হোম অন্যান্যসারাদেশ অবাধ্যতা ও গুরুতর অসদাচরণের দায়ে খুবি’র এক শিক্ষক বরখাস্ত, দু’জনকে অপসারণের সিদ্ধান্ত

খুলনা অফিস :

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন উস্কে দেওয়া, শৃঙ্খলা পরিপন্থি ও গুরুতর অসদাচরণের দায়ে এবার তিনজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এরমধ্যে একজন শিক্ষককে চাকুরি থেকে বরখাস্ত এবং দুইজনকে অপসারণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এই তিন শিক্ষক হলেন, বাংলা ডিসিপ্লিনের সহকারী অধ্যাপক আবুল ফজল, একই ডিসিপ্লিনের শাকিলা আলম এবং ইতিহাস ও সভ্যতা ডিসিপ্লিনের প্রভাষক হৈমন্তী শুক্লা কাবেরী।

খুবি’র সূত্র জানান, অপসারণের কথা জানিয়ে ওই তিন শিক্ষককে চূড়ান্ত নোটিশ দেওয়া হয়েছে। নোটিশে বলা হয়, শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ১৮ জানুয়ারি বেলা ১২ টায় অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের ২১১তম সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে তাদের স্ব স্ব নামে কেনো তাদেরকে বরখাস্ত এবং অপসারণ করা হবে না মর্মে পত্র দিয়ে ২১ জানুয়ারি দুপুর পর্যন্ত জবাব দেওয়ার সময় দেওয়া হয়েছে।

তাদের জবাব পাওয়ার পর নিয়মানুযায়ী পরবর্তী প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এ বিষয়ে চ‚ড়ান্ত আদেশ জারি করা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার প্রফেসর খান গোলাম কুদ্দুস উক্ত তিন শিক্ষককে শো’কজ নোটিশ দেওয়ার কথা নিশ্চিত করে বলেছেন,প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাদেরকে ১৮জানুয়ারী নোটিশ দেয়া হয়েছে এবং ২১জানুয়ারী সময়সীমা নির্ধারন করা হয়েছে’।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, গত বছর ১ জানুয়ারি প্রথমবর্ষে ভর্তির দিন যখন ক্যাম্পাসে নবাগত শিক্ষার্থীরা তাদের অভিভাবকসহ আসে ঠিক সেদিনই বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী অনেকটা অতর্কিতে রাস্তা অবরোধ করে তাদের দাবির পক্ষে শ্লোগান দিতে থাকে। এই অবস্থান সমাবেশ চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক তাদের মধ্যে যেয়ে আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। অথচ ছাত্রদের এই দাবি নিয়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে কোনো কথা বলেননি বা কোনো পরামর্শ দেননি। অপর দিকে সড়ক অবরুদ্ধ রেখে দুইজন সিনিয়র শিক্ষকের গাড়ি যেতে বাধা প্রদান করা হয় এবং তাদের অনুরোধ উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা দুর্ব্যবহার করে।

ইংরেজি নববর্ষের প্রথম দিন ভর্তির সময় শত শত নবাগত শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকের সামনে কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থীর এই আচরণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকের সাথে দুর্ব্যবহারের ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ও ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দাবিসমূহ পর্যায়ক্রমে যখন বাস্তবায়িত হচ্ছিলো এবং প্রশাসন সে ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দেয় তার মধ্যে শিক্ষার্থীদের এই আচরণ ছিলো অপ্রত্যাশিত। শুধু তাই নয়, ওই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২০-২৫জন ২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভবনের সামনে অবস্থান নেয়। ওই অবস্থানকালীন সময়ও তাদের কাছে এসে উক্ত তিনজনসহ চারজন শিক্ষক প্রকাশ্যে উস্কানীমূলক বক্তব্য রাখেন।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের অবশিষ্ট দাবির বিষয় খতিয়ে দেখে একটি সুপারিশ প্রদানের জন্য সকল ডিন এবং ছাত্রবিষয়ক পরিচালকের সমন্বয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে। কমিটি প্রশাসন ভবনের সামনে অবস্থানকারী শিক্ষার্থীদের সাথে তাদের দাবির বিষয়ে কথা বলতে গেলে ওই শিক্ষার্থীরা ডিনদের কোনো কথাই শুনতে রাজি হয়নি এবং এক পর্যায়ে কমিটির সদস্যদের দিকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করার মতো ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করে। পরের দিন ৩ জানুয়ারি তারা অফিস চলাকালে কলাপসিবল গেটে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে উপাচার্য, রেজিষ্ট্রারসহ প্রশাসনভবনে কাজে আসা শিক্ষক এবং কয়েক শত কর্মকর্তা কর্মচারিকে অবরুদ্ধ করে রাখে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এসব ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ এবং স্থিরচিত্র সংগ্রহ করে। এছাড়া ছাত্রদের হাতে অপমানিত হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন শিক্ষক প্রশাসনের নিকট লিখিত অভিযোগ দাখিল করে এর বিচার দাবি করেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকেও দুইজন শিক্ষককে অপমানিত করার বিষয়ে বিচার দাবি করা হয়। এর পরপরই করোনা মহামারীর কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। তবে প্রশাসনিক কাজ পুনরায় শুরু হলে এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই তিনজন শিক্ষককে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কাছে যেয়ে উস্কানীমূলক বক্তব্য প্রদান, তাদেরকে উত্তেজিত করতে বিভিন্ন মাধ্যমে উস্কানীমূলক স্টাটাস দেওয়াসহ এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনে বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ করে কারণ দর্শানো নোটিশ ইস্যু করে।

ওই শিক্ষকরা কারণ দর্শানো নোটিশের যে জবাব দেন তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসন পুনরায় তাদেরকে আরেক দফা কারণ দর্শনো নোটিশ দেয়। তাদের জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় কর্তৃপক্ষ তিনজন সিনিয়র শিক্ষকের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটি কার্যপরিধির আলোকে উক্ত তিনজন শিক্ষককে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিষয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ লাভে উপস্থিত হওয়ার জন্য পত্র দেয়। কিন্তু উক্ত তিনজন শিক্ষক তদন্ত কমিটিতে উপস্থিত না হয়ে তদন্ত কমিটির বিরুদ্ধে অনাস্থা জ্ঞাপন করেন।

এই অনাস্থা জ্ঞাপক তিনটি পত্রের মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে অভিন্নতা দেখা যায়। প্রভাষক হৈমন্তী শুক্লা কাবেরী তার অনাস্থা জ্ঞাপক চিঠিতে উল্লেখ করেন ‘তদন্ত কমিটিতে কোনো নারী সদস্য নেই। কমিটিতে তার সম্প্রদায়ের শিক্ষক নেই।’ একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে তার এমন অপ্রত্যাশিত ও অনভিপ্রেত উত্তরে কমিটিসহ বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সদস্যরা বিস্মিত হন। অপর প্রভাষক শাকিলা আলমও তদন্ত কমিটির প্রতি দৃঢ় অনাস্থা জ্ঞাপন করে পত্র দেন। তিনি তদন্ত কমিটির সামনে উপস্থিত হলেও কমিটিতে কোনো নারী সদস্য নেই জানিয়ে তার স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হওয়া এবং তদন্তকালীন কথাবার্তার অডিও রেকর্ড করার অনুমতি চান।

তদন্ত কমিটির নিকট থেকে নিরপেক্ষতা ও ন্যায় বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করে কমিটির প্রতি দৃঢ় অনাস্থা জ্ঞাপন করেন। বাংলা ডিসিপ্লিনের সহকারী অধ্যাপক মোঃ আবুল ফজল তদন্ত কমিটির প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করে রাজনৈতিকসহ বহুবিধ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তদন্ত কমিটির প্রতি দৃঢ় অনাস্থা জ্ঞাপন করেন। পরবর্তীতে তদন্ত কমিটি দুইবার পত্র দিয়ে তাদের উপযুক্ত সময় ও স্থান মতো সাক্ষাতকার প্রদানের জন্য পত্র দেয়। কিন্তু তাঁরা তদন্ত কমিটির সামনে উপস্থিত হননি। তাদের এসব আচরণ বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরির শর্তানুয়ায়ী অবাধ্যতা ও গুরুতর অসদাচারণ হিসেবে প্রতীয়মান হওয়ায় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনার পর সিন্ডিকেট তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বলে জানান একজন সদস্য।

সহকারী অধ্যাপক আবুল ফজল জানান, তাকে নোটিশ দেয়ার পুরো প্রক্রিয়াটি অবৈধ।এধরনের নোটিশের জবাব দিতে কমপক্ষে তার সাত কর্মদিবস প্রাপ্য। অথচ তাকে দেয়া হয়েছে দেড় কর্মদিবস।
এদিকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ ও প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) এস এম আতিয়ার রহমান স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে খুবি’র প্রকৃত ঘটনা না জেনে বিভ্রান্তিকর মন্তব্য বা বিবৃতি প্রদান থেকে বিরত থাকার আহবান জানানো হয়েছে।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন