নিউজ ডেস্ক:
অবশেষে ভাগ্য খুলছে দেশের ৩১৫টি বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স স্তরের প্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষক পরিবারের। ২০১৮ সালের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা সংশোধন করে শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে। আর বৈঠক করে এমপিওভুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ।
বৈঠকের রেজুলেশন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় বাজেটসহ নীতিমালা অনুমোদনের জন্য অর্থ বিভাগে প্রস্তাবনা পাঠানোর উদ্যোগও নেওয়া হয় কয়েক দিন আগে। নীতিমালা সংশোধন করতে চিঠি দেওয়া হয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছেও। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমপিও শাখা থেকে এ সংক্রান্ত ফাইল উত্থাপন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সদ্য বিদায়ী সিনিয়র সচিব (বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সচিব হিসেবে চুক্তিভিত্তিক সংযুক্ত) সিদ্দিক জোবায়ের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এমপিওভুক্তি বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।’
এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়ার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব (রুটিন দায়িত্ব) মো. মজিবুর রহমান এমপিওভুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এমপিওভুক্তির বিষয়ে আমাদের অগ্রগতি রয়েছে। সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে অগ্রগতি সম্পর্কে জানা যাবে।’
উপসচিব (বেসরকারি মাধ্যমিক-৩) সাইয়েদ এ. জেড. মোরশেদ আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মিটিং হয়েছে। মিটিংয়ের রেজুলেশন অনুযায়ী অনুযায়ী অর্থ বিভাগে বাজেট পাঠানো হবে, সেই ফাইল ওঠানো হয়েছে। এর জন্য এমপিও নীতিমালার কিছু অংশ সংশোধন হবে, সে জন্য আমরা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালককে চিঠি দিয়েছি।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উচ্চশিক্ষায় কামিল স্তরের মাদ্রাসার শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত হলেও বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকরা ৩২ বছর ধরে এমপিও-বঞ্চিত ।
সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা জানান, বিগত কয়েক বছর ধরে আন্দোলন করছেন শিক্ষকরা। ২০২০ সালে জনবল কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। কিন্তু তখন অর্থ মন্ত্রণালয় এমপিওভুক্তির অর্থ বরাদ্দ দিতে সম্মত হয়নি। ২০২৩ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে আবারও এমপিওভুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু অর্থ বিভাগের সম্মতি না পাওয়ায় নীতিমালা সংশোধন করে জনবল কাঠামোতে নিতে পারেনি মন্ত্রণালয়।
২০২৪ সালে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পান ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তিনি দায়িত্ব পাওয়ার পর (আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগে) বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছিলেন, ‘উন্নয়ন ব্যয় কমিয়ে শিক্ষকদের সুযোগ সুবিধা বাড়ানো হবে। বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধিসহ অন্যান্য সুবিধা দেওয়া হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে বেসরকারি অনার্স কলেজের শিক্ষকদের বেতন ভাতার ব্যবস্থা করা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সম্মতি না দিলে প্রথমবার অর্ধেক এবং পরে বেতনের শতভাগ দেওয়া হবে।’ তার এই বক্তব্যের কিছু দিন পর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।
সরকার পতনের পর গত ১৫ থেকে ১৭ অক্টোবর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের সামনে লাগাতার আন্দোলন শুরু করেন বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকরা। কিন্তু আন্দোলনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন লাঠিচার্জ, জলকামান ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে শিক্ষকদের আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করে পুলিশ। আহত হন শিশুসন্তানসহ নারী শিক্ষক। তখন বেশ কয়েকজন শিক্ষকও আহত হয়েছেন।
পরবর্তীকালে আবার আন্দোলনেরও উদ্যোগ নেন শিক্ষকরা। তবে সরকারের ইতিবাচক মনোভাবের কারণে তারা আন্দোলন কর্মসূচি গ্রহণ করেননি।
জানতে চাইলে বেসরকারি কলেজ অনার্স-মাস্টার্স ফেডারেশনের সভাপতি নেকবর হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত ২ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে এমপিওভুক্তির সিদ্ধান্ত হওয়ায় আন্দোলনের আর প্রয়োজন নেই। আমরা চাই দ্রুত জনবল ও এমপিও নীতিমালা সংশোধন করে এমপিওভুক্তির ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’
বেসরকারি কলেজ অনার্স-মাস্টার্স ফেডারেশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি হারুন অর রশিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা গত বছর অক্টোবর মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের সামনে আন্দোলন করেছি। তাছাড়া আমরাই সবার আগে আন্দোলন করেছি, সবার দাবি পূরণ হলেও আমাদের দাবি পূরণ হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের সহযোগিতার জন্যই আমরা আন্দোলন না করে বর্তমানে অপেক্ষা করছি। বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে বলে আন্দোলনের প্রয়োজন নেই। তবে দ্রুত দৃশ্যমান অগ্রগতি চাই। ৩২ বছর ধরে শিক্ষকরা বঞ্চিত। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আর যেন সময়ক্ষেপণ না হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জনবল কাঠামো অনুযায়ী ডিগ্রি স্তর পর্যন্ত পরিচালিত এমপিওভুক্ত কলেজগুলোতে ১৯৯৩ সালে অনার্স-মাস্টার্সের অনুমোদন দেয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। বিধিবিধান অনুযায়ী নির্ধারিত স্কেলে কলেজ কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের মূল বেতন দেওয়ার শর্তে অনার্স-মাস্টার্সের বিষয় অনুমোদন পায়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট কলেজের টিউশন ফি থেকে শিক্ষকদের বেতন ভাতা দেওয়ার নির্দেশনা দেয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এই পর্যায়ে কলেজগুলোর জনবল কাঠামোতে স্থান পায়নি অনার্স ও মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকদের পদ। ফলে সরকারি বিধিবিধানের আলোকে এমপিওভুক্ত হওয়ার সুযোগ বঞ্চিত হন তারা। এই পরিস্থিতিতে ৩২ বছর ধরেই বঞ্চিত হচ্ছেন অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকরা।