আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
ইউক্রেন ইস্যুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসন দুটি বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র মন্দায় পড়েছে। দ্বিতীয়ত, দেশটি কৌশলগত অবমাননার শিকার হয়েছে।
বর্তমানে মার্কিন অর্থনীতি নিশ্চিতভাবে মন্দার মধ্যে রয়েছে। তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট মুদ্রাস্ফীতির কারণে দেশটি শ্রমিকদের বেতন ৬ শতাংশ কমানো হয়েছে।
ওয়াশিংটন এর আগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ক্ষমতা থেকে সরাতে, রাশিয়ার যুদ্ধ করার ক্ষমতা ধ্বংস করতে এবং রুশ অর্থনীতি ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লেগেছিল।
রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে জ্বালানি ও খাদ্য সরবরাহে বিশ্ব অর্থনীতি বিশাল ধাক্কায় পড়ে। ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা শেষ করে হয়তো মুদ্রাস্ফীতি কমানো যায়। তবে এই নীতি রোগের চেয়েও খারাপ একটি নিরাময়।
এ দিকে ফিনিশ গবেষণার তথ্যানুযায়ী, রাশিয়া যুদ্ধের প্রথম ১০০ দিনের মধ্যে জ্বালানি রফতানি থেকে রেকর্ড ৯৭ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে গ্রুপ অব সেভেনের (জি-৭) নিষেধাজ্ঞায় যোগ দিতে অস্বীকার করেছে চীন ও ভারত। তারা রাশিয়া থেকে ব্যারেলপ্রতি ৩০-৪০ ডলার ছাড়ে তেল কিনছে। অন্যদিকে আমেরিকান এবং ইউরোপীয় গ্রাহকরা পুরো মূল্য পরিশোধ করে তেল নিচ্ছেন।
জি-৭ দেশগুলোর মুদ্রাস্ফীতির মূল কারণ জ্বালানির দাম। এশিয়া টাইমসের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ভোক্তা মূল্যসূচকে (সিপিআই) তেলের দাম গত এক থেকে চার মাসে ৭০ শতাংশ বেড়েছে। মার্কিন ভোক্তা মূল্যসূচকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের মে পর্যন্ত—গত ১৫ বছরের তুলনায় তেলের দাম দ্বিগুণ হয়েছে।
মার্কিন জিডিপি প্রথম ত্রৈমাসিকে বার্ষিক হারে ১ দশমিক ৯ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। গত ১৫ জুন দেশটির বাণিজ্য বিভাগ জানায়, মে মাসে খুচরা বাজার আশ্চর্যজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। মার্কিন হাউজিং মাসে ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ হ্রাস পেতে শুরু হয়েছে। এটি আগামী নভেম্বরের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের জন্য বিপর্যয়ের কারণ হয়ে উঠবে।
আমেরিকান মন্দার চেয়েও ভয়ংকর হলো জি-৭-এর দুর্বল অর্থনীতি। ফেডারেল রিজার্ভ ক্রেডিট সংকটের কারণে জাপানের ইয়েন পতনে পড়েছে। ২০১১ সালে সরকারি ঋণ বেড়ে জিডিপির ২৭০ শতাংশ দাঁড়িয়েছিল, যার অর্ধেকই দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। জাপান বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। একটি বয়োজ্যেষ্ঠ জনগোষ্ঠীর দেশে সঞ্চয়ের পরিবর্তে নিজস্ব তহবিল ব্যয় বাড়ছে। এ সপ্তাহে জাপানের সরকারি বন্ড রক্ষা করার খরচ ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
ইউরোপের সবচেয়ে দুর্বল অর্থনীতি ইতালিতেও সরকারি ঋণের ঝুঁকি ব্যাপক বেড়েছে। গত ১৫ জুন দ্য ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক তার দুর্বলতম সদস্যদের ঘাটতি মোকাবিলায় একটি জরুরি সভা আহ্বান করেছিল। সভায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘খণ্ডিতকরণ’ রোধ করার জন্য ব্যবস্থা নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বাইডেন প্রশাসনের কোভিড মোকাবিলার জন্য ৬ ট্রিলিয়ন ডলার প্যাকেজের কারণে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব বেড়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের অধীন কোভিড প্যাকেজটি শুরু হয়েছিল। কিন্তু এটি বাইডেন প্রশাসনের আমলে দ্বিগুণ হয়েছে। তারা রাশিয়ার অর্থনীতির স্থিতিস্থাপকতা ও তার সামরিক বাহিনীর সক্ষমতাকে মূল্যায়ন করতে পারেনি।
ইউক্রেনে রুশ অভিযান থামানো সহজ নয়। এটি অসম্ভবও হতে পারে। বাইডেন রুশ নেতাকে (পুতিন) যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। পুতিনকে প্রেসিডেন্টের পদেও থাকতে দেয়া যাবে না বলে মন্তব্য করেছিলেন তিনি। এ ছাড়া মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে রুশ অর্থনীতি অর্ধেকে নেমে আসবে বলেও দাবি করেছিলেন বাইডেন। মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন দাবি করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার যুদ্ধ করার সক্ষমতা ধ্বংস করে ফেলবে।
ইউক্রেন যদি রাশিয়াকে আঞ্চলিক ছাড় দিয়ে সমঝোতায় আসে, তাহলে এটি ওয়াশিংটনের জন্য চরম অপমান হবে। ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করার একটি পথ হলো আলোচনা। যদিও এটি সম্ভব নয়। ওয়াশিংটন এখনো ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষার তকমা ধরে রেখেছে। একই সঙ্গে ইউক্রেনকে মস্কোর সঙ্গে আলোচনায় বসতে ইউরোপীয় নেতাদের উদ্বুদ্ধ করছে।
সম্ভাব্য একটি ইঙ্গিত দিয়ে গত ১৪ জুন ইউএস আন্ডার সেক্রেটারি অব ডিফেন্স ফর পলিসি কলিন এইচ কাহল বলেছেন, ‘ইউক্রেনীয়দের কীভাবে আলোচনা করতে হবে, কী আলোচনা করতে হবে এবং কখন আলোচনা করতে হবে আমরা তা বলতে যাচ্ছি না। তারা নিজেদের জন্য এই শর্তাবলি সেট করতে যাচ্ছে।’
বারাক ওবামার শাসনামলে ভাইস প্রেসিডেন্ট বাইডেনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন কাহল। বাইডেনের সবচেয়ে বিতর্কিত নিয়োগকারীর একজন ছিলেন তিনি। রিপাবলিকান সিনেটররা সবাই পেন্টাগন পদে তার মনোনয়ন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট কামলা হ্যারিসও তার বিপক্ষে ছিলেন। এটি লক্ষণীয় যে, বিবৃতিটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বা জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানের কাছ থেকে নয়; বরং কাহলের কাছ থেকে এসেছে। কাহলের বিবৃতিটি নিশ্চিতভাবে চরম বিদ্বেষমূলক।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্স ও জার্মানি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে মিনস্ক চুক্তি-২ মেনে চলতে বলেছিল। এ চুক্তি অনুযায়ী, রুশ ভাষী অঞ্চলগুলোকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হবে।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি জেলেনস্কি যুদ্ধ এড়াতে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের একটি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। গত ১ এপ্রিল দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, শলৎজ মস্কো ও কিয়েভের মীমাংসার জন্য একটি চাপ দিয়েছিলেন। তিনি ১৯ ফেব্রুয়ারি মিউনিখে জেলেনস্কিকে বলেছিলেন, ইউক্রেনের উচিত তার ন্যাটো যোগদানের আশা বাদ দেয়া এবং পশ্চিম ও রাশিয়ার বিষয়ে নিরপেক্ষ থাকা। ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুতিন ও বাইডেন একটি চুক্তিতে সই করবেন। কিন্তু পুতিন ও জেলেনস্কি কেউ এ ধরনের একটি চুক্তিতে ভরসা রাখেননি; বরং অধিকাংশ ইউক্রেনীয় ন্যাটোয় যোগ দিতে চেয়েছিল।
অসহায় জেলেনস্কিকে ন্যাটোয় যোগ দেয়ার আশা জুগিয়েছিল ওয়াশিংটন ও লন্ডন। সেই আশ্বাসে ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। কাহল বলেন, ইউক্রেনকে কী করতে হবে তা যুক্তরাষ্ট্র বলবে না। কিন্তু জেলেনস্কির সঙ্গে অন্য সরকারগুলোর (পশ্চিমা) আলোচনার পথ রুদ্ধ করা হয়নি। গত ১৬ জুন জেলেনস্কির উপদেষ্টা ওলেক্সি আরেস্টোভিচ বলেন, জার্মান চ্যান্সেলর শলৎজ, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ও ইতালির প্রেসিডেন্ট মারিও দ্রাঘি কিয়েভ সফরের সময় জেলেনস্কির কাছে এমন দাবি জানাতে পারেন।
জেলেনস্কির উপদেষ্টা আশঙ্কা করছেন, শলৎজ, ম্যাক্রোঁ ও দ্রাঘি মিনস্ক-৩ চুক্তির চেষ্টা করবেন। তারা হয়তো বলবেন, আমাদের এই যুদ্ধের অবসান ঘটাতে হবে। এই যুদ্ধ খাদ্য ও অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি করছে। এতে রুশ ও ইউক্রেনীয়রা মারা যাচ্ছে। আমাদের পুতিনের মুখ রক্ষা করতে হবে। তার ভুলগুলো ক্ষমা করে দিতে হবে। বিশ্বসমাজে তাকে ফিরে আসার সুযোগ দিতে হবে।
জার্মানির শীর্ষস্থানীয় দৈনিক ডাই ওয়েল্ট মন্তব্য করেছে, কিয়েভ পশ্চিমের সংহতি নিয়ে সন্দেহ করতে শুরু করেছে। শান্তি প্রচেষ্টার আহ্বান জানিয়ে আওয়াজ তোলা হচ্ছে। বিশেষ করে, ন্যাটোপ্রধান স্টলটেনবার্গের একটি বিবৃতিতে এই আভাস পাওয়া গেছে।
গত ১২ জুন ন্যাটো মহাসচিব বলেন, ‘প্রশ্ন হলো: শান্তির জন্য আপনি কী মূল্য দিতে ইচ্ছুক? কত এলাকা? কতটা স্বাধীনতা? কতটা সার্বভৌমত্ব? কতটা স্বাধীনতা? গণতন্ত্রের শান্তির জন্য কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি? এবং এটি খুব কঠিন একটি নৈতিক দ্বন্দ্ব।’
রাজনৈতিকভাবে বাইডেনের টিকে থাকা নির্ভর করছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন ও উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ডের আদর্শগত অগ্রাধিকারের ওপর।
আমরা জানি না, বাইডেন প্রশাসন সত্যিই এই ডাবল বিপর্যয়ের মুখে কী করবে। এ মুহূর্তে, এটি সম্ভবত জানাও যাবে না। যদিও কী করা দরকার সেই বিষয়টি স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র হয় এ পরিস্থিতিতে খ্যামা দেবে নয়তো বিশ্বকে মন্দার মধ্যে আরও নিমজ্জিত করবে।
সূত্র: এশিয়া টাইমস
লেখক: ডেভিড পি গোল্ডম্যান, মার্কিন অর্থনীতিবিদ
ভাষান্তর: পাপলু রহমান