হোম জাতীয় আবারও কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করলেন পিটার হাস

জাতীয় ডেস্ক:

সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের অস্বাভাবিক তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও বিভিন্ন ইস্যুতে একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য করছেন তিনি, যা নানা বিতর্ক ও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে: এসবের মাধ্যমে কী হাসিল করতে চান এই মার্কিন কূটনীতিক।

বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বেশ আগে থেকেই সক্রিয় পিটার হাস। কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে প্রায়ই আলোচনায় উঠে আসছেন তিনি। এবার বাংলাদেশি গণমাধ্যমের ওপর ভিসাবিষয়ক বিধিনিষেধ আরোপের হুমকি দিয়ে বিতর্ক উসকে দিয়েছেন হাস।

পিটার হাস বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বললেও মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর বলছে ভিন্ন কথা। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর পরিষ্কার করেই বলেছে, তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ক্ষমতাসীন দলের সদস্য ও বিরোধী দলগুলোর ওপর ভিসা নীতি বাস্তবায়ন করছে, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব বা সাংবাদিকদের ওপর নয়। তাহলে এমন হুমকি পিটার হাস কেন দিলেন? এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিনিয়র সাংবাদিক নাইমুল ইসলাম খান বলেন, ‘তাকে (পিটার হাস) এমন মন্তব্যের অবশ্যই ব্যাখ্যা দিতে হবে।’

গত রোববার (২৪ সেপ্টেম্বর) একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে পিটার হাস বলেন, গণমাধ্যমকর্মীদেরও ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হতে পারে। তার এমন বক্তব্য বিভিন্ন মহলে উদ্বেগ তৈরি করে। বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও ক্ষুণ্ন হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

শুধু তা-ই নয়, তার ওই মন্তব্য অনেককেই হতবাক করেছে। অবাক হয়েছেন স্বয়ং তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে পিটার হাসের ওই মন্তব্য সম্পর্কে জানতে পারেন বলে জানান তিনি। বাংলাদেশের গণমাধ্যম বাধাহীনভাবে কাজ করছে জানিয়ে তথ্যমন্ত্রী বলেন, মার্কিন কূটনীতিকের বক্তব্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নগ্ন হস্তক্ষেপ ও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার শামিল। একটি স্বাধীন দেশের গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা সমীচীন নয়।

পিটার হাসের মন্তব্য মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও স্বাধীন গণমাধ্যমের ধারণার পরিপন্থি বলে মনে করেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা। দৈনিক আমাদের নতুন সময়ের সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, ‘তাদের ভিসা নীতি ঘোষণার বেলায় গণমাধ্যমের কথা ছিল না, প্রয়োগের বেলায় কেন বলা হচ্ছে, সেটি পিটার হাসের ব্যাখ্যা করা উচিত।

নাঈমুল ইসলাম খান সময় সংবাদকে বলেন, মিডিয়া তাদের মতামত প্রকাশে যেন কোনো বাধার সম্মুখীন না হয়, সেটা নিশ্চিত করাই হচ্ছে এখানে ভিসা নীতি প্রবর্তন করার উদ্দেশ্য।’

কিন্তু হঠাৎ করে পিটার হাস একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে ইন্টারভিউ দেন আর সেখানে তিনি উল্লেখ করেন যে, মিডিয়ার বিরুদ্ধেও এই ভিসা নীতি ব্যবহার করা হবে। আমরা কোনোভাবেই মূল ঘোষণাটার সঙ্গে সর্বশেষ এই ব্যাখ্যাটা, এই প্রয়োগের যে ব্যাখ্যাটা আমরা কিছুতেই মেলাতে পারছি না। সুতরাং আমি মনে করি, রাষ্ট্রদূত এ বিষয়ে একটা সুন্দর ব্যাখ্যা দেবেন।

পিটার হাসের কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘনের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বাংলাদেশের যে লক্ষ্য–অবাধ ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন করা–যুক্তরাষ্ট্রও তা-ই বলছে। এতে আমার মনে হচ্ছে, দুই দেশের মনোভাবে কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু এখানে যদি কোনো অস্পষ্টতা তৈরি হয়, তাহলে বিষয়টি দেখবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের একজন সদস্য। ফলে তার কথার সঙ্গে যদি মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের কথার কোনো পার্থক্য দেখা দেয়, তাহলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হবে বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া।’

এটা তাদের কাজ। দুদেশের সঙ্গে কথা বলে তারা বিষয়টি জানাবে কোন তথ্যটি সঠিক। এতে গণমাধ্যমকর্মী ও সাধারণ মানুষের কাছে বার্তাটি পরিষ্কার হবে যে, কাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আসবে আর কাদের ওপর আসবে না।

বেশি গুরুত্ব পাচ্ছেন পিটার হাস

সম্প্রতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পিটার হাসকে ব্যাপক সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। যেসব কাজ তার করার কথা নয়, সেসবই করছেন তিনি। বিভিন্ন সময় কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে রাজনৈতিক কর্মীর মতো তৎপরতা চালাতে দেখা গেছে তাকে। তার এসব কর্মকাণ্ড বিতর্ক উসকে দিচ্ছে।

এতসব বিতর্কিত কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে তাকে। বিশ্লেষকদের মতে, হীনমন্যতা থেকেই তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে বিশেষ একটি মহল। চলতি মাসের শুরুর দিকে রাজধানীর বনানীর একটি হোটেলে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল আয়োজিত জাতীয় যুব সম্মেলনে বক্তব্য দেন পিটার হাস।

সেখানে তিনি প্রকাশ্যেই বলেন, দুর্নীতি, বাকস্বাধীনতা না থাকা, আস্থার সংকট ও ভোট না দিতে পারার সংস্কৃতির কারণে বাংলাদেশের তরুণরা রাজনীতিবিমুখ হচ্ছেন। এর পর গত সপ্তাহে রাজধানীর নর্থ সাউথ (এনএসইউ) ইউনিভার্সিটিতে এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে আবারও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন পিটার হাস।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে হস্তক্ষেপ নয়, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে সহায়তা করা এবং এর মাধ্যমে জনগণকে তাদের নেতা নির্বাচন করার সুযোগ করে দেয়াই যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য। তার কথায়, ‘জনগণ যাতে স্বাধীনভাবে তাদের নেতা নির্বাচন করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করতে আমরা সহায়তা দিতে প্রস্তুত।

প্রতিটি দেশের কূটনৈতিক শিষ্টাচার আছে। ভিয়েনা কনভেনশন অনুসারে কিছু নিয়মনীতি মেনেই বিভিন্ন দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা সর্বজনীন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রভাবশালী দেশ এসব নিয়মের তোয়াক্কা করে না। বিভিন্ন দেশে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে এবং আজ্ঞাবহ সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন ধরনের অপচেষ্টায় তারা লিপ্ত হয়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের উচিত তার নিজের কাজের সীমা নির্ধারণ করে তার ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকা। আমাদেরও উচিত তাকে সেই সীমার ভেতরে থাকতে বাধ্য করা। কিন্তু তা না করে তাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডেকে এনে এবং প্রশ্ন করে রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়ার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে।

বিতর্কিত ভিসা নীতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে নগ্ন হস্তক্ষেপ

যুক্তরাষ্ট্র তার নিজস্ব ভিসা নীতিকে ভূরাজনৈতিক স্বার্থে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে চলতি বছরের ২৪ মে এক নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের ওপর ভিসা নীতি গ্রহণ করে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর।

মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর থেকে সে সময় বলা হয়, বাংলাদেশে একটি অবাধ, মুক্ত ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনে সমর্থনের লক্ষ্যে এই ভিসা নীতি ঘোষণা করা হয়েছে। আরও বলা হয়, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করায় জড়িত যেকোনো বাংলাদেশির ওপর এই ভিসা নীতি প্রয়োগ করা হবে। যার মধ্যে থাকবে সাবেক ও বর্তমান সরকারি কর্মকর্তা, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলগুলোর সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা।

গত ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ নিয়ে দেশটির ভিসা নীতি ঘোষণা দেন। সে সময় ম্যাট নামের এক সিনিয়র মার্কিন সাংবাদিক এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

তিনি মিলারের কাছে জানতে চান, এটি আবার নতুন করে ঘোষণা করার কী আছে? আইনে তো এটা বলাই আছে। জবাবে ম্যাথিউ মিলার বলেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন সামনে রেখে আমরা এটা আবার ঘোষণা করছি।’ যদিও মিলারের জবাব সিনিয়র সেই মার্কিন সাংবাদিককে সন্তুষ্ট করতে পারেনি।

ভিসা নীতি ঘোষণার চার মাসের মাথায় গত শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাদানে দায়ী ও জড়িত ব্যক্তিদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।

কোনো অনিয়মের প্রমাণ পেলেই সচরাচর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে থাকে ওয়াশিংটন। যেটা পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র মিলারও বলেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারে এই ভিসা নীতি প্রয়োগের ঘোষণা অনেককেই বিস্মিত করেছে। বিশেষ করে যখন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে, তখন এই ভিসা নীতি ঘোষণার সময় ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

তবে এ ভিসা নীতি নিয়ে অযথা ভয় না পাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটাকে বাংলাদেশে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন, বাইরে থেকে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করা হচ্ছে। নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করা হলে বাংলাদেশের জনগণও নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি বিবেচনা করবে।

অন্যদিকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা সীমাবদ্ধতা নিয়ে সরকার চিন্তিত নয়। আমাদের হারানোর কিছু নেই; আমরা এটা নিয়ে চিন্তিত নই। কারণ, আমরা কোনো ভুল করছি না।’

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন