিন্টুর বিপুল অংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। যে কারণে উপজেলায় এবিষয়ে একটি কমিটি করা হলেও মিজান মিন্টুকে রাখা হয়নি সেই কমিটিতে। একই কথা বলেছেন সমিতির সাধারন সম্পাদক হুমায়নও।
তবে মিজান মিন্টু বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি দাবী করেছেন, বর্তমানে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে বিদ্যালয়গুলোর কাগজপত্রাদি যাচাই-বাছাই চলছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এমপিওভূক্তির সম্ভবনাও রয়েছে। বন্ধ থাকার কারন জানতে চাইলে জামাল উদ্দীন, নাজমুল হাসান, কবিরুল ইসলামসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক জানান, স্কুল চললে প্রতিদিন মোটা অংকের অর্থ খরচ হয়। যার ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে।
ডোনেশন দিয়ে চাকরী নিয়ে বেতন না পেয়ে সোহেল, আল আমিন ও প্রতিবন্ধী শিক্ষিকা সাওদা খাতুনসহ একাধিক ভূক্তোভোগি তাদের চরম কষ্টে দিন কাটছে বলে জানিয়েছেন। তাদের দাবী ডোনেশনের নামে দেয়া টাকাগুলো ফেরত পাইলেও অনন্ত কিছুটা স্বস্তি পেতাম। সূত্র আরো জানায়, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি সমাজ কল্যান মন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্রে উপজেলায় স্থাপিত অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী স্কুলের প্রতিবেদন চেয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে এক পরিপত্র দেয়া হয়। এসময় উপজেলার সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তাদের দিয়ে স্থাপিত স্কুলের প্রতিবেদন নেয়া হয়।
উপজেলা সমাজ সেবা অফিসার রোকনুজ্জামান বলেন, ওই সময় উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় স্থাপিত প্রতিবন্ধী স্কুলে উপজেলার বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা পরিদর্শনে যান। মাত্র ৫ মিনিটরে একটি ভিডিও পাঠানো হয়। এর বাইরে আর কোন কার্যক্রমের কথা তার জানা নেই। জেলা সামজ সেবা অফিসার অশিত কুমার সাহা জানান, প্রতিবন্ধী স্কুলের কোন কার্যক্রমের সাথে তাদের সংশ্লিষ্টতা নেই। সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এই পরিপত্রের খবর জানতে পেরে দ্রত এমপিওভূক্ত হতে যাচ্ছে এমন গুজোব চাউর হয়। এতে করে তাড়াহুড়া করে অনেকেই নতুন করে আরো স্কুল তৈরীর প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন।
যোগাযোগ করা করা হলে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) প্রভাষ চন্দ্র রায় সাংবাদিকদের বলেন, এমপিওভূক্তির খবরে ব্যঙ্গের ছাতার মত প্রতিবন্ধী স্কুল হয়েছে। সরকারী নীতিমালার আলোকে যাচাই-বাছাই চলছে। যা দীর্ঘ প্রক্রিয়াধীন বলেও তিনি জানান। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যাচাই-বাছাই শেষে প্রতিটি উপজেলায় একটি মাত্র প্রতিবন্ধী স্কুল বেতা-ভাতার আওতায় আসতে পারে। যা সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন থেকে প্রদান করা হবে।