আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
ইউক্রেনে বৃহস্পতিবার ভোর থেকে হামলা শুরু করেছে রাশিয়া। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ, খারকোভ, ওডেসাসহ বিভিন্ন শহরে একের পর এক হামলা চালায় রাশিয়া। হামলার বিকট শব্দ, আগুন আর ধোঁয়ায় আতঙ্কিত দেশটির মানুষ।আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, রুশ বাহিনীর হামলায় ৪০ জনেরও বেশি ইউক্রেনিয়ান সৈন্য নিহত হয়েছেন। এছাড়া অভিযানের প্রথম ঘণ্টায় ১০ জন বেসামরিক নাগরিকও নিহত হয়েছেন।
এদিকে রাশিয়ার ৫০ সেনাকে হত্যার খবর প্রকাশ করেছে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী। একটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার কথাও জানায় তারা। এ নিয়ে ৬টি যুদ্ধবিমান ধ্বংসের দাবি করেছে ইউক্রেন।
দেশটিতে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা ভালো নেই। আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের। সোয়া ৪ কোটি জনসংখ্যার দেশ ইউক্রেনে বসবাস করে এক থেকে দেড় হাজারের মতো বাংলাদেশি। তবে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে সেখানে বাংলাদেশির সংখ্যা এর চেয়ে তিন থেকে চার গুণ বেশি।
সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশি যুবক রুমন। থাকেন ইউক্রেনের মারিওপোল শহরে। আজভ সাগরের তীরবর্তী এই শহরটি দোনেৎস্ক অঞ্চলে অবস্থিত। ইউক্রেইনের রুশপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যে দুটি অঞ্চল দখল করে আছে দোনেৎস্ক তার একটি, অন্যটি লুহানস্ক।
সেখানকার সবশেষ পরিস্থিতি নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা হয় রুমনের। তিনি বলেন, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বাংলাদেশে পরিবার থেকে তাকে বার বার ফোন করে ফিরে যেতে বলা হচ্ছে। আমি তাদের বলেছি, এখানে সব ঠিক আছে। যাতে তারা আতঙ্কিত হয়ে না পড়ে।
পরিবারকে শান্ত রাখতেই তিনি একথা বলেছেন বলে জানান তিনি। তবে পরিস্থিতি আসলে ভালো নেই।
নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে চাই উল্লেখ করে বাংলাদেশি এই যুবক বলেন, আপনাদের মাধ্যমে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন করছি, তিনি যেন আমাদের নিরাপত্তার একটা ব্যবস্থা করেন। আপাতত তিনি যেন আমাদের নিরাপদ কোথাও সরিয়ে নেওয়ার কথা বলেন। সেটা হতে পারে পোল্যান্ড, হতে পারে রোমানিয়া বা অন্য কোনো নিরাপদ জায়গা।
তিনি বলেন, আগে আমাদের একটা নিরাপদ আশ্রয় দরকার। তারপর না হয় দেশে ফেরা বা যা সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। আপাতত আমাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করুন।
যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, অনেকেই খাবার মজুদ করছে, আপনিও করেছেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে রুমন বলেন, ‘এখানে সুপারশপে খাবার আছে। লোকজন একটু বেশি কেনাকাটা করছে। তবে খুব হুড়োহুড়ি এখনও টের পাচ্ছি না।’
তবে অর্থ তোলার জন্য লোকজন এটিএম বুথের সামনে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘চার পাঁচ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর তবেই টাকা তোলা যাচ্ছে। এক একটা লাইন আধা কিলোমিটারের বেশি লম্বা। যদিও আমি টাকা তুলতে যাইনি। তবে শুনেছি, মেশিনে টাকা আছে এবং সবাই প্রয়োজনমতো তুলতে পারছে। এটিএমে টাকা ফুরিয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে রিফান্ড করা হচ্ছে।’
এদিকে ইউক্রেনে বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস না থাকলেও পাশের দেশ পোল্যান্ডের দূতাবাস সার্বিক যোগাযোগ রাখছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
তিনি বলেন, পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস ইউক্রেনে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সাথে যোগাযোগ রাখছে। বিভিন্ন কারণে ইউক্রেনে বসবাসরত বাংলাদেশিদের প্রতিবেশী দেশ পোল্যান্ডে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, দূতাবাসের পক্ষ থেকে হোয়াটঅ্যাপে গ্রুপ করে গতকাল প্রায় তিনশর মতো বাংলাদেশির সাথে বৈঠক করা হয়েছে। ইউক্রেনে থেকে বাংলাদেশিদের পোল্যান্ডে নিয়ে এসে আপাতত আশ্রয় দিতে আমরা নির্দেশ দিয়েছি। সেখানে থেকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
শাহরিয়ার আলম জানান, ইউক্রেনে বসবাসরত বিদেশিদের ১৫ দিনের জন্য সাময়িক ট্রানজিট ভিসা দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে পোল্যান্ড।
মন্ত্রী বলেন, আজ বা কালকের মধ্যে পোল্যান্ড তাদের সিদ্ধান্ত কার্যকর করবে বলে আশা করছি। তারপর বাংলাদেশিরা পোল্যান্ডে ঢুকতে পারবেন।
ওয়ারশতে বাংলাদেশের দূতাবাসের পক্ষ থেকে অস্থায়ী আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে জানিয়ে মন্ত্রী আরও বলেন, ইউক্রেনে প্রায় এক হাজার বাংলাদেশি রয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে যাদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী।
ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযান নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ সবসময় সংলাপ এবং কূটনীতির মাধ্যমে সংকট সমাধানের নীতিতে বিশ্বাসী। দুঃখজনকভাবে পরিস্থিতি গুরুতর রূপ নিয়েছে। শান্তির পথে যেসব সমস্যা রয়েছে আলোচনার মাধ্যমে তার সুরাহা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে সেই সংলাপের পথে যাওয়ার জন্য আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।
এ বিষয়ে পোল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা হোসেন বিবিসিকে বলেন, ইউক্রেনে বসবাসরত প্রায় পাঁচশ বাংলাদেশি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন এবং তারা চলে যেতে চাইলে তাদের কী ধরনের সহায়তা দেওয়া যাবে, তা নিয়ে তারা ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।
পোল্যান্ড সরকার ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্ত খুলে দিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পোল্যান্ড সরকার এক ব্রিফিংয়ে আমাদের জানিয়েছে, ইউক্রেনে থাকা তৃতীয় দেশের নাগরিকরা সেদেশ ছাড়তে চাইলে, পোল্যান্ড ১৫ দিনের জন্য তাদের ট্রানজিটে থাকার অনুমতি দেবে।’
প্রসঙ্গত, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘোষণার পর বৃহস্পতিবার ভোর থেকে ইউক্রেনে ‘সামরিক অভিযান’ শুরু করে রুশ বাহিনী। ইউক্রেন দাবি করেছে- রাশিয়া পুরোদমে যুদ্ধ শুরু করেছে। এরপর ইউক্রেনের বড় বড় কয়েকটি শহরে সামরিক স্থাপনায় রুশ বাহিনী ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। ইউক্রেনের এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সামরিক শাসন জারির আহ্বান জানান, এরপর এক মাসের জরুরি অবস্থা জারি করে ইউক্রেন।
এদিকে বিশ্বনেতাদের প্রতি রাশিয়ার ওপর কঠোর বিধি নিষেধ আরোপের আহ্বান জানিয়েছে ইউক্রেন। সেই ধারাবাহিকতায় রুশ সেনাদের অভিযান থামানোর আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। এ নিয়ে জরুরি বৈঠকেও বসে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। এছাড়া রাশিয়ার অভিযানে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
পূর্ব ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার লাখো সেনা মোতায়েন নিয়ে উত্তেজনা চলছিল বেশ কিছুদিন ধরে। গত সোমবার (২১ ফেব্রুয়ারি) পূর্ব ইউক্রেনকে স্বাধীন ঘোষণার পর রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো।