রাজনীতি ডেস্ক:
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক কিছু গণমাধ্যমে চরম বিভ্রান্তিমূলক খবর ও নানা প্রচারণা চালানো হচ্ছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে টার্গেট করে এ অপপ্রচার চলছে। দেশের উন্নয়ন, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন নিয়েও ভিত্তিহীন অভিযোগ করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব গুজব যেসব গণমাধ্যম ছড়াচ্ছে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা দরকার। এজন্য সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট এখন খুবই জরুরি।
গুজব ছড়ানোর পেছনে যারা
বাংলাদেশে সক্রিয় কায়েমি স্বার্থবাদী একটি মহল ও শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চায়- এমন রাজনৈতিক দলগুলো এসব প্রচার-প্রচারণার পৃষ্ঠপোষকতা করছে বলে জানা গেছে। এর মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় আর্থ-সামাজিক সূচকগুলোর অভূতপূর্ব অগ্রগতি ও নজিরবিহীন উন্নয়ন অগ্রাহ্য করে একটি ভিন্ন চিত্র আঁকার চেষ্টা করছে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে অর্থের বিনিময়ে খ্যাতনামা পশ্চিমা সংবাদপত্রগুলোতে একের পর এক নিবন্ধ প্রকাশের মাধ্যমে সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একইভাবে এর মধ্যদিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতারণা ও কর ফাঁকির অভিযোগে চলমান মামলা থেকে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে রক্ষা করার চেষ্টাও চলছে।
বিশেষ করে বাংলাদেশ যখন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন সরকার ও তার প্রধানকে টার্গেট করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আক্রমণাত্মক প্রতিবেদনের সংখ্যা বাড়ছে। এসব প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য নিয়ে এরইমধ্যে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
সম্প্রতি বিশ্বের বেশ কয়েকজন খ্যাতিমান ব্যক্তি বাংলাদেশকে নিয়ে একটি খোলা চিঠি লেখেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে লেখা ওই চিঠিতে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান বিচার প্রক্রিয়া অবিলম্বে বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়।
ওই খোলা চিঠির পরপরই এএফপি, বিবিসি বাংলা ও নিউইয়র্ক টাইমস-এই তিন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে পরপর তিনটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এসব প্রতিবেদনে মূলত এটাই প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে যে, ক্ষমতাসীন সরকার বিরোধীদের দমনে নানা ধরনের অপকৌশল প্রয়োগ করছে।
প্রতিবেদনের পাশাপাশি নিবন্ধ ও প্রবন্ধও প্রকাশ করা হচ্ছে। এতে ভিত্তিহীন সব অভিযোগ তোলা হচ্ছে যে, ক্ষমতা ধরে রাখতে বিরোধীদের নির্মূল ও দমনপীড়নমূলক পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছে সরকার। এসব নিবন্ধ ও প্রবন্ধ সরকারবিরোধীদের দাবিকেই প্রতিধ্বনিত করছে।
সরকারকে দোষারোপ
দৃষ্টান্ত হিসেবে গত সপ্তাহে ফরাসি সংবাদ সংস্থা এএফপিতে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রবন্ধটিতে দাবি করা হয়েছে, নির্বাচন সামনে রেখে ‘ভুয়া বিশেষজ্ঞরা সরকারের পক্ষে মিথ্যা তথ্য বা ‘গুজব’ ছড়াচ্ছেন।’
বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন নীতির প্রশংসা করে স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের কিছু লেখা সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তবে কদরুদ্দিন শিশিরের লেখা ওই নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে, এএফপির এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন নীতির প্রশংসা করে ‘শত শত নিবন্ধ-প্রবন্ধ’ অনলাইনে ছেয়ে গেছে।
এসব নিবন্ধ যারা লিখেছেন তাদেরকে নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। দাবি করা হয়েছে, ‘এসব লেখকের কোনো অস্তিত্বই নেই।’ লেখকরা ‘ভুয়া পরিচয়, ছবি ও নাম ব্যবহার করেছেন’ বলেও দাবি করা হয়েছে।
যেমন নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘বিশ্লেষকরা বলছেন, জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে নির্বাচন সামনে রেখে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের দিয়ে একটি অবিচ্ছিন্ন প্রচারণা চালানো হচ্ছে এটা তারই প্রমাণ। যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে লাভবান করার উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।’
নিবন্ধে এও উল্লেখ করা হয়েছে যে, গত বছরের সেপ্টেম্বরের পর থেকে এমন ‘নিবন্ধ-প্রবন্ধ প্রকাশ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ওই সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, সরকারবিরোধী ‘নেতিবাচক প্রচারণা’ মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার ‘ভালো কলামিস্ট’ খুঁজছে।
এএফপি দাবি করেছে, এ ব্যাপারে মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সময় স্বল্পতার কথা বলে সাক্ষাৎকার দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তবে সংবাদ সংস্থাটি সরকারের সিনিয়র কোন কর্মকর্তা বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল কিনা তা স্পষ্ট নয়।
প্রবন্ধে ঢাকাভিত্তিক সংবাদমাধ্যমে দুজন সিনিয়র সাংবাদিকের বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে। তবে কোনো গণমাধ্যম বিশ্লেষকের বক্তব্য নেয়া হয়নি। একইভাবে বিবিসি বাংলায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। দাবি করা হয়েছে, সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতে এক ধরনের দমনমূলক পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। যেখানে ক্ষমতাসীন দলের নীতিকে সমর্থন করতে কর্মীদের বাধ্য করা হচ্ছে।
যেমন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে সরকারি চাকরি থেকে শুরু করে আধাসরকারি কিংবা স্বায়ত্তশাসিত- সব পেশাতেই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরকারি দলকে সমর্থনের জন্য প্রচণ্ড চাপের পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যা থেকে রেহাই পাচ্ছেন না দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে থাকতে আগ্রহী কর্মীরা।’
বিবিসি বাংলা বলছে, দেশে বিভিন্ন পেশার সাবেক ও বর্তমান বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে এ ধারণা পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, তারা (কর্মকর্তা) বলছেন, এ কারণেই ড. ইউনূস ইস্যুতে সরকারি দলের অবস্থানের সঙ্গে মিলিয়ে বক্তব্য, বিবৃতি কিংবা কর্মসূচি পালনের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশে।’
এর সঙ্গে সম্প্রতি স্বাধীনতা দিবসকে বিতর্কিত করতে প্রথম আলোর একটি উদ্দেশ্যমূলক প্রতিবেদনের দৃষ্টান্ত হিসেবে টানা হয়েছে। বিবিসি বলছে, ‘একই অবস্থা তৈরি হয়েছিল গত মার্চে দৈনিক প্রথম আলোর ফেসবুক পাতায় প্রকাশিত একটি বিভ্রান্তিকর ফটো কার্ডকে ঘিরেও।’
বিবিসির দাবি, সরকারি নীতির সমর্থন করতে অনিচ্ছুক যেকোনো কর্মকর্তাকে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ২০০৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ধীরে ধীরে এসব পরিবর্তন আনা হয়েছে।
এতে আরও দাবি করা হয়েছে, ড. ইউনূস ইস্যুতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনসহ বেশ কয়েকজন ব্যক্তির বিবৃতি দেয়ার প্রেক্ষিতে এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তীব্র ক্ষোভ প্রকাশের পর ওই বিবৃতির বিপক্ষে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের বিবৃতি ও কর্মসূচির ঝড় ওঠে।
এছাড়া চলতি মাসের শুরুর দিকে মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসে এক বিতর্কিত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। যাতে দাবি করা হয়, ‘বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা দিয়েছে সরকার। যার মাধ্যমে দেশের বহুদলীয় গণতন্ত্রকে ‘পদ্ধতিগতভাবে ধ্বংস’ করা হচ্ছে।
এএফপির ক্যাম্পেইন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে
সিনিয়র সাংবাদিক অজয় দাশ গুপ্ত বলেছেন, এএফপি ফ্যাক্ট চেকিংয়ের নামে যে কাজটি করছে তা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক মোটিভেটেড একটি ক্যাম্পেইন। বাংলাদেশকে নিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে এবং বাহিরে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন রকমের নোংরা, কুৎসা এবং মিথ্যা সংবাদ প্রচার করছে। এএফপি ফ্যাক্ট চেকিংয়ের নামে যেগুলো করেছে সেগুলোর কিন্তু একটিরও কোনো রেফারেন্স নেই। এএফপির প্রতিবেদনের সাংবাদিক হিসেবে যার নাম ব্যবহার করা হয়েছে তিনি রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট একজন লোক এটা সবারই জানা। এবং তার প্রতিবেদনেও এর প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। সে যেই কথাগুলো বলছে সেগুলোই যে সত্য তার ফ্যাক্ট চেকিং কিন্তু এখনও পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবার, দেশের উন্নয়ন, দেশের অগ্রগতি, দেশের আগামী নির্বাচনে সব নিয়ে একটি মহল নানা ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে, মিথ্যা সংবাদ ছড়াচ্ছে এবং গুজবকে সত্য বলে চালানো হচ্ছে। নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনূসকে হেনস্তা করার মত মিথ্যা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। ১৭০ জনের যে বিবৃতি রয়েছে এই বিবৃতিতে যে কতটুকু ভুল কথা আছে, নিছক রটনাকে যে সত্য বলে চালানো হয়েছে সেটিকে কিন্তু ফ্যাক্ট চেকিংয়ের আওতায় আনা হয়নি।
গুজব ঠেকাতে সাইবার সিকিউরিটি আইন জরুরি
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইকতিয়ার উদ্দিন ভূইয়া বলেন, এই মুহূর্তে ভূ-রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ একটি ভালো অবস্থানে আছে। এই কারণে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ভারত সবারই এখন বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ রয়েছে যে কিভাবে বাংলাদেশকে তাদের আয়ত্তে নেয়া যায় তাদের নিজেদের সার্থকে পূরণ করার জন্য। সেই জায়গা থেকে চীনভিত্তিক কিছু সংবাদ মাধ্যম রয়েছে যাদের সংবাদ চীনের পক্ষে যাচ্ছে; আবার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কিছু সংবাদমাধ্যম রয়েছে যাদের নিউজ যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে যাচ্ছে। সেই জায়গায় আমাদের যে সাইবার সিকিউরিটির স্পেসটুকু রয়েছে তা ওপেন করা যায় না। এটার জন্য সাইবার সিকিউরিটি আইন খুব জরুরি। এই মুহূর্তে আমাদের কোনো সাইবার সিকিউরিটি আইন নাই যে আইন ছিল সেটা পরিবর্তন করা হয়েছে। সেটাকে খুব দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার। অর্থাৎ আইনে পরিণত করা দরকার।
তিনি বলেন, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট ছাড়া আসলে এই যে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে সেটা বন্ধ করা সম্ভব না। যাচাই বাছাই ছাড়া ডেইলি স্টার, প্রথম আলো তাদের মতো পত্রিকায় যেসব গুজব ছাপানো হচ্ছে এগুলো সংবাদের নিয়মের মধ্যে পড়ে না। এরা অনেকেই সরকারের বিরুদ্ধে গুজব ছড়াচ্ছে।
ইকতিয়ার উদ্দিন ভূইয়া বলেন, সাইবার সিকিউরিটি নিশ্চিত করতে মেকানিজম প্রয়োজন। এই মেকানিজমটা কি হবে সেটা ঠিক করা খুব জরুরি। কেননা সরকারের বিরুদ্ধে এই যে এত প্রোপাগান্ডা হচ্ছে এবং ভূ রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ যখন একটা শক্তিশালী অবস্থানে আছে তাই রাশিয়া-চীন-ভারত সবাই চাচ্ছে এখানে একটা ইনফ্লুয়েন্স তৈরি করার জন্য। যার যার নিজস্ব ইন্টারেস্টের জায়গা থেকে। সেই জায়গায় আমাদের উচিত হবে আমাদের সাইবার সিকিউরিটি আইনটাকে খুব দ্রুত বাস্তবায়ন করা, তাহলে আমাদের সরকারের বিরুদ্ধে যে প্রোপাগান্ডা হচ্ছে সেটিকে আমরা কন্ট্রোল করতে পারব।
তিনি বলেন, এএফপি যে নিউজটা করেছে এতে ৩৫ জনের বিবৃতি দিয়েছে। এই ৩৫ জনের বিভিন্ন নামে উদ্ধৃতি দিয়ে নিবন্ধন প্রকাশিত হয়েছে। এএফপি যে সবকিছু একদম সত্যিকার অর্থে বলে যাচ্ছে সেটাও কিন্তু না, আবার চীনের বেশ কিছু ব্লগ জার্নাল আছে সেগুলো ভুয়া নাম ব্যবহার করছে। সবকিছু প্রত্যেকে করছে তাদের সার্থকে সহজ করার জন্য। আমি মনে করি এএফপিসহ আরও যারা নিউজ প্রকাশ করেছে সবগুলোকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এটার জন্য আমাদের সাইবার সিকিউরিটি আইনটা আগে পাস করতে হবে।